বড় কষ্ট থেকে কথাগুলো বলছি …

রোকেয়া সামিয়া:

একাত্তর সালে পাকিস্তানি সৈন্যদের বাঙালী মেয়েদের ধর্ষণের অন্যতম এক কারণ ছিলো, এই মেয়েগুলোর পেটে যেন খাঁটি মুসলমান জন্ম নেয়। সেই সময়টায় এই কালো কালো নাঙ্গাভুখা বাঙালীদের ‘মুসলমান’ মনে করা হতো না! তো, সেই পাকিস্তানীরা অনেকাংশেই সফল।

তবে সেটা অন্য দিক থেকে অবশ্যই। যাদের চিন্তাভাবনা পেছনের দিকে যাত্রা শুরু করে তাদেরকে আসলে কিছু বলার নেই। চট্টগ্রাম শহরে এমন নামকরা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলও আছে যেখানে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক।

ধর্ম আপনার নিজের ভেতর থেকে আসবে কি, আসবে না সেটা বড় কথা নয়, আপনি নিজে আপনার নিজ ধর্মবিশ্বাসের অনুষঙ্গ পালন করার সিদ্ধান্ত নেবেন কিনা তা নয়,  আপনার উপরেই একশ হাজার মানুষ আছে যারা আপনার ওপর তাদের চিন্তা চাপিয়ে দেবে এবং আপনি নিজের চিন্তাভাবনার পরিসর হারিয়ে তাদের মতো করেই ভাববেন।

আপনি যদি ভাবেন আপনার ধর্মরক্ষা হবে যদি কোন মেয়েকে আপনি হিজাব পরান (যে কেউ নিজে থেকে পরতেই পারেন- সেটার তার ব্যাপার। এখানে আরোপের ব্যাপারটা বলা হচ্ছে), কোন মেয়ে টিপ পরলে তার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ফেলবেন, কেউ পহেলা বৈশাখ পালন করলে তাকে ‘নাস্তিক’ খেতাব দিয়ে ফেলতে পারবেন, আবার আপনার ঘরেই হিন্দি সিরিয়াল চলবে, আবার আপনিই ঘুষ খাবেন, আবার আপনিই এদিকে তসবি জপবেন, আর এদিকে গীবত করবেন মুখে, আবার আপনিই আপনার কর্মক্ষেত্রে ফাঁকিবাজি করবেন–তবে হ্যাঁ, আপনার ধর্মরক্ষা নিয়ে আমার কেন, বোধ হয় কারোরই কিছু বলার নেই। আপনার ছেলেমেয়ে হিন্দুদের সাথে মিশবে না স্কুলে। প্রমিস!

পারশিয়ান নববর্ষ পালনের নাম নওরোজ। এতে অনেক কিছুই হয় যা সহি ‘ইসলাম সম্মত’ নয়। কিন্তু তারপরেও অনেক তথাকথিত ‘গোঁড়া’ ‘মুসলিম প্রধান’ দেশেও নওরোজ পালিত হয় সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই। আমাদের দেশে আমরা এখনো আমাদের ‘আইডেন্টিটি’ সঙ্কট থেকে বেরুতে পারলাম না। দুঃখটা এইখানেই। আমাদের পূর্বপুরুষেরা, আমাদের সত্যিকারের বুদ্ধিজীবীরা যাদের বড় অংশ এই দেশের জন্মলগ্নেই প্রাণ দিয়েছেন, আমাদের মায়েরা, আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা, আমাদের সত্যিকারের নেতারা যাদের আমরাই মেরে ফেলেছি তারা চরমভাবে ‘ব্যর্থ’।

নাহ, এতো কষ্টের, এতো ত্যাগের, একটা দেশের, এমন একটা দেশের জন্মের প্রয়োজন যেন সত্যিই ছিলো না!

পৃথিবীর ‘উন্নত’ দেশগুলো যাদের দেখলে আমরা হাহুতাশ করি আমাদের দেশ কেন এমন না, অমন না, সেই দেশের মানুষগুলো তাদের প্রতিদিনের চিন্তাভাবনা এতটা সংকীর্ণতার মধ্যে রাখে না। নিজেরা ধর্ম পালন করুক বা না করুক, অন্যেরটা নিয়েও এতো মাথাব্যথা নেই তাদের। নিজের কাজ নিজেরাই করে। রাস্তায় একবার থুথু ফেলতেও দশবার চিন্তা করবে তারা। আর আমরা এদিকে ওয়াজ শুনি, এদিকে রাস্তায় থুথু ফেলি, এদিকে আবর্জনাগুলো রাস্তায় ফেলি। এইদিকে ধর্মে কোনটা সহি কোনটা সহি না সেটা নিয়ে বাকতাল্লা করি, আর বিয়েতে মেয়েপক্ষ থেকে যৌতুক বা ‘গিফট’ নিতে আমাদের লজ্জা হয় না, আবার মন্তব্যও করি।

যে উন্নত দেশের কথা বলেন আর হা-হুতাশ করেন কেন আমরা তাদের মতো হতে পারি না, প্রশ্নটা আপনার কাছেই করুন না কেন? তারা আমাদের মতো কোন ঘরের মেয়ে মাথায় কাপড় দেয় না, গান গেলে গুনাহ হয়, এসবের বাইরেও বড় বড় অনেক চিন্তাভাবনা করে সেসবে সময় দেয়, কে কী করলো তাদের এতো মাথাব্যথা নেই। সেসব দেশেও অনেক সাধারণ মানুষ পাবেন যারা নিজেদের ঘর খুলে দিয়েছে সিরিয়ানদের জন্যে। তারা মুসলিম না কী, তা তারা দেখছে না, দেখছে ‘মানুষ’ হিসেবে।

