নারী, এবার নিজের কথা ভাবো

ফাল্গুনী তানিয়া:

দুটো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে লিখছি। প্রথমটি, আমাদের বাসার ঘটনা। দীর্ঘদিন কল্পনা নামের একটি মেয়ে কাজে সহায়তা করে। মেয়েটির স্বামী কাজ পেলে করে, অথবা  ঘরে বসে থাকে। কল্পনা সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরামহীন কাজ করে দুটি সন্তানের সংসার চালায়। কাজ হঠাৎ চলে গেলে, উপার্জন কম হলে তার স্বামী তাকে শারীরিক নির্যাতন করে। মাঝে মাঝে এই নির্যাতনের মাত্রা এমন হয় যে, সে পরদিন কাজে আসতে পারে না। কল্পনার কথিত এই সোনার সংসারে একদিন আগুন ধরে গেল। কল্পনার স্বামী কোনো কিছু আগাম বুঝতে না দিয়ে দুম্ করে বিয়ে করে ফেললো। কল্পনার দুঃখের কাহিনি নাই-ই বাড়ালাম।

দ্বিতীয় কাহিনি আমার বাচ্চার বাবার ফুপার। তিনি এ পর্যন্ত তিনটি বিয়ে করেছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিয়ের কারণ ফুফুর পুত্র সন্তান না হওয়া। এখন তার বয়স ৮৭ বছর। পুত্রবধূদের নিয়ে সোনার সংসার। মেয়েরাও এ বেলা, ওবেলা তাকে দেখতে আসে। এই সোনার সংসারেও আগুন লাগলো। কারণ ৮৭ বছর বয়সে ফুপা চতুর্থ বিয়ের ইচ্ছা পোষণ করলেন। কারণ তার স্ত্রী অসুস্থ, স্বামীর সেবা করতে পারে না। পুত্রবধু ও কন্যাদের কারণে তার সেবার ত্রুটি হচ্ছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য না। তবে হ্যাঁ, সে যদি যৌনসেবা চায়, সেটার জন্য বিয়ে ছাড়া গত্যন্তর নেই।

তসলিমা নাসরীন তাঁর নির্বাচিত কলামে লিখেছেন, প্রস্টেট বড় হওয়ার কারণে ৬০ থেকে ৭০ বছর বয়সে পুরুষের যৌন উত্তেজনা হঠাৎ বৃদ্ধি পেতে পারে। মূলত, এই কামোদ্দীপনা স্থায়ীভাবে পুরুষত্বহীন হবার পূর্ব লক্ষণ। কিন্তু ফুপার সেই বয়সটিও পার হয়ে গেছে। মৃত্যু সন্নিকটে, তাই একজন নতুন নারী নিয়ে পৃথিবী উপভোগ করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না সে।

চোখে দেখে না, কানে শোনে না, সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না, তবু ঘাটের মড়ার বিয়ের শখ যায় না। প্রতিটি পুরুষের সামাজিক ও ধর্মীয় সুযোগ-সুবিধা এতো বেশি যে, নারীকে তারা অত্যন্ত সুলভ মনে করে। ফুপার এই বয়সে এই চিন্তা করতে হয়নি বিয়ের জন্য মেয়ে পাবে কোথায়।

ফুপুও অসুস্থ, কিন্তু তার সেবার জন্য সামর্থ্যবান একজন পুরুষকে বিয়ের কথা সে চিন্তায়ও আনতে পারে না। কল্পনাও দুটি সন্তানকে রেখে বিয়ের কথা ভাবতে পারছে না। অথচ তার সামনে সুদীর্ঘ জীবন পড়ে আছে। তার শরীরেরও দাবি আছে। আজ ফুপা বিয়ে করলে সবাই বাহ্বা দেবে – এখনো শরীরে তাকত আছে। গোপনে কেউ বউ বশ করার মন্ত্র নিতে যাবে। এই লাম্পট্য চায়ের দোকানে মুখরোচক সংবাদের জন্ম দেবে। অনেক পুরুষের গোপনে লালা ঝরবে, অনেকে রাতে স্বপ্নে নতুন নারীর সঙ্গে রতিক্রিয়া করবে।

অথচ স্বামী অপরিণত বয়সে সন্তান রেখে মারা গেলে সবাই আশা করবে সেই নারীটি সন্তান বড় করার মধ্যে তার সব সুখ খুঁজে নেবে বা নিতে বাধ্য হবে। মহীয়সী নারী, আদর্শ নারী, এই জাতীয় অনেক পুরুষতান্ত্রিক শব্দ আপনার মাথায় শিরোপা পরানোর জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই শব্দগুলোই আপনার পুরো জীবনকে অর্থবহ করে তুলবে কীনা সময় হয়েছে ভেবে দেখার।

পুরুষ মানুষকে কখনোই তুষ্ট করা সম্ভব না। সে কখন কোন বয়সে কেন আপনাকে ছেড়ে যাবে সেটা বোঝা সম্ভব না। যার আত্মতৃপ্তির জন্য আপনি আপনার সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছেন, একসময় সেই বলবে, আপনি তাকে কিছুই দেননি। একবার আমি আমার আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে গিয়ে শুনলাম দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার প্রচণ্ড বাক-বিতণ্ডা। বিষয়, বৃদ্ধ নাকি সারাজীবন যৌনসুখ পায়নি। বৃদ্ধার রোষান্বিত স্বর, তাহলে সাতটা বাচ্চা কি এমনি এমনি হলো? একজন নারী যৌনসুখ না পেলেও সন্তানবতী হতে পারে, কিন্তু একজন পুরুষের যৌনতুষ্টি না হলে সন্তান হওয়া তো সম্ভব নয়।

নারী, পুরুষের সেবাই জীবন ব্যয় না করে এবার নিজের দিকে তাকান। আপনার নিজের আনন্দের কথা ভাবুন। ভাবুন, কতদিন এই পুরুষটিকে রান্না করে খাওয়ানোর জন্য আপনি আপনার বাবার বাড়ি যাননি, ভাবুন এই পুরুষটির সুখের জন্য আপনি আপনার মাকে মৃত্যুশয্যায় রেখে চলে এসেছেন, ভাবুন এই পুরুষের বন্ধুটির জন্য কতো মুখরোচক খাবার রেঁধেছেন, অথচ নিজের বান্ধবীকে খেয়ে যেতে বলতে পারেননি, ভাবুন এই পুরুষের আত্মীয়-স্বজনের জন্য কী না করেছেন, কোনো ঈদে হয়তো নতুন শাড়ি হয়নি, কিন্তু পুরুষটি কোনো এক সময় আপনার সব আত্মত্যাগ ভুলে যাবে। কারণ, পেয়ে অভ্যস্ত বলে এটাই তার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে। আপনিই তাকে পুরনো চটি জুতোর আরাম দিয়েছেন, তাই আপনাকে পদদলিত করতে তার বাঁধে না। এবার পায়ের জুতো থেকে নিজের অবস্থান মাথার মুকুটে পরিণত করার উপায় খুঁজে বের করুন।

ফাল্গুনী তানিয়া, পি এইচ. ডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা; এবং

খণ্ডকালীন শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, উত্তরা, ঢাকা।

শেয়ার করুন: