আমার বাঙালীয়ানায় আপনার জ্বলছে কেন?

আঁখি সিদ্দিকা:

হ্যাঁ, আমি কপালে টিপ পরি। আমি বাঙালি সংস্কৃতির সব অনুষ্ঠান পালন করি। আমাকে সব জায়গায় দেখা যায়, তো?আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনি। হ্যাঁ! রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার ঘরে অনুষ্ঠান হয়, আগেও হয়েছে। আমার ঠিকানা জানতে চাইলে আমার প্রতিবেশীরা বলে, আচছা ওই যে ওই মেয়েটা যে কপালে টিপ পরে, গান শোনে? হিন্দু মেয়েটা?

নাম জেনে চমকে যায়, তাদের তথাকথিত জানায় ভুল দেখে তারা অবাক হয়। তখন আমি আপত্তি করে উত্তর দেই না যে আমি মুসলমান। আমার উত্তর, আমি বাঙালি! সত্যিই আমি সবসময় ভালো থাকি। যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে চরম মমতায় আঁকড়ে ধরি। আঁকড়ে ধরি ওই সময়,ওই অবস্থার যতো ভালো দিক।

আমার ভালো থাকা, আনন্দে থাকা এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতা, সংস্কৃতির ওপর একশত ভাগ কি নির্ভর করে না? বর্তমান সময় তারুণ্যের, এই ভালো দিক মাথায় রেখে চলি। তরুণদের ভয় পাই না। বন্ধৃ মনে করি। কিন্তু মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, নানান বাদানুবাদে আমার সংস্কৃতি আমার ঐতিহ্য আমার জাতীয়তায় এভাবে কালি যে বা যারা লেপন করতে চাও, তা কি খুউব সহজ? পেরেছিলো কি চেষ্টা করে এর আগে? যেখানে তরুণ সমাজ এতোটা বৃহত্তর! দেশের পক্ষে, বাঙালিয়ানার পক্ষে, সংস্কৃতির পক্ষে কথা বললেই খারাপ লাগে? তোমাদের লোক লাগিয়ে তার পেছনে লেগেও ভয় দেখাতে পারো না? মুর্দাবাদে, মৌলবাদে সরকার প্রধানের স্বার্থ অথবা তার দলীয় স্বার্থ থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণের স্বার্থ নাই।

তোমরা সমমানের ডিগ্রী অর্জন করেছো, তাতে কী এসে গেলো বাংলা ভাষায় যে শিক্ষা অর্জন করেছে তার সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে তো? তুমি বা তোমরা পহেলা বৈশাখে ৫টায় ঘরে ঢুকতে বলার জন্য আবদার করেছো, কেন তোমাদের অন্ধকারে কন্ট্রোল চলে যায় নাকি? ভাস্কর্য কী ক্ষতি করে তোমাদের?

যাও আগে ইতিহাস পড়ো। পড়াশোনা করে এসে দাবি দাওয়া, বায়না-আবদার করো। মূর্তিতে সুড়সুড়ি লাগে? না ভয় লাগে? ধর্ম আর সংস্কৃতি বিরোধী নয়। প্রতিটি জায়গার আজকের অনুষ্ঠানে আযানের সময় অনুষ্ঠান বন্ধ ছিলো। হিন্দুত্ব বলো আর মুসলিম বলো, দেশটা কী ছিলো? একটা অখণ্ড ভূখণ্ড আর সেই অখণ্ডেরই একটা ঐতিহ্য এই পহেলা বৈশাখ!

১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।

আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন আপ্যায়ন করে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের উৎসব। আজকের বৈশাখ!

কী করে এটা হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি হলো? আপনার কেউ বুঝাইয়া কইতে পারেন? শুরু করলো তো একজন মুসলমান। তবে সে মুসলমান হিসেবে তো করে নাই, করছিলো বাঙালী হিসেবে।
সে কি আর জানতো আপনাদের ভবিষতে উদ্ভব হবে? আপনার ধর্মের নামে যন্ত তন্ত মন্ত করবেন? আজ যেটা হলো চারুকলায়, হিন্দুদের গরুর মাংস খাওয়ানো হলো, এটা কোথায় কোন ধর্মে লেখা আছে? সংস্কৃতি মানলে কী মনে হয় যে মানুষ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হবে না। ভয় করে আপনাদের? আর আপনার সেই সংস্কৃতি ছাড়া মনে যত রকমের কুপ্রবৃত্তি আছে তা হিজাবের আড়াল দিতে দিতে ক্ষমতায় আসবেন?

সেই বালিতে গুড় মিশিয়ে খান! এতো সোজা না সব কিছু! কই চারুকলার আর্টের ওপর কালি মাখিয়ে দিলেন তো? আবার একেঁছে ওরা। কতবার কতবার ঝামেলা করবেন আপনারা? ধর্মের নাম রূপ বদলানো ছাড়েন, একবার জামাত! একবার জঙ্গি। একবার হেফাজত! একবার খেলাফত! সমস্যা কী আপনাদের? চান কী? ইসলামি শাসন? ইসলামে এসব ফাইজলামি কোথাও নাই। ভালো না লাগলে পাকিস্তানের দরজা তো আপনাদের জন্য খোলা আছে, যান ভাই! অথবা আফগানিস্তান! অথবা জান্নাতুল মাওয়া! আগে বাঙালী, তারপর মুসলমান! বাংলাদেশে এসব চলবে না। এ দেশ আমার! আমি বাঙালী।

আরও চুপ করে হেফাজতের এই হেফাজতি দেখার দিন আছে বলে মনে হয়?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.