বলতে না পারা অব্যয়

আঁখি সিদ্দিকা:

‘পাত্রী বেশে যে মেয়েটি আপনার সামনে বসে
সেই মেয়েটি ভেতরে কেবল দুর্বলতাই পোষে’…..!
আর আপনি???………!

প্রথমে আমার পুরুষ বন্ধুদের বলছি, একটা দৃশ্যকল্প কল্পনা করুন তো!

আপনি অফিস থেকে ফিরেছেন। কিছুক্ষণ আগে। আগের দিন মা বলে দিয়েছে, তাড়াতাড়ি ফিরিস, তোকে দেখতে আসবে। অফিস থেকে ফেরার পথে কলিগ ও বন্ধুদের বললেন বাসায় আসতে, আপনাকে মেয়ে ও মেয়ের আত্মীয়-স্বজন দেখতে আসবে। আপনি বাসায় ফিরে ভালো করে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে মেকাপ করতে বসলেন। আপনার বন্ধুরা ও কলিগরা সাহায্যও করলো। মা এর মধ্যে এসে বলে গেলেন, বাবা শরবতটা কিন্তু তোকে বানাতে হবে, বউমা ও তার মা তোর হাতের বানানো শরবত খাবে, জানিয়েছে। আপনি আলতো করে সেজে উঠে শরবত বানালেন, ইচ্ছে করে আপনার যিনি স্ত্রী হবেন, তার শরবতটায় একটু দুষ্টুমি করে মরিচের গুড়া দিয়ে শরবত বানালেন।

যথাসময়ে ওরা এসে গেলো। আপনি সেজেগুজে রুমে বসে ঘামছেন, ফ্যান চলছে শীতকাল তবুও। অন্দরমহলে ডাক পড়লো। সেঁজুতি ভাবীর দায়িত্ব পড়লো আপনাকে সাথে করে নিয়ে যাওয়ার, আপনার বন্ধুরা, কলিগরা পর্দার আড়াল থেকে দেখছে আপনার হবু স্ত্রী কতোটা সুন্দর, স্মার্ট! আপনাকে ইশারায় আঙ্গুল দিয়ে ভি সাইনও দেখাচ্ছে। আর আপনি লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে গুটিসুটি মেরে যাচ্ছেন।

আপনার শ্বশুর বলছে, লজ্জা কীসের বাবা। আমার মেয়ে তোমায় তেমন বেশি কিছু জানতে চাইবে না, ও এবার বিদেশ থেকে পড়া শেষ করে এলো তো! দেশী ছেলেই বিয়ে করবে, তাই ছুটি নিয়ে তিন মাসের জন্য এসেছে। তুমি বাবা ৫ নম্বর । এর মধ্যে চারজনকে দেখেছে। বোঝোই তো ! বিদেশে থেকে রুচিটা একটু পাল্টেছে! তখন আপনার ঘাম আরও বাড়ছে, দোয়া পড়ছেন মনে মেনে মরিচের শরবতের গ্লাসটা যেন তার হাতে না পড়ে! ইসস, দুষ্টুমি ঠিক হয়নি!আগে বলবে তো ৫ নম্বর সে।

এরপর শুরু হলো, প্রশ্নের ঝড়! আপনি তথৈবচ! এ মেয়ে তো কথায় কথায় ইংরেজী বলছে। সামান্য ব্যাংকার আপনি, এতো কি ফটফট উত্তর দেয়া যায়? একি গান গাইতেও বলছে, গলায় তখন আর সুর বের হচ্ছে না। যদিও রবীন্দ্রসঙ্গীতে কিন্তু আপনি প্রথম হয়েছিলেন। আহারে সেই গানটি ওই যে ওই গানটা বসন্ত উৎসবে গেয়েছিলেন, ভেতর থেকে আপনার বন্ধু শাহরিয়ার মনে করিয়ে দিচ্ছে, ওরে গৃহবাসী, হ্যাঁ হ্যাঁ ওরে গৃহবাসী দ্বার খোল, দ্বার খোল ! আপনার মনে হচ্ছে বাইরের দরজা খুলে দিক, ওরা চলে যাক বা আপনি দৌড় দিয়ে ঘরে ঢুকে বালিশে মুখে গুঁজে একটু জিরিয়ে নেন। যেমন মেয়ে তেমন মা, তেমন তার ভাই! আপনাকে হাঁটালো, বসালো! পিঠের চওড়া কতটুকু মাপ নিলো! এসব কী!  

