বিষণ্ণতা কি অসুস্থতা?

সীমা কুণ্ডু:

আমার মতে, বিষণ্ণতা অসুস্থতা নয়, মানসিক অন্যসব কার্যক্রমের মতোই এটা একটা বিক্রিয়া। ভালোলাগা ভালোবাসা প্রেম মায়া মমতা রাগ অনুরাগ এসব যেমন, বিষন্নতাও ঠিক তেমন। অন্য আবেগগুলো যেমন অন্য মনের সাহচর্য চায়, মনোযোগ চায়, স্পর্শ চায়, বিষণ্ণতাও ঠিক তাই চায়। তার চাওয়া আলাদা কিছু নয়। সে তার থাবা নামিয়ে নেয়, চাপ নামিয়ে নেয় একটু মমতার স্পর্শে।

কেউ যদি বলে আমি কখনো বিষন্ন হই না, বিষণ্ণতা আমাকে স্পর্শ করে না, আমি বলবো হয় সে ভুল বলে, নয় সে বিষণ্ণতাকে চিনে না। এমন কেউ নেই যে এ নদী সাঁতার ছাড়া পার হয়। মানুষের জীবনে বিষণ্ণতা এগিয়ে যাবার, নিজেকে প্রমাণ করার, নিজেকে উত্তীর্ণ করার একটা ধাপ। যারা নিজের মনোবল ঠিক রেখে এ সময়ের সাথে যুঝতে পারে তারাই ঝাণ্ডা উঁচিয়ে বলতে পারে আমি বিজয়ী। তখন এমন কোন মানসিক বিক্রিয়া নেই তাদের পেছনে টেনে রাখে। হ্যাঁ অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছে এই ছোবলে ঠিক, আর এখানেই মমতার হাত বাড়ানো দরকার। সেটা পরিবার-পরিজন, বন্ধু, সহকর্মী যেই হোক না কেন। একাকিত্ব বিষণ্ণতার অন্যতম কারণ, স্বাভাবিকভাবেই অন্যর মনোযোগ মানুষের চির আকাঙ্ক্ষার, এটা করুণা নয়, মানবিক দেয়া-নেয়া।  

প্রতিদিনকার সম্পর্কগুলি নিত্যকার অভ্যস্ততায় চলে, কীভাবে চলে, কেন চলে, কোথায় থামে কোথায় হোঁচট খায় এসবের খবর রাখার সময় এবং প্রয়োজন জরুরী হলেও আমরা কতজনই বা এসবের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল, কতজনই বা এসবে হাত রাখি? পরস্পরে অনুভূতি দানা বাঁধেনি এমন সম্পর্কও চোখ মুছেমুছে নিত্যকার অভ্যস্ততায় চলে দানাদার অনুভবের আশায়। দিন গুনে গুনে দিন শেষ হয়, অনুভূতিরা টলমলে থেকে থেকে চোখের কোণে গড়িয়ে যায় বেশির ভাগেরই। দানা বাঁধা আর হয় না। এভাবেই কত অদানাদার সম্পর্ক টিকে আছে, টিকিয়ে রাখছে, হিসাবে বিশাল! এর কতটুকুই বা প্রকাশ পায়, প্রকাশ পেলেও গুরুত্ব পায় কি?

যার জন্যে এতো আকুলতা, এত ভাঙাগড়া, এত মনঃক্ষুণ্ণতা, এত হা-পিত্যেশ! কেন গড়ি,  কেন ভাঙি এসবের উত্তরহীন এই মানসিক প্রক্রিয়াই আমাদের ডুবায় ভাসায়, হাসায় কাঁদায়। কী অদ্ভুত এই শব্দশক্তি যার কাছে নতজানু হতেই একটা সম্পর্ক ভেঙে নতুন সম্পর্ক গড়ি! এও জানার বোঝার বাইরে। এসবকে অতিক্রম করার সময়টুকুই বিষণ্ণতা এসে জেঁকে বসে মনের উপর।

ভালোবাসা হোক আর বিষণ্ণতাই হোক সকলেই কিছু অধিকার চায়, অধিকারহীন অনুভূতিরা কষ্টের দুয়ারে চিরবেলা প্রবেশাধিকারহীন প্রহরী। তারা কেবল চোখের কোণে টলমলে অনিঃশেষ বিন্দু, বুকের গভীরে সে অনুভব মাত্র।

কর্মজীবীদের দিনের বেশির ভাগ সময় পরিবারের বাইরে কাটে, সারাদিন অনাত্মীয় সংসর্গে, তবে এখানেই গড়ে ওঠে আত্মীয়তার পরিবেশে। জীবিকা উদ্দেশ্য হলেও এখানেই কিছু কিছু মানুষের সাথে গড়ে ওঠে আত্মীয়তারও বেশি কিছু। পরস্পর পরস্পরের সুখে দুঃখে কাঁধে হাত রাখা একটা সম্পর্ক বড় প্রয়োজন। ভাব-ভাবনা, ভালোলাগা, ভালোবাসা, রাগ-অনুরাগ, মান-অভিমান, এমনকি নিজস্বতা বিনিময়েও হাত বাড়ানোর একটা জায়গা মানুষের খুব আপন হয়ে ওঠে। অথচ এদের সাথে রক্তের কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই, কিন্তু মনের কাছে টেনে নিতে কারো কোন আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। এসব কেবল স্বার্থে করি বা করে এ আমি বিশ্বাস করি না করতে চাইও না।

কিছু অবিশ্বস্ততা থাকবেই, যেমন সর্বত্র আছে। পাঁকে পদ্ম‘র জন্ম। পাঁক বাদ দিয়ে পদ্ম’র সৌন্দর্য ও সুবাস জীবনকে মোহিত করে তুলতে পারে। এসবের নামও সম্পর্ক। স্বার্থেই সম্পর্কের জন্ম। স্বার্থহীন হলে কি সম্পর্ক জন্মায়? না। এই আমরাই চাই ভালো থাকুক প্রিয়জনেরা, বন্ধুরা, পরিচিত জনেরা, এটা নিজেদের স্বার্থেই চাই। তারা ভালো থাকলে নিজেরাও ভালো থাকি।

আমিও খেয়াল করি, মাঝে মাঝে খুব বিষণ্ণ হই, কারণ হাতড়ে বেশিদূর যেতে হয় না, আশপাশেই কারণ খুঁজে পাই। ঘরে, বাইরে, কর্মক্ষেত্রে কিংবা পারস্পরিক প্রতিটা বোঝা-পরাতেই এসবের আকছার কারণ মিলে। কিছু কিছু দিন বিষন্নতার  ঝাঁপি নিয়ে আসে। ডালাটা খুলে দিলেই শুরু হয়ে যায় কিলবিল সাপের খেলা। নিজেকে তখন খুব অস্থির লাগে। কী করি, কী করি, কেন, কেন শব্দগুলো মাথায় দ্রিম দ্রিম বাজতে থাকে।

ইদানীং বেশ একটা সমাধান খুঁজে পেয়েছি। যখন এমন লাগে, নিজেকে একা অসহায়, তখন আমি কেনাকাটা করি। এ’দোকান ও’দোকান ঘুরে ঘুরে পকেটের টাকার সাথে একটু একটু বিষণ্ণতা নতুন জিনিসের ঘ্রাণের বিনিময়ে বিলিয়ে দেই।

আসলে সময় এবং সঙ্গ মানুষকে বদলেদেয়। একসময় যাতে বিষণ্ণ হতাম, অন্য সময় দেখি সেই একই কারণ মন খারাপও করে না। মূলত এমন কিছু্র সাথে, এমন কারো সাথে যদি এসব ভাগাভাগি করতে পারি বিষণ্ণতা কাটতে সময় লাগেনা। জীবন হয়ে ওঠে জীবনময়।

যখন মন খারাপ হয়, নিজেকে একা লাগে বিষণ্ণ লাগে, রিকশায় ঘুরি। রিকশায় ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যার বাতাস, গাছেদের নিশ্চলতা, কারো ঘরে ফেরা, কারো বাইরে আসা, আলোকিত পথঘাট, মানুষের চলাচল, দোকানপাটের আলো নিভে আসা, ফুটপাতে রাত্রির আয়োজন, ডাস্টবিনের ধারে পথকুকুরের চেঁচামেচি, সবজি দোকানগুলির উচ্ছিষ্ট, হাসপাতালের চলমান হাসিকান্না, লাইটপোস্টের একাকিত্ব, ফুল-দোকানের সুবাস হারানোর ভিড়েও তোমাকে ভালোলাগা কোন স্মৃতি মনে করাটাই লোভনীয়।  এসবের ভিড়ে বিষণ্ণ মন কোথাও না কোথাও আশ্রয় খুঁজে নেয়। আমি মনে মনে ভালোলাগা কোন কিছু কোন স্মৃতি, কোন মানুষকে পাশে রাখি। হুড ফেলেই বসি কারণ, হুড তুলতে গেলেই ঘাড় হেট করতে হয়।  

এই সময়ে হেটমাথা কে চায়? বিষণ্ণতা তুমি হুড ঢেকে চলো, আমি মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখি।  

শেয়ার করুন: