মালবিকা শীলা:
মেয়েদের সাথে আমার বন্ধুত্ব খুব কম হয়। যাদের সাথে হয় তাদের সাথে রীতিমতো জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
প্রচলিতভাবে লক্ষ্মীছাড়া, উড়নচণ্ডি, পাগলী, এগুলো হচ্ছে আমার সম্পর্কে ভালো কথা, খারাপগুলো নাইবা বললাম। নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে পাগলা হাওয়ার বাদলের সাথে নেচে চলা একটি মেয়ে আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বোপরি ধর্মের জন্যে বিশাল হুমকি স্বরূপ।
এদের দেখলে ঈমানদারের ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। বখাটে হয়ে ওঠে প্রেমিক। পুতুপুতু মেয়েরা পায় কথা বলার সাহস।
এরকম মেয়েরা উচিত কথা বলতে পিছপা হয় না। পুরুষ শাসিত সমাজের কোমর ভেঙে যাবার ভয়ে এই পটপট করে কথা বলা মেয়েগুলোকে ভীষণ ভয় পায়। তাই ওদের ট্রাম্প কার্ড খেলে, বলে মেয়েটা বেহায়া, নির্লজ্জ। তাতেও যখন এদের টলানো যায় না, তখন বলে বেশ্যা, বাজাইরা।
শুধু এই ধরনের পুরুষদের দোষ দিলে ভুল হবে। ‘অন্য’ টাইপের মেয়েও আছে প্রচুর। যারা রাতে স্বামীর পিটুনি আর নিজের অনিচ্ছায় সঙ্গম সেরে সকালে ফেইসবুকে গদগদ হয়ে লেখে, ‘আমি কচি লাউ পছন্দ করি বলে আমাকে আমার হাজব্যান্ড কী সুন্দর দুটো কচি লাউ এনে দিয়েছে! লাভিউ মাই হাবি”!
নিজের লজ্জা আর অপমানকে লুকিয়ে যে কিনা পুরুষের বিষ্ঠামাখা পায়ের তলায় স্বর্গ খোঁজে, এরাই আসলে প্রগতির পথে বড় বাধা। এরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে অসভ্য পুরুষকে অবতারের আসনে বসায়, আর দ্বিধান্বিত নারীকে ভুল পথে চালানোর উস্কানি দেয়।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। মেয়েদের সাথে আমার বন্ধুত্ব কম হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, বেশির ভাগ মেয়েই শাড়ি, গাড়ি, অলঙ্কার, ফ্যাশন, মেকআপ অথবা স্বামীর কামাই এগুলো নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকে যে, আলাদা একজন মানুষ হিসেবে তার সম্যক বিকাশ ঘটার রাস্তাটা রুদ্ধ হয়ে যায়। এই গোলকধাঁধার বাইরের কিছু মেয়ে আমার বন্ধু, ওরা আমার মতো হয়তো আপাদমস্তক ঘর-সংসার বিমুখ নয়, তবে আমরা ভালোবাসতে জানি। টাকাকড়ি গয়নাগাটির ঊর্ধ্বে এই ভালোবাসা।
আবৃত্তিকার কাজী আরিফকে মহামানব বানানোর লক্ষ্যে যারা আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি মেহেরুন সুমনাকে ছোট করার চেষ্টা করছেন, তাদের বলি, হ্যাঁ, সুমনা বিবাহিতা ছিলো, দুটো বাচ্চাও ছিলো, এগুলো কি অন্য কাউকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হতে পারে? কাজী আরিফ নিজে কি বিবাহিত আর সন্তানের জনক ছিলো না? একই যাত্রায় পৃথক ফল কেন হবে? সুমনা মেয়ে বলে? ও আত্মহত্যা করেছে বলে?
সুমনাকে আমি একটাই দোষ দেবো। এরকম সুবিধাবাদী, মিথ্যুক, লম্পট একজনের জন্যে ও এই পথ বেছে নিয়েছিলো। ও বোকা। ও নিজেকে ভালবাসেনি। জীবন অমূল্য। তাছাড়া কে তাকে অপমান করলো কী করলো না, সেজন্য মরে যেতে হবে? আজ সাত বছর পর আবার সুমনা প্রসঙ্গ ফিরে এসেছে। তখনও ফেসবুক এতো জনপ্রিয় ছিল না বলে অনেকেই বিষয়টা জানেনি। এখন জানছে। দুজনকেই ধিক্কার দিচ্ছে একদল, কেউ মেয়েটার পক্ষ নিচ্ছে, আরেক দল কাজী আরিফের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে তাকে মহামানব, কিংবদন্তীতুল্য আখ্যা দিয়ে ফেলছে। তারা যারপরনাই লড়াই করে যাচ্ছে ‘একজন পুরুষকে’ বাঁচাতে। যেন তার সম্ভ্রমহানি ঘটে গেছে সুমনার প্রসঙ্গ ফিরে আসায়। এদের অধিকাংশই পুরুষ। আমি ওদের একাত্মতা দেখছি অন্যায়ের প্রশ্নে। পুরুষতন্ত্রের ধারক-বাহক সেই কাফেলায় কিছু নারীও যুক্ত হয়েছে। এটাই আশ্চর্য। অন্যায় যা তা নিজের বেলাতেও যা, অন্যের বেলাতেও তো তাই হবে। নয় কি?
ফেসবুকে এক বন্ধু আপনাদের উদ্দেশ্যেই লিখেছেন, “পুরুষ যেমন বেশ্যা হয়না, পতিতা হয়না বলে ধারণা পুরুষতন্ত্রের, তেমনি পুরুষরা মনে করে পুরুষ কখনও লম্পটও হয় না”। কথাটা নেহায়েত মন্দ বলেনি।
আপনারা যারা এই লোককে বিশাল মহামানব বানানোর চেষ্টায় আছেন, একবার আয়নায় নিজের মুখ দেখুন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধ্বজা বহন করতে গিয়ে কাল আপনার জন্যে কোনো সুমনার মৃত্যু হলে আপনিও, একইভাবে ঘৃণার্হ হবেন। এখনও সময় আছে, ভেবে দেখুন, আপনিও এরকম ঘৃণা আশা করেন কীনা! অন্যায় যে করে আর সেই অন্যায়কে যে গ্রাহ্য না করে , এরা দুজনেই সমান অপরাধী। আর কোনো সুমনার প্রতি হাত বাড়াতে গিয়ে একবার নয়, দশবার ভাবুন। নিজের কমিটমেন্টের জায়গাটা ঠিক রাখুন। অন্য একটি জীবন এলোমেলো করে দিলে মৃত্যুতেও আপনি এমনই ‘শ্রদ্ধার্ঘ’ পাবেন, প্রমিজ করছি।