আপনার কে মানুষ, কে না, সেটার হিসেব কষাকষির ধার ওরা ধর্ম দিয়ে বিচার করে না, আর আপনি কোন অধিকারে হা-হুতাশ করেন আমাদের দেশ কেন ওদের মতো না? আপনিই আপনার দেশ। আপনার চিন্তাভাবনা যা- আপনার দেশ, আপনার নেতাও তেমনি হবে। মেনে নিন সত্যটা।

মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের দেশটা টাকাপয়সায় সামনে এগোচ্ছে একটা বিরাট ফাঁপা বেলুন নিয়ে, যে বেলুন শুধুই পেছনের দিকে যাত্রার ধ্বনি যার শিঙ্গা বাজাচ্ছেন আমাদেরই মাননীয় মানুষেরা। আর যে সংস্কৃতি কর্মীদের সামনে আসার কথা তারা আছেন নিজেদের মধ্যে বিভেদ নিয়ে, চুলোচুলি নিয়ে, তেলবাজি নিয়ে।

যাদের বিরুদ্ধে আপনারা, তারা কিন্তু ঠিকই ঐক্যবদ্ধ। তাদের থেকে কিছু শিখতে পারেন দয়া করে। আপনারা যারা এতো কথা বলছেন, অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে দয়া করে স্কুলে স্কুলে যান, গ্রামে গ্রামে যান, মানুষের সাথে কথা বলুন। কেন আপনার কবিতা তারা বোঝে না, তাই আপনার বিদ্রোহী কবিতা তাদের সত্যের পথে টানতে পারছে না, কেন আপনার গান তাদের টানছে না যাতে তারা প্রতিবাদ করতে শেখে, কেন আপনার নাচকে, আপনার নাটককে তারা ‘বেগানা’ বলছে। কেন?

এই প্রশ্নগুলো, তাদের মনমানসিকতা না বুঝলে এই মানুষগুলোর মানসিকতা এই কবিতা, গান, নাটক দিয়ে পালটানো যাবে না। তাদের স্টাডি করে, তাদের কাছেই যেয়ে, তাদের মতো করেই বুঝে নিয়ে সব অনুষ্ঠান করতে হবে বোধ করি। নাহলে এই সংস্কৃতি কর্মীদের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ গাঁজাখোর বা দূরের মানুষই ভাববে, তাদের নিজেদের সমতলে নামিয়ে আপন মানুষ ভাববে না। তাই গান করা হবে ‘হিন্দুয়ানি’, নাটক-গান-সিনেমা সব হবে খারাপ।

‘বাংলাদেশ’ নামক দেশটার জন্য খুব দুঃখ হয়। নিজের দেশ বলে নয় হয়তো। একটা দেশ কী অদ্ভুত স্বপ্ন নিয়ে জন্ম নিলো, অসংখ্য মানুষের হাসি কান্না রক্ত, তার কি এমন দশা হবার কথা ছিলো? এ দায়টা আমাদের প্রত্যেকের না?

আমি অনেকদিন পরে লিখলাম। আমার কিছু বলতে, লিখতে ভালো লাগে না এখন আর। এসবে কিছুই হচ্ছেনা। তার চাইতেও বড় কথা সব ফাঁপা আওয়াজ লাগে নিজের কাছেই। এই কথাগুলো লিখলাম। জানি একশ একটা মানুষ এরপরে বলতে পারে আমি নাস্তিক, দুঃখিত, আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, না রোজা রাখি, সেসবের হিসেবনিকেশ আপনার কাছে দিতে যাবো না।

কোনো ধর্ম, কোনো বিশ্বাসের বিরুদ্ধতা না। স্রেফ এইটুকুই বলতে চাই যে, আপনার যেটা ভালো লাগে না সেটা করবেন না। আপনার নববর্ষ ভালো না লাগলে আপনি পালন করবেন না। আকবরের প্রচলিত নববর্ষ কিভাবে ‘বাংলা সংস্কৃতি’র অংশ হয় তাও প্রশ্ন তুলতে পারেন। সাথে এ প্রশ্নও তুলুন কিভাবে অন্য দেশের জীবনাচরণগুলো, তাদের প্রথাও আমাদের হয়? প্রশ্নগুলো নিজেকে করুন।

একটুখানি, অন্তত একদিনের জন্যেও একটু চোখ মেলে দেখুন, বৈচিত্র্য কতো সুন্দর। যে ধর্মের জোরে এতো বলছেন, সেখানেও মানুষের মর্যাদা কোথায় কীভাবে রক্ষা করতে হয় তাও জানুন। কাউকে সবক দিচ্ছি না। শুধু এক কথায় বলতে চাই- জোর করে করা, আরোপিত কিছুই ভালো না। বলতে পারেন কেন বলছি তবে? কষ্ট থেকে। এক ধরনের ক্ষত থেকে। আমাদের অগোচরে, আমাদের প্রতিদিনের টুকরো টুকরো ভুল থেকে কতো বড় দানব জন্ম নিচ্ছে, সেটাই আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

বলতে কি পারবেন যে একদিন আপনার ঘর থেকেই আরেকজন ‘জঙ্গি’ বেরোবে না, যার জন্যে লোকের কাছে আপনি জন্মদাতা, জন্মদাত্রী হিসেবে মুখ দেখাতে পারবেন না??

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.