ছুটিবিহীন ফুলটাইম জব বনাম পুরুষতন্ত্রের মৌচাক

[adrotate banner=”3″]

কাকলী তালুকদার:

মাঝে মাঝে ছুটি নিতে ইচ্ছে করে আমার। এই আমিটা আসলে আমি একা না। আমার মতো অনেকেই, যারা ছুটিহীন এই ফুল টাইমের জবটা করেন। ফুল টাইম মানে কিন্তু সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা নয় আমাদের কাজ! সপ্তাহে ১১২ ঘন্টা, কী কর্মঠ আমরা, তাই না?

কাকলী তালুকদার

অথচ বেতন হিসেব করলে খুব ঝামেলায় পড়ে যাই। নিজের খাওয়া, থাকা, প্রয়োজনীয় সকল কিছুর হিসেব বাদ দিয়েও ১১২ ঘন্টার টাকা হিসেবে করলে অনেক টাকা থেকে যাওয়ার কথা! অথচ সেই হিসেবে করার কোনো উপায় আমাদের নেই। কারণ পরিবারে নারীর অবদান পরিমাপযোগ্য কোনো মেশিন অথবা মানসিক সৌন্দর্যতা আমাদের সমাজে এখনও তৈরি হয়নি। তৈরি না হওয়ার প্রধান কারণ নারীরা ঘর থেকে বাইরের জগতে প্রবেশ করেছে, কিন্তু পুরুষের অবস্থান বাইরেই আছে।

ঘর নিয়ে আমাদের পুরুষদের বাড়তি ভাবনার কোনো প্রয়োজন তারা মনে করেন না। অর্থনৈতিক সাপোর্ট একটি বড় বিষয় অস্বীকার করার উপায় নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘরের পুরুষ ব্যক্তি সেই দায়িত্বটুকু পালন করে থাকেন। তবে যে সকল নারী আজ অর্থ উপার্জন করছেন, তারাও পরিবারে সেই টাকা ব্যয় করছেন।

সেই সাথে ফুল টাইম জব দুই রকম হয়ে যাচ্ছে। পুরুষ সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা করে ফুল টাইমের বেতন পাচ্ছেন, আর নারী ১১২ ঘন্টা কাজ করে ৪০ ঘন্টার বেতন পাচ্ছে (যে নারী বাইরে গিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন)! এই যে ৭২ ঘন্টার কোনো অর্থনৈতিক হিসেব আমাদের কোথাও নেই! বেতনসহ ৪০ ঘন্টা জবের বাৎসরিক ছুটি নির্ধারিত থাকে, অথচ পরিবারে ১১২ ঘন্টা জবের কোন ছুটি নির্ধারণ করা নেই!

কী ভাবছেন? এই হিসেবি নারী কী বলছে? পরিবারে আবার হিসেবে কিসের? এতো অনুভূতি, অনুভব দিয়ে যেখানে একটি পরিবার সুন্দর হয়ে উঠে, যে মায়ের অবদানে যেখানে স্বর্গ সুখ থাকে, সেখানে একজন মা এতো হিসেব কেন করছে? করছি, সত্যিই করছি। কারণ এই পরিবারেই আমি আমার মূল্যবান জীবনের সময়টুকু ব্যয় করছি। একজন মেয়ে হিসেবে এই পরিবারেই আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি! সন্তান হিসেবে সম্পত্তিতে আমি বঞ্চিত, ধর্মে আমি নারী হিসেবে অবাঞ্ছিত! সমাজে আমাকে চলাফেরা, চিন্তার পরাধীনতা নিয়ে প্রতিটি পা ফেলতে হয়। আমার নিরাপত্তাহীনতা সর্বত্র, অথচ সমাজের দাবি তারা খুব প্রগতিশীল।

আমার খুব ক্লান্ত লাগে মাঝে মাঝে। আমার মাতৃত্বের আকর্ষণ এই সভ্যতা টিকিয়ে রাখার চাবিকাঠি। কিন্তু সভ্যতার কারিগর হিসেবে নারীদের একার দায় কিংবা দায়িত্ব নয়। পৃথিবী টিকিয়ে রাখতে হলে বন্টন অবশ্যই সুষম হতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে নাগরিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা, অধিকার, আইন এর ক্ষেত্রে সর্বত্র নারী-পুরুষ সমান ভোগ বা উপভোগ করে থাকে। সেইক্ষেত্রে একটি পরিবারে নারী-পুরুষ, ঘর-বাইরে সমান গুরুত্ব দিয়ে একটি পরিবারকে, তথা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সেই সমাজের গ্রহণযোগ্যতার কারণেই আমরা বিদেশমুখী হই। পরিবার এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা দুজনেই দুজনকে ব্যালেন্স করছে প্রতিনিয়ত। নিজের নিরাপত্তার কারণেই একটি উন্নত দেশ এর খোঁজে নিজের দেশকে ছেড়ে যাচ্ছি আমরা।

শিক্ষার আলো ব্যক্তির জীবনবোধকে যেমন জাগিয়ে তোলে, তেমনি আত্মমর্যাদার উপলব্ধিটুকু বাড়িয়ে তোলে সে নারী বা পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গের একজন হলেও। সেই ক্ষেত্রে নারী আজ অগ্রগামী, তার ব্যক্তি-স্বাধীনতা, মর্যাদা, আত্ম-সম্মান নিয়ে সামনে এগুচ্ছে। নারীদের এই এগিয়ে যাওয়া আজ পুরুষতন্ত্রের উচ্চ রক্তচাপ এর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীরা যখনই তাদের স্বকীয়তা নিয়ে এগুতে চাচ্ছে, পরিবার প্রথায় একটা ভাঙ্গনের ফাটল দেখা দিচ্ছে। এর প্রধান কারণ নারী তার অসহনীয় সহ্য শক্তি দিয়ে যতদিন পরিবারের সকল অসহ্য ভারগুলো বহন করেছে, পরিবার টিকে ছিলো, এখনও টিকে আছে একই কারণে।

যে সকল পরিবারে নারী সেই সকল অন্যায় মেনে নিতে রাজি নয়, সেখানেই ডিভোর্স এর ঘটনাগুলো ঘটছে। পরিবারে খুব ভালো পুরুষটিরও যখন পুরুষতন্ত্রে আঘাত পড়ছে, তখনই সব পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তার মানে শান্তির পরিবার প্রথা টিকিয়ে রাখতে নারীদের ভূমিকাই মুখ্য। তবে কি নারীর হজম শক্তি বেশী হলে পরিবার টিকবে, নয়তো পরিবার ভেঙে যাবে? নাকি শিক্ষার আলোর সাথে পুরুষতন্ত্রের মৌচাকে আগুন ধরানোর একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা করতে হবে?

অবশ্য পুরুষতন্ত্রের যে মৌচাক এটি পুরুষদের জীবনবোধকে যতটা সহজ, লোভনীয় করে রেখেছে, তার থেকে বেরিয়ে আসা প্রগতিশীল পুরুষদেরও একটু কষ্ট সাধ্য হয়ে যায় বৈকি! তবে সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই নারী-পুরুষ দুজনকেই সুষম দায়িত্বশীল হতে হবে। একজন শিক্ষিত নারী মাতৃত্বের অনুভূতি নেয়ার পাশাপাশি না নেয়ার সিদ্ধান্তও নিতে পারেন। উন্নত দেশগুলোতে অনেক নারীই বাচ্চা জন্মদান করেন না। একজন বাচ্চার জন্মদান থেকে শুরু করে দায়-দায়িত্ব পালন করার ওজন বহন করার সাহস অনেকেরই থাকে না।

সেই কারণেই উন্নত দেশ গুলোতে বাচ্চা লালন-পালনের ক্ষেত্রে মা-বাবার সমান ভূমিকা থাকে। সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, পরিবার গুলোর সমতায় অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে থাকে আইনি প্রয়োগের মাধ্যমে। পরিবারে নারী সদস্যের অনুভূতিগুলো এড়িয়ে যাওয়া বা চাপিয়ে দেয়ার কারণেও নারী হয়ে উঠে পরিবার বিমুখ। সেই ক্ষেত্রে পুরুষ সদস্যকে অবশ্যই অনেক বেশী যত্নশীল এবং দায়িত্ববান হতে হবে। নয়তো প্রিয় বাবা, প্রিয় ভাই, প্রিয় জীবনসাথী,প্রিয় পুত্র, সকল কিছুই একদিন অপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে।

সবার অবহেলার কারণেই হয়তো আপনার প্রিয় কন্যা, প্রিয় বোন, প্রিয়তমা, প্রিয় মা জীবন খাতার হিসাবের পাতাটিই হয়তো আপনার হাতে তুলে দিতে চাইবে যেখানে তাঁর সঞ্চয়ের ঘর শূন্য। 

২১ মার্চ ২০১৭ কানাডা

শেয়ার করুন: