কর্মজীবী মা ও ব্রেস্ট ফিডিং – দ্বন্দ্বটা কোথায়?

অনেকক্ষণ যাবত আয়শা বেগমের ঘরে অপেক্ষা করছি। বিছানায় তার ১৪ মাসের ছোট্ট মেয়ে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছে। আর মাদুর পাতা ফ্লোরের উপরে ২ বছরের মেয়ে মাটির তৈরী হাড়ি-পাতিল দিয়ে খেলছে। হঠাৎ আয়শা বেগম (২৪) বগলে একখানা ভ্যানিটি ব্যাগ চেপে হন্তদন্তভাবে ঘরে ঢুকলেন।

আমি কেমন আছি জানতে চেয়ে ব্যাগখানি বিছানাতে রেখে ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আমাকে কিছুটা আড়াল করে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করলেন। তিনি ঢাকা শহরের একটি বস্তিতে বসবাস করেন এবং কাছাকাছি একটি গার্মেন্টসে কাজ করেন।

ছবিটি সংগৃহীত

(ছবিটা সংগৃহীত)

আয়শা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে বলেন, আপা! বাচ্চারে রাইখ্যা গার্মেন্টসে কাজ করতে খুব কষ্ট হয়। এই টুকুন দুধের বাচ্চা সকালবেলা আমারে ছাড়তে চায় না জড়াইয়া ধইরা রাখে, সারা মুখে খালি চুমা খায়। তারে ফাঁকি দিয়া বদনা হাতে লইয়্যা কই, মা তুমি থাকো, আমি একটু পায়খানা দিয়া আসি। এই বইল্যা ঘরের পিছন দিয়া পালাইয়া কাজে যাই। কী করমু আপা, পেটের দায়ে কাজতো করতেই হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গার্মেন্টসে কর্মরত বেশিরভাগ মায়েদের জীবনের গল্প প্রায় আয়শার সাথে মিলে যায়। যুক্তরাজ্যের Institute of Development Studies এবং বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান Development Research Initiative (dRi) সম্প্রতি যৌথভাবে গার্মেন্টস কর্মী মা ও তাদের বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো বিষয়ক গবেষণা শেষ করেছে। যেখানে এজাতীয় নানা বিষয় উঠে এসেছে।

এই আয়শারাই পোশাকখাতে কাজ করে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। [বিডিএইচএস – ২০১৪ পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই পোশাক খাতে যারা কাজ করছে তার মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগই নারী। যাদের মধ্যে বিবাহিত নারীর সংখ্যা ৫৫ ভাগ এবং অবিবাহিত ৪৫ ভাগ। ১০০ জনের মধ্যে মাত্র ৫৫% কর্মজীবী মা তাদের বাচ্চাকে ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ায়। আর মাত্র ২০% মা তাদের বাচ্চাকে দেড়বছর পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ায়।]

এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রায় অর্ধেক সংখ্যক কর্মজীবী নারী তার সন্তানকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত টানা বুকের দুধ খাওয়াতে পারছে না। ফলে একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাচ্চারা নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ না পাওয়ায় পুষ্টিহীনতায় ভোগার আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে।

গার্মেন্টসে কাজ করা এইসকল বিবাহিত নারীদের পরিবার পরিকল্পনার সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার অভাবে খুব দ্রুতই একজন নারীকর্মী মা-এ রুপান্তরিত হয়। এরপরই শুরু হয় ঐ নারীর জীবনে নানান প্রতিকূলতা।

একজন গর্ভবতী মায়ের গর্ভকালীন সময়ে যে পরিমাণ এবং যত ঘন ঘন খাবার খাওয়া ও বিশ্রামের দরকার তা তারা ব্যবস্থা করতে পারছেন না। এসব কারণে গর্ভবতী মা এবং তার গর্ভের সন্তান উভয়ই অপুষ্টিতে ভুগছেন এবং মা জন্ম দিচ্ছেন একজন অপুষ্ট সন্তান। এই প্রভাব পড়ছে গর্ভপরবর্তী সময়েও।

এরকম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে একজন নারী গার্মেন্টস কর্মী যদিও বাচ্চা প্রসব করতে পারেন, কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পর তার কাজ এবং বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো দুটোই একসাথে চালিয়ে যাওয়া নিয়ে খুব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। পুষ্টি বিজ্ঞানে বলা হয়, বাচ্চা জন্মের পর তাকে শালদুধ এবং টানা ৬ মাস শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত। কিন্তু সকল গার্মেন্টসেই সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এবং বেশিরভাগ সময় ওভার টাইমের কারণে রাত ৯-১০ পর্যন্ত কাজ করার ফলে মা গার্মেন্টস কর্মীর পক্ষে তার বাচ্চাকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব হয় না। ফলে বাচ্চা অনেক বেশি অপুষ্টিতে ভোগে, তার শারীরিক বিকাশ থেকে শুরু করে বুদ্ধির বিকাশ কোনটাই ঠিকমত হয় না।

আয়শার সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি কর্মস্থলে যাওয়ার আগে তার বুকের দুধ বাচ্চার জন্য একটি বাটিতে চিপে তারপর ফিডারে ঢেলে রেখে যান। আয়শা এভাবে তার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করলেও তিনি তা বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেননি। এমনকি এই বিষয়ে জ্ঞান-স্বল্পতা এবং সামাজিক ও ধর্মীয় নানা প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান থাকায় এর চর্চা খুব বেশি একটা দেখা যায় না।

গার্মেন্টসে যে কাজের পরিবেশ তা নারীর জন্য খুব বেশি উপযোগী নয়। কোনো বিবাহিত নারী যদি শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে, তাহলে তার সহকর্মী এবং সুপারভাইজাররা তাকে নিয়ে নানা ধরনের হাসি-তামাশা করেন। তাছাড়া অসুস্থতার কারণে সে ছুটিও পায় না, বরং এ কারণে যদি প্রোডাকশন কম হয়, বা কাজে কোন ভুল হয় তাহলে তাকে উল্টো গালি-গালাজ শুনতে হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হয়।

গর্ভবতী নারীরা অনেক সময় দেরি হওয়ার ভয়ে সকালে খুব দ্রুত গতিতে হেঁটে অফিসে যায়, এবং ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হয়, যা মা এবং বাচ্চা উভয়েরই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়াও গার্মেন্টসে গর্ভবতী নারীদের জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তাদেরকে সিঁড়ি বেয়ে ৫-৮ তলা পর্যন্ত উঠতে হয়, এবং দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করতে হয়। যা একজন গর্ভবতী নারীর জন্য খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

জিন্নাতুন নেছা

(গবেষকদের একজন জিন্নাতুন নেছা)

সরকারিভাবে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য আইন, সুযোগ-সুবিধা, মাতৃত্বকালীন ছুটি এসব নানা নীতিমালা থাকলেও তা কেবল কাগজে কলমে। বাস্তবে তার প্রয়োগ খুব কম। পোশাক শিল্পে এর প্রয়োগ আরো নাজুক। নিয়ম অনুযায়ী মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস হওয়ার কথা থাকলেও পোশাক শিল্পে এ নিয়ম মানা হয় না। কোন কোন গার্মেন্টসে মাতৃত্বকালীন ছুটিই দেওয়া হয় না, আর দিলেও ৩/৪ মাসের বেশি দেওয়া হয় না। যে কারণে গার্মেন্টস কর্মী মায়ের পক্ষে এ সময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব হয় না। তাই তারা গার্মেন্টসে কাজ এবং বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো একসাথে চালিয়ে যান।

বর্তমান সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী প্রত্যেক কর্ম প্রতিষ্ঠানে শিশুদের জন্য চাইল্ড কেয়ার থাকার কথা থাকলেও বেশিরভাগ গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে  চাইল্ড কেয়ারের কোন ব্যবস্থা নেই বা বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য আলাদা কোন রুম নেই। আবার যে কয়টি গার্মেন্টসে  চাইল্ড কেয়ার আছে তার পরিবেশ (আয়ার ব্যবহার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তা) বাচ্চা রাখার জন্য উপযোগী নয়।

অন্যদিকে বাচ্চার চাহিদা অনুযায়ী দুধ খাওয়াতে গেলেও মাকে শুনতে হয় সুপারভাইজারের নানা কটু কথা। এসব বাঁধা পেরিয়ে মা কখনো কখনো তার বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে সক্ষম হলেও এটি যে সবসময় সম্ভব হয় তাও নয়। এই সমস্যাটি সবচেয়ে বেশি হয় যখন কাজের চাপ খুব বেশি থাকে বা শিপমেন্টের সময়।

কিছু কিছু গার্মেন্টসে নীতিমালা অনুযায়ী কিছুটা সুযোগ-সুবিধা দিলেও বেশিরভাগ গার্মেন্টসের নারীরাই এ সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ‘আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ’- তাই এই সকল শিশুর সঠিক বিকাশ ও সুন্দর ভবিষ্যতের লক্ষ্যে একজন কর্মজীবি মা যেন তার বাচ্চাকে কাজের পাশাপাশি বুকের দুধ খাওয়ানোও চালিয়ে যেতে পারে এজন্য গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের অচিরেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকার পক্ষ থেকে নীতিমালা বানিয়ে প্রত্যেক গার্মেন্টসে নারী শ্রমিকদের জন্য ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং যে সকল নারী শ্রমিকরা বাচ্চাকে ব্রেস্ট ফিডিং করায় তাদের জন্য স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে চাইল্ড কেয়ারের ব্যবস্থা করতে হবে। এর পাশাপাশি চাইল্ড কেয়ারে নারীরা যাতে একটা নিদিষ্ট সময় পর পর তাদের বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়াতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। মাতৃত্বকালীন ছুটির ক্ষেত্রে প্রসবের আগে অর্ধেক ছুটি এবং প্রসবের পরে অর্ধেক ছুটি এমন নিয়ম বাতিল করে নারীদের সুবিধা অনুযায়ী বা তাদের ইচ্ছানুযায়ী ছুটি প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখকবৃন্দ-

আফরিন সুলতানা আশা, জিন্নাতুন নেছা, শারমিন আখতার : নৃবিজ্ঞানী, গবেষক, লেখক।

শেয়ার করুন: