ইভানা শামস্:
গত একুশে ফেব্রুয়ারি, ক্যাডেট কলেজ ক্লাব থেকে বইমেলায় পৌঁছেই গেটে ঢোকার আগে যথারীতি ফুলের মুকুট কিনছি এক ১৪/১৫ বছরের মেয়ের কাছ থেকে। ফুলের মুকুটের দাম সেদিন সর্বোচ্চ, ১০০ টাকা। দুইটা মুকুট কিনে ২০০ টাকা মেয়েটার এক হাতে দিয়েছি, মেয়েটার অন্য হাতে আরও তিনটা মুকুট ছিল। এমন সময় হঠাৎ চিলের মতো ছোঁ মেরে এক পুলিশ ওর হাত থেকে দুটা মুকুট ছিনতাই করলো। আমি বেসুরা গলায় চিৎকার করে উঠলাম, বুঝতে সময় লাগলো ওটা পুলিশ ছিল, তাই আশেপাশে কেউ আমার মতো, বোকার মতো, চিৎকার করে নাই। মেয়েটা ছুটে গেলো পুলিশের পিছন পিছন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো, হাতে শুধু একটা মুকুট, বুঝলাম ওর ২০০ টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে, কিছু চিন্তা না করেই ব্যাগ থেকে ১০০ টাকা বের করে দিলাম, হয়তো ভিতরের গিলটি ফিলিং থেকে, লজ্জাবোধ থেকে, অথবা সেই পুলিশের হয়ে ক্ষমা চেয়ে।

আমি বললাম “কী করবে ও ফুল দিয়ে?”, ও বলল “ছিঁড়ে ফেলবে, রাস্তায় ফুল ফেরি করা অবৈধ তাই”।
আমি মনে মনে ভাবলাম “আহারে দুটা মেয়ে আজকে মুকুটের অভাবে সুন্দর লাগা থেকে বঞ্চিত হবে”। আরও ভাবলাম… এই পুলিশটাই যখন রাতে বাসায় যাবে, তার ১০ বছরের মেয়ে “বাবা” বলে তার গলা জড়িয়ে ধরবে পরম ভালবাসা নিয়ে। এই ঢাকা শহরে তখন অফিসে অফিসে ঠাণ্ডা এসির নিচে কত অবৈধ ডিল ক্লোজ হবে! আমার পুঁজিপতি এমপ্লয়ার ‘উলওয়ারদশ’ তখন হয়তো নকশা করছে কিভাবে বাংলাদেশি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানকে এক পেনি কম দেয়া যায়।
এসব ভাবতে ভাবতে চুপ করে মেলায় ঢুকে গেলাম আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম এখন থেকে প্রতিদিন এই ফুলের মুকুট কিনবো আমাকে ফাতরা লাগলেও। পরের দিন আবার মেলায়, যথারীতি ফুল কেনার সময়। সামনে পরিচিত একটা মুখ, মহিমাময় হাসি। ওকে আজকে মেলায় পেয়ে মনে হলো আমার কোনো আত্মীয় বা খুব কাছের কোন মানুষকে পেয়েছি। আমি বললাম “আবার তুমি আমার ভাগ্যে?”
কোনদিন একই ছেলে/মেয়ের থেকে দ্বিতীয়বার কেনার সুযোগ হয়নি। সেদিন মুকুটের দাম ৭০/৮০ টাকা করে। আমাকে মেয়েটা একটা মুকুট পরিয়ে দিল, গোলাপটা কপাল বরাবর রেখে। আমি বললাম, “কত দিবো”, ও বলল “৫০ টাকা দেন”। আমি অবাক হয়ে ৫০ টাকাই দিয়ে আসলাম। আগামী বছর যদি আবার বই বের করি, যদি মেলায় যাই, মেলার গেটে দাঁড়িয়ে আমি মহিমার অপেক্ষায় থাকবো, হ্যাঁ ওর নাম দিয়েছি আমি ‘মহিমা’। জানি না মহিমাও আমার অপেক্ষায় থাকবে কীনা। যদি ওকে না দেখতে পাই, ভেবে নেবো ও হয়তো কোন বৈধ চাকরি করছে, অথবা বিয়ে হয়ে গেছে, অথবা বেশ্যা হয়ে গেছে।