লুকানো ডায়েরি থেকে- ১৬

চেনা অপরিচিতা:

কষ্ট যন্ত্রণায় একটু বিরতির দরকার হয়, মানুষ পাগল হয়ে যায় নইলে। কিন্তু আমার ভাগ্য এমন যে চরম কষ্টের মুহূর্তে কাটা ঘায়ে বিষাক্ত সাপের কিলবিলে উপস্থিতি আমাকে অসহ্য ক্রোধে অস্থির করে ঠিকই, কিন্তু আমি একই সাথে বেদনার্ত হই। আমার একবিন্দু শক্তি নেই। আমি লুকাই। কিন্তু আমার অতীতের কালো ছায়া নির্লজ্জ দুঃসাহসে আমার সামনে দাঁড়াতে চায় বারবার।

আম্মাকে সবাই  বারডেমের হিমাগারে রাখার জন্য সেখানে রওনা হয়। আমার ভাই বিদেশে। তাকে কন্টাক্ট করলেও সে রিপ্লাই দিচ্ছিল না। একটা অনিশ্চয়তা সামনে রেখে হিমাগারে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। আমি আমার স্বামীকেও সেখানে আসতে বলি। তার কাছে এই সংবাদ অপ্রত্যাশিত ছিল। সে আমাকে সেখানে সামলে রাখে। আমার বাবার সব আত্মীয় সেখানে জমায়েত হয়। আর আসে সেই পেডোফাইল।

আচ্ছা, আমি বরং সেই লোকটার নাম বলে দেই। আমি ডাকতাম, সুজা মামা। পাথরের চর, জামালপুর বাড়ি। সেই লোকটাকে দেখে ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে আমার। আমি ভেবেছিলাম, লোকটার এতো বছর পর লজ্জা হবে আমার সামনে আসতে। কিন্তু লজ্জা তো নেই-ই, উল্টো আমি কেন এড়িয়ে যাচ্ছি সেই প্রশ্ন তুলছে গলা চড়িয়ে।

অসহ্য যন্ত্রণায়, ক্রোধে আমার স্বামীকে শুধু ঐ লোকটাকে দেখিয়ে  গালিগালাজ করছিলাম। আমার স্বামী সারা সময় আমার বাবার পাশে বসে ছিল। সবার আগে সেই বলছিল, আমার বাবাকে কিছু খাওয়াতে, কারণ তার অবস্থা ভালো ছিল না। কিন্তু আমার বাবার আস্থা ভাজন হলো কে, বলুন তো? সুজা মামা। আমার বাবা তাকে অসহায়ের মতো আঁকড়ে ধরলেন। উনিও ঘোষণা দিলেন, আমার মাকে উনি কবরে নামাবেন। কেন এসব দেখতে হলো আমাকে? ঠিক কতখানি অন্যায় করেছিলাম আমি!

অবশ্য পরে আমি দৃঢ়ভাবে আমার বাবাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, ওই লোক যাতে আমার মাকে স্পর্শ না করে। আমার বাবা কেন যেন কোন প্রশ্ন করেননি।

শুনেছি ওই লোকটার মেয়ে আছে। ওর মেয়েকেও কি আমার মতো ‘আদর’ করতো ছোট থাকতে? নাকি ওর মেয়ে কিছুই জানে না, ওর বাবা কেমন। এতো বছর পর সে জেনেই বা কী করবে! আমার পৃথিবী তো অনেক আগেই এলোমেলো হয়ে গেছে।

থাক সে কথা। আম্মাকে গোসল করাচ্ছিল সেখানকার আয়া, বড় নির্দয় ভাবে। আমার খালা সেটা দেখে গোসল করাতে যান। সে সময় যা যা করণীয় সব আমার খালা, খালু, আমি আর আমার স্বামী করি। আমার বাবা কার্যত অসহায় হয়ে বসেছিলেন। আর সবাই এসেছিল মূলত শোক জানাতে।

ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় যে একটা বিরাট যন্ত্রণা তখন জানতে পারলাম। আমি, আমার স্বামী আর খালা মিলে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তা পেলাম। সেই যন্ত্রণা আর বিরক্তিকর ঘটনায় আর যেতে চাচ্ছি না।

তখন আমি কেবল কাতরাচ্ছি, আর এক বিন্দু মানসিক জোর অবশিষ্ট নেই। আমারও একটা নির্ভেজাল মমতায় আর্দ্র  কোল প্রয়োজন। আমার বাচ্চা আমার স্বামীর এক আত্মীয়ের বাসায়। আমার শিশুটির জন্য হলেও একটু মানসিক স্থিরতা প্রয়োজন। আমি আমার খালার বাসায় যাওয়া স্থির করলাম। মা নেই, মায়ের অংশ খালার কাছে একটু হলেও মা মা গন্ধ পাবো। আমার কষ্ট তার চেয়ে আর কে বেশি বুঝবে? পথ আটকালো আমার এক দুলাভাই আর পাড়াতো ভাই। তাদের বক্তব্য আমি এই মুহূর্তে আমার বাবাকে ছেড়ে যেতে পারি না। আমার আর কোনো ধৈর্য নেই, আর বিনয় দেখানোর ন্যাকামোও সম্ভব না। এক, আমার আর কেউ নেই, দুই, সেই দুলাভাই নানাভাবে আমাকে অনলাইনে সে যে আমাকে চায় সে কথা জানাতো। শালী-দুলাভাইয়ের সম্পর্ক প্রেম প্রেম ঠাট্টা হতে পারে, কিন্তু যেদিন “চু*ই টাইম” নামে ইরোটিক একটি ফেসবুক পেজে লাইক দেওয়ার রিকোয়েস্ট পাঠায়, সেদিন আনফ্রেন্ড করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।

হয়তো আমি আমার বোনকে বলতে পারতাম, কিন্তু তাতে সে আঘাত পেত, অপমানিত হতো। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে বিয়ের কারণে সে অনেক সয়েছে, আর এখন তার তিনটি সন্তান। তাই আমি কিছু বলিনি।  আমি তাদের বললাম যে, কেন আমি বাসায় যাবো? আমার বাবার সাথে তো ক্লাস নাইনের পর থেকে কোনো মানসিক যোগাযোগই নাই। আর তারা কী চায়, আমি পাগল হয়ে যাই? বাসায় আম্মার সব ছবি, ব্যবহারী জিনিস, আর পুরা সংসারটাই তো আম্মা সাজিয়েছে। সেখানে সে নেই…আমি কীভাবে সহ্য করবো!”

ওরা বুঝছে না তাও। সবাই ভাবছে আমি মেয়ে হয়ে কীভাবে বৃদ্ধ বাবাকে রেখে চলে যাচ্ছি। তারা আশা করছে আমি তার কাছে থাকি। ওরা বুঝছে না আমার নিজেরই এখন মমতাময় কাউকে দরকার, যে আমাকে সহমর্মিতার চোখেই দেখবে, যার কথায় দৃষ্টিতে আমার দিকে অভিযোগ অভিসম্পাত ঘৃণা ছুটে আসবে না। ওদের আফসোস ফোটা চোখ পেছনে ফেলে আমি খালার গাড়িতে উঠি।  

(চলবে…)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.