সাপ ও যৌননিপীড়ক একই রকম ঘেন্নার

সুচিত্রা সরকার:

জীবনে প্রথম সাপের অস্তিত্ব সাত বছর বয়সে। সাপের কামড় খেয়ে নিখিল মামা, সারা দুপুর, সারা বিকেল অবশ হয়ে রইল। কী যন্ত্রণা! সকলের চোখের- মুখের ভয়ার্ত চাহনি আমাকে শিখিয়ে দিল, সাপকে ভয় পেতে হয়!

বিজন মামার মাছ ধরার জালে একটা সাপ আটকেছিল। সেই প্রথম কাছ থেকে দেখা ওই অদ্ভুত প্রাণীটাকে। শরীরটাকে দুমড়ে- মুচড়ে ভয় দেখানোর পায়তারা! ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীটার প্রতি জন্ম নিল ঘেন্না।

সুচিত্রা সরকার

চিড়িয়াখানার খাঁচায়, গ্রামের নিস্তব্ধ দুপুরে মেঠো পথে, শান্ত বিকেলে পুকুরের এপাড় থেকে ওপাড়ে সাঁতরে বেড়ানো সাপ বহুবার দেখেছি। ঢাকার রাস্তায় বেদেরা সবুজ বা হলুদ রঙের সাপ হাতে নিয়ে চাঁদা তোলে। কতবার ওদের হাতের সাপ, আমার অন্তর-মনকে অবশ করেছে, ইয়ত্তা নেই।

টিভির পর্দায় সাপ দেখলেও আমার অস্বস্তি হয়! মনে হয়, এই তো আমার আশপাশেই হয়তো আছে। কিলবিল করে আমার দিকেই আসছে। আর ‘সেই সাপ জ্যান্ত, গোটা দুই আনতো, যে সাপের কান, নাক, মুখ, বিষ নেই- এমন সাপ আর মিলবে কই!

তাই সাপে আমার চিরকাল অস্বস্তি! অদ্ভুত আকার, দেহের গড়ন, রং, নকশা, বেহুলার মিথ- এ সবকিছু মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে এই যে, সাপের চেয়ে বড় ঘেন্নার প্রাণী আর কিছু নেই আমার জীবনে!

ঠিক এইরকম ঘেন্না আমার ‘যৌননিপীড়কের প্রতি! সে হোক নারী বা পুরুষ! তবে সমাজের চারপাশে, জন্মসূত্রে মেয়ে হবার কারণেই পুরুষ নিপীড়কের দেখা মিলেছে বহুবার। যতবার তাদের অস্তিত্ব অনুভব করেছি ততবার শিউড়ে উঠেছি ভয়ে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি ঘেন্নায়!

আমি ক্লাস সিক্স। শিউলির বয়স সাত! বইমেলা থেকে বেড়িয়ে সে কী কান্না আমার লক্ষ্মী বোনটার! জিজ্ঞেস করলে, কিচ্ছুটি বলছে না। শুধু শ্রাবণের ধারা পড়ছে ঝরে! অনেকক্ষণ পরে, শুধু আমাকেই বলতে পারলো কথাটা! একটা জানোয়ারের দেখা পেয়েছিল বোন আমার! সেই থেকে বইমেলায় যাওয়া বারণ শিউলির। সাত বছর বয়সে। আমার এগারো।

এই এগারোতেই শিখে গেলাম, ভিড় দেখলেই ‘যৌন নিপীড়কের হাত-পা অক্টোপাসের শুঁড় হয়ে যায়! তাই নিজেকে আগলে রাখতে হবে! হাজারো ‘নিশপিশ করা হাত’ থেকে!

ক্লাস সেভেনে এলাকার এক বড় ভাই চিঠি পাঠালো, ‘প্রেম করতে চাই’। ছোট মন। চেনা গন্ডিতে অচেনা আমন্ত্রণ। বুঝে গেলাম, ভালোবাসা নয় এটা। ভোগটাই মুখ্য! বন্ধ হল, পাড়াতো ভাইদের সঙ্গে মেশা। ক্লাস এইটে শারীরিক শিক্ষা সাবজেক্টে ছিল পঞ্চাশ নম্বর। এটায় ফেল করলে, সবগুলোতে ফেল। ভীষণ কড়াকড়ি! পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেতে বই দেখে দেখে ব্যায়াম শুরু করলাম। ভোরে উঠে জগিং (হাঁটা)। তবে খুব বেশি দূর নয়। বাড়ির মূল দরজা থেকে একশো গজ দূরের একটা মুদি দোকান পর্যন্ত। আধঘন্টা! প্রথম দিন, দ্বিতীয় দিন- বাধা বিপত্তির বালাই নেই।

কিন্তু তৃতীয় দিনেই দেখা পেলাম সাপটার। হয়তো নিরীক্ষা করেছিল, কোথায় দাঁড়ালে, নিপীড়নটা নিরাপদ হবে! আবার পালাতেও পারবে সহজে! বাড়ির দরজার পেছনে ঘাপটি মেরে রইল। দু-বার ঘুরে যখন তৃতীয়বার বাড়ির দরজায় গেছি, ব্যস! এক-ঝটকা! মুহূর্তকাল! মাথায় কোত্থেকে যেন বিদ্যুৎ এসে জড়ো হলো! দু-হাজার ডেসিবেলের চিৎকার করলাম, ‘শুয়োরের বাচ্চা’! শুকর ছানা ভয়ে দৌড়! আর আমি! স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছি!

এতো সহজে সাপগুলো মজা পায়? অতো সস্তা ওদের ভোগ-বাসনা? ভাবনা যাই হোক, বন্ধ হলো আমার জগিং! সাবধান হল শরীর। অতোটুকুই এই আমার শৈশবের শারীরিক শিক্ষা!

একবার ‘বিশ্বকাপ ফুটবলের রেপ্লিকা’ বাংলাদেশে এসেছিল। ঢাকা স্টেডিয়ামে সেটা প্রদর্শন। একটা প্রীতি ফুটবল ম্যাচ। তারপর কনসার্ট। শেষ আকর্ষণ আইয়ুব বাচ্চুর গান (রেপ্লিকা দেখতে নয়, আমার মূল আকর্ষণ ছিল আইয়ুব বাচ্চু)! তবে রাত দশটায়!
আইয়ুব বাচ্চুর একটা গান শুনেই বেরিয়ে এসেছিলাম। সব শেষে বেরোতে গেলে, ঝঞ্ঝাট সইতে হবে। বন্ধুদের তাতেই আপত্তি! পরে পুরো রাস্তা ওরা বিড়বিড় করছিল, কেন মেয়ে হলি? উত্তর দিয়েছিলাম, তোরা (সবাই না। পুরুষের মধ্যে ‘প্রিয়’র তালিকায় অনেকে আছেন, যারা দেবতুল্য। ঢালাও করে বললে, তাদের প্রতি অবিচার হবে) কেন মানুষ হলি না?

শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হচ্ছি সেই সময়টায়, পালটে গিয়েছিল চেনা ভুবন! প্রায় সব ছেলেদের ভেতরেই দেখি একটা সাপ বাস করে! বন্ধু, আত্মীয় বড় ভাই, মায়ের অতি দূর সম্পর্কের ভাই, কাকার শালা, বাস কন্ডাক্টর, পানের দোকানদার। শিক্ষার সুবাতাস পাক বা না পাক! বয়স আঠারো বা আটাত্তর! একই চেহারা! একই রুচি! একই কামনা!

সেখানে পাপ পূণ্যের হিসেব নেই। সম্পর্কের বালাই নেই। আছে শুধু ভোগের মানসিকতা!
তাই সেই সময়টাকেই আমার মেয়েবেলার গোধূলি লগ্ন বলি! যে সময়টায় চারপাশ ভালো করে দেখার আগেই জীবনের ‘সত্য-সূর্য’ গেল ডুবে! পুরুষের জন্য তৈরি হলো ঘেন্না। শিখে নিলাম শরীরটাকে আগলে রাখার হাজারও পদ্ধতি!

পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত, উর্দ্ধ ও অধঃ- দশদিকেই একটা করে তৃতীয় নয়ন সেট করে রাখল অবচেতন মন! কোন দিক থেকে ‘যৌন হয়রানি’র তরল বিষ ছিটকে আসবে কে জানে?

পুরাণে আছে,নারীর মন নাকি দেবতার জানা নেই! আমি দেখি, এটা যৌন নিপীড়কের বেলায় শত-ভাগ সত্যি!

তুলনাটা বোধহয় একপেশে হয়ে গেল! সাপের সঙ্গে যৌন নিপীড়কের তুলনা। সাপ আমার কাছে ঘেন্নার। সকলের তো নয়! অনেকেই সাপ পোষে! সাপের বিষেই তো এতো ওষুধ তৈরি হচ্ছে।

আর সাপকে নিজের সঙ্গে ‘যৌন নিপীড়কের তুলনা করতে বলুন! অবলা প্রাণী প্রতিবাদ করবে, এই বলে যে, ‘অযাচিতভাবে আমরা কারো ক্ষতি করি না। নিজের জীবনের সংকট না দেখলে নীল বিষের দংশন কাটি না।’

আর যৌন নিপীড়ক? আমার পাড়ায়, মহল্লায়, শহরে, দেশে, বিদেশে, পুরো পৃথিবীতে নিপীড়কের একই চেহারা। একই চরিত্র। একই মানসিকতা!

আর এই নিপীড়কদের যন্ত্রণায় প্রতিদিন কত মেয়ে, তার জীবনের ‘সূর্যটাকে অস্তগামী করেছে, সঠিক হিসেবটা কি আদৌ জানি! না বোধ হয়! মাঝে মাঝে কিছু খবর পাই। অমুক দেশের, তমুক শহরের, সেই মেয়েটি, নিপীড়কের অপমান সইতে না পেরে, পরিবারকে গঞ্জনার ভার বইতে না দিয়ে, একাই ‘জীবন-ভার’ সঙ্গে নিয়ে সাঙ্গ করে ‘জীবনরথ’!

আর বাকিরা? ‘চোখে সয়ে গেছে’ ভাব করে মৃদু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে! আরেকটু সাবধান হওয়া যেত, আরেকটু চতুর চালাক না হলে মেয়েদের চলে না- এসব বেদবাক্য উগড়ে দিয়ে নিজের কাজে মন দেয়!

ওদিকে ঘেন্না পায় অবলা প্রাণীরা। এদিকে সমাজের আনাচে কানাচে যে বিষাক্ত সাপগুলো (যৌন নিপীড়ক), নীল বিষ নিয়ে ওত পেতে থাকে, তাদের বাঁচাতে আছে নানা তরিকা! হরেক রক্ষাকবচ! আমি সমাজের সেই তরিকা আর রক্ষাকবচগুলোকেও একইরকম ঘেন্না করি!

২৮.৩.২০১৭
দুপুর ১২.৩৭ মিনিট
দারুস সালাম, ঢাকা

শেয়ার করুন: