আনিকা আনজুম বরণ:
আত্মহত্যা এই বিষয়টা নিয়ে অনেকদিন ধরেই কিছু লিখার ইচ্ছা ছিল। আমার নিজের চোখে দেখা কিছু আত্মহত্যার ঘটনা শেয়ার করে কিছু বলতে চাই।

প্রথম ঘটনা: ছোটবেলায় আমার বাড়ির পাশে শিল্পী নামে এক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক আন্টি ছিল। উনি আমাদেরকে অনেক ভালোবাসতেন, আদরও অনেক করতেন। আমাদেরকে ছোটবেলায় লিপস্টিক, কাজল টিপ দিয়ে সাজিয়ে দিতেন। সেই শিল্পী আন্টিকে আমরা ফ্যানের সাথে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে থাকতে দেখেছি। শিল্পী আন্টি তার মায়ের মৃত্যুর পরে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আমরা তার হাসিমুখের পিছনের দুঃখটা বুঝিনি। এখনো মনে পড়ে উনাকে।
দ্বিতীয় ঘটনা: এই ঘটনাও আমার এলাকাতেই। এই মেয়েটা তার ৫/৬ মাসের সন্তানকে মেরে নিজেও আত্মহত্যা করেছিলো। লাশের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার পরে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করেছে। কারণটা ছিল পারিবারিক দ্বন্দ্ব।
তৃতীয় ঘটনা: আমার ক্লাসমেট। আমরা একই স্কুলে পড়তাম। নাম লাকী। মেয়েটা প্রেমজনিত কারণে আত্মহত্যা করেছে।
চতুর্থ ঘটনা: আমাদের ইডেন মহিলা কলেজের হোস্টেলে কয়েকদিন আগে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে পড়ুয়া এক আপু গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁস দিয়েছে। অবশ্য এই আপুর মারা যাবার রহস্য এখনো জানা যায়নি।
সম্প্রতি ফেসবুকে একটা আপুর আত্মহত্যার খবর পড়লাম। নাম তাসমিয়া শান্তা। কারণ নাকি প্রেম রিলেটেড। ঘটনা জানার পরে খারাপ লেগেছে। এই রকম আত্মহত্যার খবর আমরা প্রায়ই শুনি এর জন্যই হয়তো বা।
খারাপ লাগাটাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। সত্যি বলতে কী, প্রায় মানুষই জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে থাকে। কেউ সফল হয়, কেউ বা চেষ্টা জারি রাখে। কিন্তু আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় কেন? খুব কঠিন প্রশ্ন এইটা। কতোটা কষ্টের সম্মুখীন হলে কেউ এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায়? কেউ পিছনে লুকোনো কথা জানার চেষ্টা করে না। করবেও না, কারণ এই ঘটনা কয়েকদিন পরে আবার গত হয়ে যাবে। আমরা কেউ মনে রাখবো না। শুধু যে তার প্রিয়জন, স্বজন হারাবে, সে কিছুদিন কষ্ট পাবে।
কিছু কিছু আত্মহত্যাকে আবার হত্যাই বলা চলে। শারীরিক এবং মানসিকভাবে বার বার ভেঙ্গে পড়ার কারণ হয় পরিবার অথবা খুব আপনজনই। কখনো কখনো এই সভ্য সমাজের কারণেও করতে বাধ্য হয়। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ছাড়া মানুষ যেমন থাকতে পারে না, ঠিক তেমনই এই সমাজের মানুষের অমানবিক আচরণই মানুষের মনে বেঁচে থাকার প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায়। এটাই হয়তো আত্মহত্যার একটা বড় কারণ।
ব্যক্তিগতভাবে আমিও অনেকবার ভেবেছি যে মরে যাবো। আত্মহত্যার বিভিন্ন কৌশলও খুঁজে বের করেছিলাম। হতাশা এমন একটা জিনিস যে নিজেকে ভিতর থেকে বিষাক্ত পোকার মতো ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলে। হতাশা যখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠে, তখন ওই সময়টায় কারো নীতিবাক্যও কাজে দেয় না। যাই হোক, বেঁচে আছি তারপরেও। প্রিয় মানুষটার সহযোগিতার কারণে।
ছোটো ছোটো খুশি থাকার বিষয়গুলো এখন আমাকে নতুনভাবে প্রেরণা দেয়। এইটা আমার নির্ভরশীলতা নয়, আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা – যা সব মানুষের দরকার হয়। আমি আমার পরিবারের কাছেও সেই সাপোর্ট পাই, যা বাঁচিয়ে রেখেছে আমাকে। প্রেমে ব্যর্থ হলেই যে মরতে হবে, তার মানে নেই। তবে ঐ সময় তাকে উপযুক্ত সাপোর্ট দেয়ার মানুষ থাকতে হবে।
পরিবার সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে এই বিষয়ে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার বাবা-মা’কে সেই বন্ধুসুলভ জায়গা নিজেদেরই করে নেয়া উচিত। না হলে তাদের সন্তান মনের কষ্ট শেয়ার করতে না পেরে হয়তো বা আত্মহননের পথ বেছে নেবে। জীবনের বাস্তবতা বড় কঠিন এবং নিষ্ঠুর। মানুষের জীবনের লড়াই বহুরূপী। কেউবা হেরে যায়, আবার কেউবা হেরে নিজেকে সামলায়। মানব চরিত্রের দুটি অতি লৌকিক চরিত্র জীবন আর মৃত্যু। জীবন চায় বেঁচে থাকার স্বাদ নিতে, আর মৃত্যু চায় জীবন ছিনিয়ে নিতে। এই লড়াই আমরণ চলে।
আকাশ – বাতাস – পাহাড় – সমুদ্র সব সুন্দর, এই জীবন অনেক সুন্দর, বেঁচে থাকা তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। অনেক অপ্রাপ্তির মাঝে বেঁচে থাকা নিজের জন্য বীরত্বের মতো মনে হবে। মানুষকে ভালবাসলে বাকি সব দুঃখ অর্থহীন মনে হবে। বেঁচে থাকার ইচ্ছা তখন মাত্রাতিরিক্ত হবে।