লজ্জাও নেই, মেয়ে ওই ঘরে ডেকে নিয়ে বললো, কি অভ্যাস আছে তো? আল্লাই জানে কিসের অভ্যাস , জানতে চাইলো? আপনার মতো ভালো ছেলে এই এলাকায় একটাও আছে নাকি? জানতে চাক না রহমত, গৌতম, লাবু কাকুর দোকানে। আপনি গান মনে করতে পারেননি, মেয়ের কাকার অনুরোধে সুরা হাশরের তিন আয়াত পড়ে শোনাতে পারেনি, মেয়ের ভাবি দই বড়া কীভাবে বানায়, উত্তর দিতে গিয়ে গলা আটকে গিয়েছিলো, বার বার ঢোক গিলেছিলেন, এইসব অপরাধে আপনার বাবা-বোন, এমনকি সেঁজুতি ভাবী, বন্ধুরা, কলিগরা আপনাকে ছি: ছি: করতে লাগলো। এমন মেয়ে আর পাওয়া যাবে? ওরা যদি এখন না করে দ্যায়? ইসস এক মাস পরেই আপনি লন্ডন থাকতে পারেন, মাত্র এই কটা প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দিতে পারলে আপনার ভবিষত ত্বরান্বিত হতো। আহা! এতো কষ্ট করে পড়ালো, চাকরি করলেন কর্পোরেট বাজারে। এটা কিছু হলো? ওরা যদি ভালোয় ভালো হ্যাঁ বলে তো পুত্রদায়গ্রস্ত পিতা ঠিকঠাক ঘুমাতে পারবে।

প্লিজ এই দৃশ্যকল্পের ধারক ও বাহক হয়ে উঠুন না দয়া করে। কেমন লাগছে?

আমরা এখন আধুনিক। অন্তত দাবি করি। এই সময়ে আমরা বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে যাবার মতো নেতিবাচক সংস্কৃতি ধরে রেখেছি। আমি এবার নারী বন্ধুদের বলতে চাই, তারা কি তাদের মেয়েবেলার কথা একবার ভাবেন না, যখন আপনার ভাই, আপনার ছেলে, আপনার কাকা, আপনার মামা, আপনার বন্ধুর জন্য পাত্রীবেশে দেখতে যান। সে আলগোছে এসে আপনার সামনে যখন বসে তখন মনে পড়ে যায় না, আপনাকে দেখতে আসার দিনটি? অথবা কল্পনায় দেখতে পান না, ওভাবে কতগুলো মানুষ আপনাকে দেখছে?

ইসস! একটা মেয়ের একটা শাড়ী দরকার হলে সে একা অথবা মা, বন্ধু বা বোন কে নিয়ে কিনতে যায়, আজকাল একা শপিং করার প্রবণতাই বেশি। অনেকগুলো শাড়ী নামিয়ে দেয়, দোকানদার গ্রাহক বোনটিই তখন বিরক্ত হয়ে আর নামাবেন না? অনেক একসাথে দেখলে পছন্দ করা যায় না, অনেকগুলো শাড়ি দল বেঁধে আপনার সামনে হাজির হয়, আর একটি মেয়েকে দেখতে অনেকগুলো মানুষ দল বেঁধে মেয়েটির সামনে হাজির হয়। তার এতোদিনের অর্জিত শিক্ষা-সংস্কৃতি, মা-বাবার পরিবারের ঐতিহ্য, খাবার –দাবার , রান্না-রুচি সব বিচার করেত!!!

মাত্র একঘন্টা ২৫/২৬ বছরের একটা জীবন মেপে ফেলে দর্শনার্থীরা? আহ! প্লিজ নারী বন্ধুটি আমার, এবার আপনি থামুন। আপনার চারপাশকে এই বানোয়াট, নেতিবাচ , হীন সংস্কৃতি থেকে বের করে আনুন, আপনি একাই সেই পথে না গিয়ে, অথবা আপনার বোনটিকে, আপনার বন্ধুটিকে সর্তক করুন কারও সামনে এভাবে পণ্যের চাইতেও নিৎকৃষ্ট হয়ে না বসতে !!

ওই মেয়ে পরিবারের কাকু, মামা, খালাম্মা, কাকীদের বলছি। অনেক যত্নে গড়া , অনেক আদরের মেয়েটি এভাবে বিয়ের বাজারে তুলবেন না। আপনার ছেলেটি আর মেয়েটিকে আপনি পরম মমতায় লালন করেছেন। আপনি প্লিজ তার ব্যক্তিত্বটি গড়ে তুলুন। আমি অনুরোধ করছি, উপদেশ নয়। আপনি ছেলের মা বা বাবা হয়ে বা ভাই-বোন হয়ে যেমন গেলে একটি মেয়ে ওই পণ্যের সামিল হয়, তেমনি আপনার মেয়েটিও পণ্য হয়ে ওঠে। আমরা মাছ টিপে টিপে কিনি, আমরা সবজি সবুজ কিনা, পচন লেগেছে কিনা দেখে কিনি, আমরা কাপড় টেকসই কিনা বুঝে কিনি! এভাবে আপনার মেয়ে কিনতে বা বেচতে যাবেন না।

আমি নিজেই দেখেছি পার্লারে মেয়েকে সাজাতে এসে মা বার বার নির্দেশনা দিচ্ছেন, এভাবে না এভাবে চুলটা, মেকাপটা ঠিক করুন, সেদিন কোন এক ডাক্তার ছেলে তার মেয়েকে দেখতে আসবে, তিনি গর্ব করেও বলছেন। মেয়েটি ইডেনে অর্থনীতিতে পড়ে। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমার করুনায়, কষ্টে গলায় নিশ্বাস আটকে আসছিলো। মেয়েটি শিক্ষিত হয়ে উঠছে অন্যের জন্য, সুন্দরী হয়ে উঠছে অন্য কারও জন্য। দুর্ভাগ্য তার একটি ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠেনি, যে সে প্রতিবাদ করবে, সে কোন ডাক্তাররের সামনে সঙ সেজে বসবে না।

