অনন্যা নন্দী:
ছোটবেলা থেকেই মা-বাবা, অাত্মীয়-স্বজন সবাই একটা মেয়েকে বারবার বলতে থাকে, “ছেলেদের সাথে মিশবে না”, “ভালোভাবে ওড়না দিবে”, “বড়দের সাথে চেঁচিয়ে কথা বলবে না”, “রাস্তাঘাটে কোনো ছেলে কিছু বললে মাথা নিচু করে বাসায় চলে অাসবে”। এসব শেখানোর পেছনে একটাই কারণ থাকে তা হলো সমাজ। পাছে সমাজ যদি খারাপ মেয়ে বলে। তাহলে তো ভালো বিয়ে হবে না।
কিন্তু কেন???

একজন মেয়েকেই কেন এসব শেখানো হয়? বিয়ে একটা মেয়ের ব্যক্তিগত ব্যাপার। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারনে কিংবা খোলামেলা পোশাক পরার কারনে ছেলেদের তো বিয়েতে সমস্যা হয়না? তবে মেয়েদের কেন ভালো বিয়ের জন্য এতো মানুষকে পরোয়া করতে হয়?অাসলে দোষটা অামাদেরই।অামরা মেয়েরাই এসব মনেপ্রাণে মেনে নিই।যে ছেলে অামাকে মানুষের মতো বাঁচতে দিবেনা সে কীভাবে একজন ভাল স্বামী হবে?
একজন ছেলে বাবার পক্ষ হয়ে কারও সাথে ঝগড়া করলে “বাপ কা বেটা” হয়ে যায়। কিন্তু একই কাজ একজন মেয়ে করলে কেন “খারাপ মেয়ে” ট্যাগ দেয়া হয়? প্রতিবাদী ছেলে সুপুরুষ, কিন্তু প্রতিবাদী মেয়ে “ঝগড়াটে”। তাই, একটা মেয়েকে ছোটবেলা থেকেই প্রতিবাদী না হওয়ার শিক্ষা দেয়া হয়। ছেলেদের সাথে না মেশার শিক্ষা দেয়া হয়। যার কারণে মেয়েরা বড় হওয়ার পরেও তাদের উপর হওয়া অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে ভয় পাই।
ছেলেবন্ধুর সাথে মিশতে অাড়ষ্ট বোধ করে। স্বাধীনভাবে পোশাকও বাছাই করতে সংকোচ বোধ করে। পোশাক বাছাইয়ের সময়ও বাবা, প্রেমিক অথবা স্বামীর পছন্দকে প্রাধান্য দেয়। এই বিষয়গুলো এখনও মেয়েদেরকে এভাবে অাঁকড়ে ধরে অাছে যে নারী উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। মেয়েরা এখন বিভিন্ন পেশায় অাসছে ঠিকই, কিন্তু তবুও তারা এখনও বাসায় “ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স” এবং বাইরে “ইভ টিজিং” এর শিকার হচ্ছে। এর কারণ একটাই, অামরা ছোটোবেলাতেই পরিবার থেকে মুখ বুঁজে থাকার শিক্ষা বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করি। “খারাপ মেয়ে” না হতে চেয়ে নিজের উপর হওয়া সব অত্যাচার মেনে নিই। পাখি উড়তে শিখার অাগে তার ডানা কেটে দিলে সে কি অার উড়তে পারে?
মা-বাবারা মেয়েকে নাচ শেখায়, গান শেখায়, ড্রয়িং, অাবৃত্তি সব শেখায়, কিন্তু কখনও “সেল্ফ ডিফেন্স” শেখায় না। না মানসিকভাবে, না শারীরিকভাবে। যেটা বর্তমানে ভীষণ দরকার। মেয়েদেরকে বাসা থেকে বাবা অথবা ভাইয়ের প্রোটেকশানে বাইরে পাঠানো হয়, তবুও অাত্মরক্ষা করতে শেখানো হয় না। মেয়েরা এখন বিভিন্ন পেশায় অংশগ্রহণ করলেও অফিসে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের সাথে কথা বলতে অথবা কাজ করতে গিয়ে অস্বস্তি কিন্তু রয়েই গেছে।ছেলেবন্ধুুর কাছ থেকে দূরে থাকতে থাকতে ছেলে কলিগকেও অামরা মেনে নিতে পারি না।
একটা মেয়ে তার মেয়ে কলিগটির সাথে যতো ভালভাবে কাজ করতে পারে, ছেলে কলিগের সাথে কাজ করতে তার ততটুকুই অস্বস্তি। যার কারণে মেয়েরা নিজেদের প্রোফেশানকেও শতভাগ দিতে পারে না। যারা মানিয়ে নিতে পারে, তারাই তরতর করে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারে। অথচ ছেলেদের তো কোনে প্রব্লেম থাকে না মেয়েদের সাথে কাজ করতে।
কিন্তু অার কতো?
অার কতোদিন এভাবে থাকবো? সময় এসেছে বদলাবার। অামাদেরকে এখন থেকেই অামাদের ভবিষ্যৎ উত্তরসুরিদের শেখাতে হবে।
“রুখে দাঁড়াও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সে যেই হোক, বলিষ্ট চিত্তে তার মোকাবেলা করো। নিজেকে নিজে রক্ষা করতে শেখো।মনে রাখবে তোমার বিপদে একমাত্র তুমি ছাড়া অার কেউ থাকবে না তোমাকে বাঁচাতে। তুমি যে পোশাক পরতে অারাম বোধ করো, সেই পোশাকটাই পরো। যার সাথে মন খুলে মিশতে পারো, তার সাথেই মেশো।”
খুব বেশি কি ক্ষতি হবে অামরা মেয়েরা এভাবে জীবনটাকে উপভোগ করলে? এতে যদি সমাজ বা অামাদের অামাদের অাত্মীয়-স্বজনরা অামাদের খারাপ মেয়ে বলে অামরাও কী বলিষ্ঠ কন্ঠে বলতে পারি না, “হুম, অামি খারাপ মেয়ে, তো!”
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন: