রেজভীনা পারভিন:
“আপা আমি আর পারছি না! গতকাল রাতে অনেক মেরেছে। শরীরের ডান পাশটা নাড়াতে পারছি না। মাথা ধরে দেয়ালের সাথে বাড়ি দিতে থাকে, মুখ চেপে ধরে পেটায়, বুকের উপর উঠে মুখ চেপে ধরে বলে, তুই কি আমার সাথে পারবি?”
এই কথাগুলো ম্যাসেঞ্জারে এসেছে। কী বলবো? কী করবো? ভেবে পাচ্ছিলাম না। এরকম কথা এর আগেও অনেক পেয়েছি। যখন প্রশ্ন করলাম, পরিবারকে জানিয়েছে কিনা? উত্তরটা ছিল খুব্ হতাশাজনক।
পরিবারের সদস্যরা তাদের মানসম্মান নিয়ে চিন্তিত। তাদের মেয়ে বা বোন মার খাচ্ছে সেটা মানুষ জানতে পারলে উচ্চপদস্থ ভাইদের মান-সম্মান কমে যাবে। তাই তারা বোনের পাশে না দাঁড়িয়ে নিরব থাকছেন দিনের পর দিন। আর বোনকে পরামর্শ দিচ্ছেন মানিয়ে চলতে। নিজ পরিবার ছাড়া অন্য আত্মীয়দের সাহায্য চাইলে, যেহেতু মেয়ের পরিবার চায় যেভাবেই হোক মেয়েটি সংসার করুক, তারাও কেউ পাশে দাঁড়ায় না।
কিন্তু এভাবে আর কতদিন পারবে মেয়েটি? স্বামী পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে, পারিবারিক কলহের কারণে, যৌতুকের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উসিলায় চলে এই নির্যাতন। সব সংসারে তো এসব হয় না, যে সংসারে হয় বুঝতে হবে মেয়েটি একটি বিশেষ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। তাই বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ সাপোর্টও দরকার। এই পরিবারের লোকজনই যখন মেয়েটির জীবন বিপন্ন হয়, তখন মামলা করে। কিন্তু একটি জীবন বিপন্ন হওয়ার আগেই কেন পরিবার এগিয়ে আসে না?
এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোর একটি খবর উল্লেখ করতে চাই। ২৫ এপ্রিল ২০১৭, প্রথম আলো “পরিত্যক্ত পানির ট্যাংকে গৃহবধূর লাশ” ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধির বরাত দিয়ে খবরটি ছেপেছে। এমন আনেক খবর আমরা পাই কাউকে বস্তাবন্দী অবস্থায় পাওয়া যায়, কাউকে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়, কাউকে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে শ্বশুরবাড়ির পরিত্যক্ত পানির ট্যাংক থেকে কামরুন্নাহার তূর্ণা (২৮) নামের এই গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ জানায় হাত বাঁধা, মুখে পলিথিন মোড়ানো ও গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় ওই লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।
কামরুন্নাহার আশুগঞ্জ উপজেলার চর চারতলা ইউনিয়নের আরিফুল হকের স্ত্রী। পাঁচ বছরের বিাবাহিত জীবনে তাদের সাড়ে তিন বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। এই ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এক বছর ধরে পারিবারিক কলহের জের ধরে কামরুন্নাহার ও আরিফুলের মাঝে সমস্যা চলছিল। স্বজনরা অভিযোগ করেছে, কামরুন্নাহারের স্বামী আরিফুলই তাঁকে খুন করেছেন। এবং লাশ উদ্ধারের পর থেকেই আরিফুল পলাতক রয়েছেন।
কামরুন্নাহারকে খুঁজে না পাওয়ায় তার বাবা মফিজুল হকের কথা মতো মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়, এবং সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বাড়ির পরিত্যক্ত পানির ট্যাংকের ভেতরে হাত বাঁধা ও মুখে পলিথিন মুড়িয়ে রাখা এবং গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় কামরুন্নাহারের লাশ পাওয়া যায়। এই দুর্ঘটনার পরে মেয়েটির বাবা মামলা করেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, এক বছর ধরে সমস্যা চলছে আত্মীয় স্বজন ও পরিবারের সদস্যরা জানেন, কিন্তু মেয়েটির পাশে কি কেউ দাঁড়িয়েছিল? এখন একটি জীবন শেষ হবার পর মামলা করা যাবে, হয়তো আরিফুল ধরাও পড়বে, কিন্তু একটি তিন বছরের শিশু মা হারা হয়ে গেল! আর কামরুন্নাহার তূর্ণার মাত্র ২৮ বছরে জীবনের সব স্বপ্ন ভেঙে গেল।
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। আমরা অনেকেই হয়তো মোবাইলে, ম্যাসেঞ্জারে আর ইনবক্স এ নির্যাতন চলাকালিন সময়ের আর্তনাদ শুনতে পাই, কিন্তু পরিবার পরিজন কেউ যথাসময়ে এগিয়ে আসে না, ভিন্নমত থাকতে পারে। আমি বেশ কিছু ঘটনার একই চিত্র পেয়েছি।
কামরুন্নাহার তূর্ণার ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করার একটিই কারণ, প্রতিবেদন পড়েই জানতে পারলাম স্বজনরা জানিয়েছে, বছরখানেক ধরেই মেয়েটির সমস্যা চলছিল। সমস্যা যাই হোক না কেন, কেন মেয়েটিকে জীবন দিতে হবে? শুধু মেয়ে হওয়ার জন্যই কি আজ এই পরিণতি?? অনেকেই হয়তো বলবেন, কেন কামরুন্নাহার বের হয়ে আসলো না আগেই? কেন জীবন দেওয়া পর্যন্ত আরিফুলের সংসারে বসেছিল?
ঠিক এইখানেই তো পরিবার এর সাপোর্ট দরকার। কারণ হুট করে হয়তো নিজের আর বাচ্চার দায়িত্ব একা নেওয়ার সাহসটা কামরুন নাহার করতে পারছিলেন না! কামরুন নাহাররা কেন নিজেদের জীবন বিপন্ন হওয়ার আগেই বের হতে পারে না? আমি এখানে তার সম্ভাব্য কিছু কারণ তুলে ধরছি।
১. তাকে প্রথমত শ্বশুর বাড়ি থেকে বের হয়ে থাকার একটি আশ্রয় খুঁজে বের করতে হবে; ২. যদি নির্যাতনের পরে চিকিৎসা দরকার হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে; ৩. আইনি পদক্ষেপ নিতে হলে কোর্ট কাচারি, যোগাযোগ ও তার খরচ; ৪. বের হয়ে আসার পর স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির হাত থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখা; ৫. সে যদি কর্মজীবী হয়, তাহলে তার অফিসিয়াল দায়দায়িত্ব চালিয়ে নেওয়া তার জন্য কঠিন হয়; ৬. আর্থিক স্বচ্ছলতা তার নিজের আছে কিনা; ৭. সর্বোপরি যে সন্তান সে সাথে করে নিয়ে এসেছে, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
এখন প্রশ্ন এই লড়াইগুলো কি কোন মেয়ে একা করতে পারে না? পারে, অবশ্যই পারে। অনেক উদাহরণও আমার জানা যারা এই সমাজে এই বন্ধুর পথ পার করে এসেছে এবং জয়ী হয়েছে। কিন্তু পথটা যে কঠিন আর বন্ধুর তা নিয়ে নিশ্চয়ই আমাদের দ্বিমত নেই। এখানেই মেয়েটির পরিবারের একটু পাশে থাকার প্রসঙ্গ আসে।
কারণ সবাই হয়তো একভাবে পেরে ওঠে না, মেয়েটির জীবনের সামান্য একটু সময় তাকে সহযোগিতা করলে বাকি পুরোটা জীবন সে ঠিকই সাফল্যের সাথে পার করতে পারবে। কিন্তু জীবনের এই ট্রাঞ্জিশনাল পিরিয়ডে একটু সমর্থন প্রয়োজন। এই পারিবারিক বিপর্যয়ে পড়ে মেয়েটির মানসিক স্বাস্থ্যও খুব খারাপ থাকে; এসময় সম্ভব হলে তাকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বা কাউন্সেলিং সেবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার তার মনোবল ঠিক রাখার জন্য।
একটি পরিবারে যে মেয়েটি ছোট থেকে বড় হলো, তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার পর কেন আর সমাজ তার পাশে থাকতে চায় না? কেন এতো অনীহা? কিসের এতো সংশয়? আসলে আমাদের অনেকের ম্যাসেঞ্জার আর ইনবক্স এর এই আকুতিগুলো, এই কান্নাগুলোর দায়িত্ব কে নিবে?
লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও উন্নয়ন কর্মী।