অভিভাবকেরা কেবল একটি ভালো বিয়ের জন্য মেয়েকে তৈরি করে, যোগ্য করে! এতে মেয়েটির আদপে ক্ষতিই সে করে। অভিভাবকেরা এতোটাই নির্বিশেষে এমনটি তৈরিতে মনোযোগী থাকে সে ছেলে বা মেয়ের বেলায় হোক, হয়তো ছেলেটি বা মেয়েটি বিয়েই করবে না, নিজের মতো একটা জীবন কাটাবে। না! কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না, বিয়ে তার লক্ষ্য, ভবিতব্য! একটা ছেলে বা মেয়ে বিয়ে দিয়ে, নাতিপুতির মুখ দেখে যেতে পারার ইচ্ছেই তাদের শেষ ইচ্ছে হয়ে ওঠে। অথবা তাদের নিজস্ব কোনো পছন্দ থাকতে পারে, তারা হয়তো পরে বিয়ে করবে, অথবা করবে না, ভালোলাগা নিয়ে হয়তো এ সঙ্গে থাকবে, বা নাও থাকতে পারে।

অভিভাবক তাদের ঢাল তলোয়ার-যতো ইমোশোনাল ব্লাকমেইল আছে করতে থাকেন, তাদের শেষ বয়স, তাদের অসুস্থতা, তাদের পুরন না হওয়া যতো স্বপ্ন চাপিয়ে দিতে থাকেন, একবারও সন্তানের ইচ্ছে-অনিচ্ছে, এমনকি তার শারিরীক কোন অসুবিধা আছে কিনা, বিয়ে করতে তার শরীর আদৌ প্রস্তুত কিনা সে ভেবে পর্যন্ত দেখেন না। বাবা-মায়ের বিয়ে দেবার অত্যাচারিত বাসনায় অনেক সমকামীদের বন্ধুদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।একটু সন্তানের দিকে তাকান, সে কি চায় বুঝতে চেষ্টা করে দেখুন না একবার! মাত্র একবার! অনেক হয়েছে । এবার থামুন। একটু বুঝতে চেষ্টা করুন।

মেয়েদের দেখা তো আজকাল ক্যাম্পাসে, হাটে, মাঠে , ঘাটে, বাজারে , অফিসে , হাসপাতালে , শহরে, বিমানে, নৌকায় , বাসে , ট্রেনে সবখানে মেলে, তারপরেও ঘটা করে আপনাদের মাছ কেনার মতো টিপে টিপে মেয়ে দেখতে ইচ্ছে করে! আবার অনেকে খেতে যায়! ছি! নিজে যায়, বন্ধুদের নিয়ে যায় ! এ যেন মেলায় পুতুল নাচ দেখতে যাওয়া! মুড়ি মুড়কির সাথে পুতুলনাচ দেখে আসা। নতুন আরেক পদ্ধতি রেস্টুরেন্টে পাত্রী দেখতে যাওয়া। সেখানেও ওই একই দৃশ্য! একটু অন্যরকম আরকি! বিষয় এক। ঘুইর‍্যা শোয়, ফি্ইর‍্যা শোয়, পৈতানে দুই পাও!

বিয়ের পাত্রী মানে মেয়ে দেখতে ঘটা করে যাবেন না, কাউকে উৎসাহ দেবেন না। হ্যাঁ, প্রশ্ন থেকে যায়, আমি বলতে কে? আমি এখন এফবিতে ১৯৯১ জনের একজন বন্ধু! আমার বন্ধু হয়ে আপনার এই অন্যায় কাজে উৎসাহ দিলে অন্যায় সহ্য করার জন্য যে আমিও সমঅপরাধে যুক্ত হই। আমি একজন মানুষ হয়ে, একজন বন্ধু হয়ে নারীর জন্য এই সম্মানটুকু আপনাদের কাছে অনুরোধ করে চাইছি।

মেয়েরাই পারে তার এ সম্মানটুকু বাঁচাতে। রক্ষা করতে। আমার অধিকার অন্য কেউ এনে দেবে না। এটা আমার । কেউ দেবারও নেই। কেউ নেবারও নেই। এ সম্মান বোন, তোমার প্রাপ্য, কেবল তোমারই। কারও সামনে ওভাবে বসে নিজেকে দুর্বল করো না! তুমি সত্যিই দুর্বল নও! বিশ্বাস করো, তুমি যোগ্য! অসম্ভব মনের জোর তোমার। তোমার জন্য তোমাকে তৈরি করো। তোমার জীবনসঙ্গী তোমার পাশে দাঁড়াবে, সামনে বসে তোমাকে খুঁটিয়ে দেখার দিন আর হতে দিও না। এ আমার অনুরোধ।

রাত ১২.৩৮
০৯.০৪.২০১৭

শেয়ার করুন: