কাজল দাস:
প্রাকৃতিক নির্বাচনের (natural selection) সবচেয়ে অসামান্য ও অনন্য সুন্দর এক ফলাফলের নাম হলো নারী। স্তন্যপায়ী প্রজাতির এই স্ত্রী প্রাণিটি অনেক ক্ষেত্রে শুধু পুরুষ অপেক্ষা সুন্দরই নয়, অনেক বেশি সহনীয় ও মানবিক গুনাবলির অধিকারী।
শুধু প্রজননের মাধ্যমেই সে প্রজাতিকে ধারণ করে তাঁর কাজ শেষ করে না, এই প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সে বহুগুণে নিজেকে উৎসর্গ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। গর্ভধারণ, জন্ম দান, স্তন দান, সুরক্ষা দেয়া, স্নেহ ও ভালবাসা দিয়ে সে তাঁকে ইতর প্রাণি থেকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ মানুষে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই প্রজাতি রক্ষার বিরামহীন চক্রে তাঁর অবদান পুরুষের থেকে শতগুণ বেশি। সিমোন দ্য বুভোয়ার তাঁর ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ বইয়ে নারীর এই প্রজাতির রক্ষার ভূমিকাকে প্রকাশ করেছেন এইভাবে –‘প্রজাতি আশ্রয় নেয় স্ত্রী প্রজাতির মধ্যে, তাঁর স্বতন্ত্র জীবনের প্রায় সবকয়টাই শুষে নেয় প্রজনন…, একটা পরিণত বয়স্ক প্রাণির নিষিক্ত ডিমের বিকাশই স্ত্রী জাতির পক্ষে একটি সর্বাত্মক কাজ হয়ে উঠে। যৌন সংস্রব একটা অবিরাম প্রক্রিয়া এবং এটা এমন একটা যা পুরুষের সামান্যই জীবনী শক্তি কেড়ে নেয়।’
যৌন ক্রিয়া একজন পুরুষের জন্য শুধুমাত্র অংশগ্রহণ, কিন্তু নারীর জন্য এক দুঃসহ যাত্রার ফলাফল হিসেবে জন্ম নেয় সন্তান উৎপাদন। এই এতো পরিশ্রমের পরেও নারীই প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সুন্দর। এই অনিন্দ্য সুন্দর নারী, যাকে নিয়ে কাব্য, চিত্রকলা, শিল্প, সাহিত্য, সংগীতের এতো বন্দনা করা হয়েছে, এমনকি যার রুপ, রস আর সৌন্দর্য্যকে হাজার হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার নিদারুণ নিষ্পেষণও কিছু করতে পারেনি, সেই নারীকে শুধুমাত্র থামিয়ে দিয়েছে পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম।
পৃথিবীর প্রধান দুইটি আব্রাহামিক ধর্ম (ইসলাম ও খ্রিশ্চিয়ান) মনে করে যে, এই নারীর জন্ম হয়েছে, পুরুষের বাম পায়ের উরুর হাড় হতে। যে মহান পুরুষের হাড় হতে এই নারীর জন্ম হয়েছে, তার নাম আদম অথবা এ্যাডাম। আর আদমের সেই বাম পায়ের হাড় থেকে জন্ম নেয়া পৌরাণিক অভিশপ্ত নারী হলেন বিবি হাওয়া অথবা ইভ। একটি বিশেষ বাগানের ফল বা গন্ধম খাওয়ার কারণে যাকে অভিশপ্ত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। যার ভুলের কারণে মানবজাতিকে স্বর্গ হতে পৃথিবীতে চ্যুত হতে হয়েছে বলেই দায়ী করা হয় আজ পর্যন্ত।
এই হাওয়া হলেন আমাদের ঐতিহাসিক দুর্ভাগা মা। আমরা সবাই যার সন্তান। সৌভাগ্যবশত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদিকে আমাদের দুর্ভাগা মায়ের সন্তান হলেও সেক্সের দিক থেকে সেই মায়েরই সমলিঙ্গ এক নারী। হাওয়ার মতো তিনিও বাইবেল ও কোরান অনুযায়ী আদমের বাম পায়ের হাড় থেকে উৎপন্ন হওয়া এক জীব মাত্র।
আমাদের এই মা হলেন ঈশ্বরের এক করুণার সৃষ্টি। মহান ঈশ্বর যখন মনে করলেন যে, তার সৃষ্ট পুরুষ আদমের একা একা থাকতে কষ্ট হবে, তখন তিনি তার সহায়ক হিসেবে ঘটনাচক্রে সৃষ্টি করলেন এমন এক বস্তুকে, যে আসলেই বা পায়ের উরুর হাড় থেকে উদ্ভৃত এক বস্তু, যার নাম নারী; কিন্তু আদতে সে নারী নয়। তার নাম মাংসপিণ্ড।
আমাদের এই মাংসপিণ্ড মা, সেই শুরু থেকেই যে একখণ্ড মাংসের দলা হয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো, আজ পর্যন্ত তাকে লহমায় লহমায় গিলে খাচ্ছে পুরুষতন্ত্র। এই পুরুষতন্ত্র তাকে আজ পর্যন্ত সঠিক সম্মান ও মর্যাদাটুকু দিতে চায় না। তারা আজও মনে করে পুরুষের জন্য নারী নয়, এক খণ্ড মাংসপিণ্ড লাগবে। নারী কেবল একটি যৌন সঙ্গম ও প্রজনন রক্ষার যন্ত্র মাত্র!
আমাদের ধর্মতন্ত্রে বিশ্বাসী পুরুষেরাও মনে করে এই যন্ত্র কখনই দেশের সুপ্রীম কোর্টে নয়, রান্না ঘরেই থাকা উচিত। তাঁদের নামাযের জন্য নির্ধারিত জায়গা, সুপ্রীম কোর্টের পাশের ঈদগাহের সামনে তাঁর ভাস্কর্য অশোভনীয়। অশোভনীয় কারণ, সে আসলে মাংসপিণ্ড। যা পুরুষতন্ত্রের ঈমানকে খুব সহজে বিপথে পরিচালিত করে ফেলতে পারে। তাঁদের এই আচরণ আমাদের মা হাওয়ার কথাই মনে করিয়ে দেয়, যাকে আদমের প্ররোচনাকারী হিসেবে আজো ‘আদিপাপী’ বলে গণ্য করা হয়।
পুরুষতন্ত্র আমাদের এই ‘মাংসপিণ্ড’ মাকে আজ পর্যন্ত কিছুই দেয়নি, কিন্তু আমাদের এই মা গোটা মানব সভ্যতাকে তিলে তিলে তার শ্রম দিয়ে গড়ে তুলেছে। ইতিহাসের কী নির্মম ট্রাজেডি, আমার অভিশপ্ত মা হাওয়াকে, পুরুষতন্ত্র আর পিতৃতন্ত্র জোর জবরদস্তি করে ক্রমেই পিছিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সেই মা তিলে তিলে এই সভ্যতাকেই আজ এতদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে এসেছে নিজের কাঁধে আর জরায়ুতে বহন করে। আমাদের এই মা সমাজকে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষ উপহার দিয়েছে, অথচ সে নিজেই তাঁর পাঁজরের হাড়ের সমান হয়ে আছে। সে সভ্যতাকে নির্মাণ করেছে; কিন্তু সভ্যতা তাঁকে কুঠারাঘাত করে ভেঙ্গে দিয়েছে। আমাদের মা সর্বংসহা আর পুরুষতন্ত্র তাঁর দলবল মিলিয়ে মহাপরাক্রমশালী। এই মহাপরাক্রমশালীরা আজ তাঁর একটি ভাস্কর্যকে টিকে থাকতে পর্যন্ত দিতে চায় না!
সভ্যতার এই যাত্রায় আমাদের এই মা কেবল শুধু সন্তান জন্ম দেয়নি। সে জন্ম দিয়েছে প্রেম বা ভালবাসার মতো মহৎ অনুভূতির। তার হাত ধরে জন্ম হয়েছে কৃষির, তার হাতেই বিকশিত হয়েছে বিজ্ঞানের অনেক ধারণার। সমাজের উৎপাদনশীলতাকে সে হাজার গুণে পরিচালিত করে সভ্যতার চাকাকে এগিয়ে দিয়েছে। বিনিময়ে পুরুষতন্ত্র তাকে পদাবনত করেছে। অস্বীকৃত রেখেছে। পদদলিত করেছে। অধস্তন করে রেখেছে। তার চারপাশে নির্মমতা ও পাশবিকতাকে শৃংখল দিয়ে আষ্ট্রেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে। সম্মান ও মর্যাদা থেকে নামিয়ে পরাজিত করেছে। পুরুষতন্ত্রের হাতে তার সেই পরাজয়ের নাম ‘মাতৃতন্ত্রের ঐতিহাসিক পরাজয়।’ পুরুষতন্ত্রের হাতে আমাদের সেই মায়ের পরাজয় আজো থামেনি। অথচ এটার নাম আধুনিক সভ্যতা, এখানে আবার নারীরাই দেশ চালায়, প্রধানমন্ত্রী হয়!
প্রায় ১৫ হাজার বছরেরও আগেকার তার এই ঐতিহাসিক পরাজয় আজও চলছে। তার এই পরাজয়কে যারা প্রতিপালন করে আসছে এর নাম পুরুষতন্ত্র। পুরুষতন্ত্র অনেক শক্তির সহায়তায় তাকে পীড়ন করে চলছে। সেই শক্তির একটি উপাদান হলো ধর্ম। আজতক ধর্ম তাঁকে যতভাবে পীড়ন করেছে, এই অবিচার আর অপমানের কলঙ্ক, মানব সভ্যতা আগামী লক্ষাধিক বছর পরেও ঘুচাতে পারবে না। আজকে যে কারণে ভাস্কর্য অপসারণ করার কথা হচ্ছে, এর মূল কারণ হলো যে, এটি ঐতিহাসিকভাবে পরাজিত এক নারীর ভাস্কর্য। এক মাংসপিণ্ডের ভাস্কর্য। যে ন্যায়বিচারের দণ্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুপ্রীম কোর্টের সামনে। এই কোর্ট হলো একটি ইসলামী দেশের সর্বোচ্চ কোর্ট। যে দেশ চালায় পুরুষেরা। যে দেশ চলে ধর্মতন্ত্র দিয়ে। যে দেশের ধর্ম পুরুষের হাতে। সকল ক্ষমতাও পুরুষের হাতে। যে দেশ ‘৭১ সালে ৩০ লক্ষ শহীদের পাশাপাশি ৩ লক্ষ নারীর উপর নির্যাতনের ফলে জন্ম লাভ করেছে, সেই দেশের আদালত থেকেই সরাতে হচ্ছে নারীর ভাস্কর্য। ইসলাম, পুরুষতন্ত্র ও ক্ষমতাবানদের আদালতের সামনে কি নির্মম অবিচার! তারা নারীকে উন্নত শির ও উচ্চ মর্যাদায় দেখতে চায় না। রাখতে চায় না।
আজকে নারীর এই ভাস্কর্য যারা অপসারণ করতে চায়, তাঁদের যুক্তি আর আমাদের মা হাওয়াকে প্রথম অভিশপ্ত নারী হিসেবে চিহ্নিত করে দেখার মাঝে কোন তফাৎ নেই। আজ থেকে হাজার বছর আগে তাঁকে যেভাবে সম্মান দেয়া হয়নি, আজো তাঁকে সম্মান না দেয়ার জন্যই এই ধর্মতান্ত্রিক চক্রটি তাঁর ভাস্কর্য সরাতে চায়। এই ভাস্কর্য সরানোর জন্য আবার উঠে পড়ে লেগেছেন একজন নারী, যিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী।
দেশের সকল নারীশক্তির পক্ষের পুরুষ ও নারীদের এখন উচিত সর্বোতভাবে এই ভাস্কর্য অপসারণ প্রতিরোধ করা। এই অপসারণের সাথে যেমন পুরুষতন্ত্র আর তাঁর ধর্মের জোর জড়িত, একইভাবে সেটা আজকের দিনের নারীর স্বাধীনতা, সমতা ও মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত। এটি শুধুমাত্র নিছকই কোন ভাস্কর্য অপসারণ নয়, এটি পক্ষান্তরে মর্যাদার স্তর থেকে নারীকে অপসারণ করার নামান্তর। এটা ঠেকানো দরকার।
ঠেকানো দরকার, কারণ নারী পুরুষের সমতা বা নারীর স্বাধীনতা এটি শুধু কথার কথা নয়, এটি সমাজের একটি বিপ্লবাত্মক ধারণা। এই স্বাধীনতা কোন লুতুপুতু বা পুরুষের ইচ্ছা নিরপেক্ষ ব্যাপার নয় যে, ভাস্কর্য ইচ্ছা হলেই সরিয়ে ফেলা হলো। তাঁকে আবার চাইলেই পদদলিত করা গেলো। এটি আমাদের অভিশপ্ত মা হাওয়া অথবা ইভের কালান্তরের নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে জবাব দেয়ার প্রশ্ন। মুক্তি দেয়ার প্রশ্ন। এটা নারী শক্তিকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করার প্রশ্ন। যে নারীকে এতোকাল ধরে দমিয়ে রাখা হয়েছে এটই তাঁর জায়গা পুনরুদ্ধার ও প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন। তাঁর মর্যাদাকে ধর্মতন্ত্রের হাতে ভুলুন্ঠিত থেকে আমাদের রক্ষা করা দরকার।
নারী শক্তির বোঝা দরকার এখানে কোন ভাস্কর্য অপসারণ চলছে না, বরং আমাদের সেই পাঁজরে জন্ম নেয়া নারীকেই পক্ষান্তরে শৃঙ্খলিত করা হচ্ছে। তাঁদের এই চিন্তা সমাজের বদ্ধমূল কাঠামো থেকেই এসেছে। এই কাঠামোর জবাব দেয়া উচিত বিপ্লবাত্মকভাবেই। এখানে কোনো ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। এটা হলো সেই সময়, যখন নারীকে সত্যিকারের স্বাধীনতা ও মর্যাদার জন্য লড়ে যেতে হবে। পাঁজরের হাড় থেকে নারীকে জন্ম দেবার অলৌকিকত্ব ও পুরুষতান্ত্রিক মহিমা থেকে বিচ্যুত করে প্রাকৃতিক নির্বাচনকে প্রতিষ্ঠা করার প্রশ্ন। একইভাবে নিজেদের শক্তিকে নির্বাচিত করার প্রশ্ন যে, ভাস্কর্য আর কোথাও যাবে না, এটি সুপ্রীম কোর্টেই থাকবে। যার হাতের ন্যায়দণ্ডেই আজকে বিচার হবে নারীর বিরুদ্ধে পুরুষতন্ত্র আর পিতৃতন্ত্রের দীর্ঘ অবিচারের।