জয়াদের আপনজন কেউ থাকে না

ঝুমকি বসু:

সেদিন আমার বান্ধবী জয়ার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেলাম। জয়ার বিয়ের আগে ওদের বাড়িতে মানে ওর বাবার বাড়ি প্রায়ই যেতাম। আমাদের ছোটবেলার বন্ধুত্ব। কিন্তু বিয়ের পর ওর শ্বশুরবাড়িতে এই প্রথম গেলাম। কী একটা অজানা কারণে বিয়ের পর থেকে জয়া আমাদের এড়িয়ে চলতো। নিতান্ত বাধ্য হয়েই সেদিন একটা প্রয়োজনে ওর বাসায় আমাকে যেতে হলো।

ওরা যৌথ পরিবারে থাকে। শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ভাসুর, জা মিলে ১৭-১৮ জনের বিরাট পরিবার। আমি গেলে কী আপ্যায়ন! কত কী যে রান্না করেছে! খাবার টেবিলে জয়াকে অনেক অনুরোধ করলাম আমার সঙ্গে বসে খাওয়ার জন্য। কিন্তু ও কিছুতেই বসতে রাজি হলো না। শুক্রবার থাকায় বাসায় সবাই ছিলো। আমি খাওয়া শেষ করলে জয়া আমাকে ওর ঘরে বিশ্রাম নিতে বলে নিজে খেতে গেলো।

হঠাৎ মনে হলো, আমি বরং জয়ার পাশে বসে ওর সঙ্গে গিয়ে গল্প করি। ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখলাম ওরা সব জায়েরা মিলে একসঙ্গে খেতে বসেছে। কিন্তু এবার আমার চমকে ওঠার পালা। আমি দেখলাম ওদের পাতে মুরগীর গলা, বুকের খাঁচা, ভাঙ্গা এক টুকরো মাছ। আমি যারপরনাই বিস্মিত। যখন খেতে বসেছিলাম তখন কত খাবার ছিল, সবাই খেলো। এখনো অনেক খাবার টেবিলে দেখতে পাচ্ছি। তাহলে খাচ্ছে না কেন? ওরা খুব অভিজাত মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবার। বুঝতে পারছিলাম না ব্যাপারটা কি ঘটছে। জয়া ঘরে আসতেই ওকে চেপে ধরলাম। জানতে চাইলাম ব্যাপারটা কি? ওর চোখে জল।

আর এরপর যা শোনালো, আমি তা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। ওদের পরিবারে কে কী খাবে তা ঠিক করে দেন ওর শাশুড়ি। ভালো ভালো সব খাবার শুধুমাত্র বাড়ির পুরুষ সদস্যদের জন্য। বড় মাছ, মাংসের রান এগুলো খাওয়া বউদের জন্য হারাম। ওর শাশুড়ির ভাষায়- মেয়েমানুষ আবার এতো কী খাবে? ওদের জন্য তাই বরাদ্দ সব উচ্ছিষ্ট।

আমার বুকের ভেতরটা ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। জয়া যে কী আদরে মানুষ হয়েছে আমি তার সাক্ষী। ওরা দুই ভাই-বোন ওর বাবা-মায়ের নয়নের মণি। মুখ থেকে কিছু বের করার আগেই আঙ্কেল তা পূরণ করতেন। আর সেই জয়া আজ এসব খায়! আমি ওকে বললাম, তোর বর না মানবাধিকার কমিশনে চাকরি করে। মুখে কত বড় বড় কথা! এখন বাসায় এগুলোর প্রতিবাদ করে না কেন? ওর বর কেন, বাসার সবাই নাকি মাকে এতো সম্মান(!) করে যে, তার প্রতিটি কথা আর কাজ অক্ষরে অক্ষরে মেনে নেয়।

সম্মান করে নাকি ভয় পায় আমি জানি না, তবে এই মানসিকতা যে পরিবারের, সেখানে আমার এক মুহূর্ত আর থাকতে ইচ্ছে করছিলো না।

এই কাহিনী শুধু জয়ার নয়। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারেই এখনো মেয়েদের এই দশা। একটা মেয়েকে বাবা-মা যখন মানুষ করেন, তখন কত যত্নেই না মানুষ করেন। আর শ্বশুরঘরে গিয়ে সেই মেয়ের কী যে অবস্থা! মেয়েরা যখন ত্রিশ বছর পার করে তখন তাদের শরীর ভেঙ্গে যেতে থাকে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দেয়। হাড় ক্ষয় হয়ে যেতে থাকে। চেহারা নষ্ট হতে থাকে। সিজার করে মা হলে শরীরে যে ক্ষত তৈরি হয়, আজীবন তার রেশ টানতে হয়। মেয়েদের শরীরে প্রতি মাসে একটা ডিম তৈরি হয়। তার জন্য প্রয়োজন হয় পুষ্টিকর খাবার। এই গরমে রান্না করতে গিয়ে যেভাবে শরীরের পানি বের হয়ে যায়, তা পূরণ করতে ঠিকঠাক খাওয়া দরকার। স্তন্যপান করায় যে নারী, তার প্রয়োজন হয় বেশি বেশি খাবারের।

আর পরিবারের প্রধান যিনি, সেই শাশুড়ির ভাষ্য- মেয়েরা আবার কী খাবে? সেইরকম শাশুড়িদের বলছি, ভাবতে অবাক লাগে আপনি নিজেও একজন নারী। নারী হয়েই নারীদের সঙ্গে এসব করছেন। ছেলের বউ মানেই কি ফেলনা? তাদের খাওয়ালে কি খাবার কমে যায়? পারতেন আপনার নিজের মেয়ে হলে এমন করতে? ছেলের বউদের খাবারে লোভ লাগে না, কারণ তারা বাবার বাড়ি থেকে যথেষ্ট ভালো ভালো খাবার খেয়ে এসেছে,  তাদের শরীরের প্রয়োজনের কথাও না হয় বাদ দিলাম। প্রবলেমটা হলো আপনার মানসিকতার, আপনার শিক্ষার আর রুচির। আপনি আপনার ছেলের বউয়ের মা হতে চান, আপনি চান তারা আপনাকে সম্মান করুক, ভালবাসুক। কিন্তু আপনি কি নিজে আপনার ছেলের বউকে মেয়ের মতো ট্রিট করেন?

মানছি কোনো কোনো পরিবারে ছেলের বউদের কাছ থেকে বৃদ্ধ শ্বাশুড়ি অত্যাচারিত হচ্ছেন, এমনকি বৃদ্ধাশ্রমেও থাকতে হচ্ছে। সবক্ষেত্রেই কিছু ব্যতিক্রম তো থাকেই। আপনি এখন আপনার শক্তি থাকা অবস্থায় আপনার ছেলের বউকে যে নির্যাতন করছেন… তারা কি এগুলো ভুলে যেতে পারবে? আপনার এই শক্তি আজীবন থাকবে না, এই বউদের ওপরই একদিন আপনাকে নির্ভর করতে হবে। দিন কখনোই একভাবে যায় না। তাই এখন থেকে তার সঙ্গে একটু ভালো ব্যবহার করুন, অন্তত আপনার নিজের কথা ভেবেই করুন।

এইসব নির্যাতিত বউদের জন্য নেই কোনো বউ আশ্রম, নেই মনের কথা খুলে বলে হালকা হবার মতো মানুষও। নিজে প্রতিবাদ করতেও পারে না, আর তার স্বামীও তার পাশে এসে দাঁড়ায় না, কারণ কোন সন্তানই তার মায়ের নিন্দা শুনতে পারে না, মাকে খারাপ ভাবতে পারে না। এসব বউয়েরা চেষ্টা করেই যায় সংসার টিকিয়ে রাখার। যখন আর পেরে ওঠে না, বেছে নেয় ইচ্ছামৃত্যু। আর যেসব বাইরে গিয়ে বড় বড় নারী অধিকারের কথা বলে, আর ঘরের ভেতর জুজু হয়ে থাকে তারা কি মানুষের পর্যায়ে পড়ে? যে তার স্ত্রীর অধিকার আদায় করে দিতে পারে না, মায়ের ভয়ে নীরবে সব সয়ে যায়- সে কি আসলে কোনদিন মানুষ হতে পারবে? মাকে সম্মান করা প্রতিটি মানুষের কর্তব্য কিন্তু তাই বলে মা কোনো অন্যায় করে গেলে তা মুখ বুঁজে মেনে নিতে হবে?

সেই স্বামীদেরও বলছি, আপনার স্ত্রী শুধু আপনার ভরসায় তার সবকিছু ছেড়ে এসেছে। একবারও কি দাঁড়িয়েছেন তার পাশে? শক্ত করে ধরেছেন তার হাতটা? শুনেছেন তার না বলা কথা? শুধু খাবার নিয়েই নয়, কীভাবে প্রতি পদে পদে আপনার পরিবারেই লাঞ্ছিত হচ্ছে আপনার সঙ্গিনী, কোনদিন ভেবে দেখেছেন তা?

জয়ার মতো একটা শিক্ষিত, সচেতন, রুচিশীল নারীও আজ মুখ বুঁজে সব সয়ে যাচ্ছে শুধু সংসারটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। সে নিজে যে মানসিকতার, তার উল্টো মানসিকতার পরিবারেও দম বন্ধ করে তাকে বাস করে যেতে হচ্ছে।

হায়রে লক্ষ লক্ষ জয়া… মাথার ঘাম পায়ে ফেলা সংসারে তোমার কেউ নেই আপনজনা।         

শেয়ার করুন: