সমাজের কি খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই?

শামীমা জামান

কন্ঠশিল্পী সালমার বিয়ে ভাঙ্গার খবরে লোকজন নড়েচড়ে বসতে না বসতেই মডেল ,অভিনেত্রী সারিকার বিয়ে ভাঙ্গার গুঞ্জন শোনা গেল। তারও আগে মোনালিসা, অপি করিম, রুমানা, রিচি, সুবর্ণা মুস্তাফা, শমী কায়সার, পপি, মিমি, ডলি সায়ন্তনি, বিজরী, মমতাজ …নাহ! তালিকাটা দীর্ঘ।

শামীমা জামান

তার চেয়ে বরং চলেন দেখে আসা যাক এইসব তারকাদের ঘর ভাঙ্গার খবরে নিউজ পোর্টালের কমেন্ট বক্সগুলোর অবস্থা। সালমাকে লিখেছেন কয়েক ভদ্র! লোক: তুমাদের আবার বিয়ে কী! এক পুরুষে …(অশ্রাব্য) ভরে না, তাই বার বার পুরুষ পাল্টাও / রাত বিরাতে বাইরে যাবা, তোমাদের কি ঘর আর কি সংসার/ …কি…গীর উচিত সাজা হইছে /ছুটো লোকের মাইয়া টেকার জন্য এই বিয়া করছিলো এখন বুঝ মজা/গান গাওয়া হারাম, এইসব না করে নামাজের পথে না আসলে এমন শাস্তিই হবে/তার স্বভাব ভাল না তার স্বামীর কুন দোষ নাই…।

এমন নয় যে  সমাজের নিম্ন শ্রেণীর লোকদের মুখে এই বাণীগুলো শোনা যাচ্ছে! আপনার আমার সাথে উঠাবসা করা ভদ্রলোকেরাই একটা বিপদগ্রস্ত নারীর চরম দুঃসময়ে এভাবে বলছেন, এতো নোংরা করে ভাবতে পারছেন! আর নারীই বা কাকে বলছি! কতোটুকুন একটা বাচ্চা মেয়ে সালমা। জীবনের সব রং চেনার আগেই অন্ধকার তাকে গ্রাস করে নিয়েছে। তাকে নিয়ে এর বেশি লিখবো না, কারণ সম্প্রতি সে তাকে নিয়ে আর কোনো কিছু না লেখার জন্য আহবান করেছে। ভয়ে হোক আর কষ্ট না বাড়াতেই হোক, তার আহবানকে শ্রদ্ধা জানানোই উচিত মনে করছি।

সারিকার সংসার ভেঙ্গেছে! কিন্তু কী কারণে ভেঙ্গেছে আমাদের শক্তিশালী মিডিয়া তা জানার জন্য ছটফট করলেও সারিকা এখন পর্যন্ত ঠিক ঠাক মুখ খোলেননি। তাতে কী, ‘যে কারণে সংসার ভাঙল সারিকার (ভিডিওসহ)’ শিরোনামে নিউজ বেরিয়ে গেছে। অতি কৌতূহলী হয়ে আয়েশ করে বসে মজা নেবার খায়েশে ক্লিক করেই হতাশ হচ্ছেন সকলে। একি! এতো সেই পুরনো খবরই বাড়তি কিছু তো বলেননি সারিকা।

কিছুদিন আগে নিজের নামের পাশ থেকে ‘জাফর’ শব্দটি ছেঁটে ফেলে নতুন বিয়ে করে শর্মা শব্দটি যোগ করেন প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী শাকিলা জাফর! হ্যাঁ জাফরই লিখলাম। পুরুষ সারাজীবন নারীর জীবনে না থাকলেও তার নামটি কিন্তু থেকেই যায় বিখ্যাত নারীর ক্ষেত্রে!

সালমা আলী আলাউদ্দিন আলীর নামটা মুছে সালমা সুলতানা হয়ে মরতে পারেননি, এমন উদাহরণ অনেক আছে, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। বলছিলাম শাকিলা আপার কথা। তো এই বয়সে উনার বিয়ে করা নিয়ে জাবর কাটছিলো কতক নারী। স্থান বাচ্চাদের স্কুলের সামনের রাস্তা।

‘এই ভাবী শুনছেন, শাকিলা জাফর আবার বিয়ে করছে, আরে অইটাতো একটা …। প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে না ওর এফেয়ার ছিল …বলি ট্রাম্পের সাথে থাকলেই বা তোদের কিরে সমাজ? তোরা এইসবই বলতে জানিস। তোরা কি করে শাকিলা জাফরের দীর্ঘ নি:সঙ্গ জীবনের ভার বহনের খবর জানবি! তার মালয়েশিয়া প্রবাসী সাবেক স্বামীকে এখনো ছোট করে কোন কথা বলেননি তিনি।

শুধু বললাম, যাকে নিয়ে এতো খারাপ কথা হচ্ছে তার সম্পর্কে একটি ভালো কথা বলি। একদিন একটি প্রোগ্রাম শেষে কিছু করপোরেট হাই প্রফাইল লোকজন শাকিলা জাফরের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল তাকে লিফট দেবার জন্য। অল্প দূরে দাঁড়িয়ে ছিল আমার বর সংগীত শিল্পী খালিদ (চাইম)। শাকিলা আপা খালিদের কাছে এসে নিচু স্বরে বললেন, ‘তুই যদি আমাকে পৌঁছে না দিস এই লোকগুলা আমার সাথে খুব অসভ্য আচরণ করবে …’।

কিন্তু আমার এই কথায় চিড়ে ভিজলো না। আলাপ শাকিলা থেকে সুবর্ণা মুস্তাফার কচি ছেলেকে বিয়ে করা, তিন্নির সাবেক বর হিল্লোলকে নওশীন এর কেড়ে নেয়া, ফাহমিদা নবীর একাকি জীবন, অপি করিমের তিন নম্বর বিয়ে খেয়ে গাড়ি থেকে নামা সদ্য ডিভোর্সি মিস এর আপাদমস্তক ছিঁড়ে ফুঁরে খায়। এই খানেওয়ালারা কিন্তু পুরুষ নয়, নারীই। এরই মাঝে ভিড়ের কোনায় কাচুমাচু হয়ে অতি অসহায় সদা বিব্রত ভঙ্গিতে একজন নারীকে দেখতে পাই। তিনি না পারছেন এই সমাজে মিশে যেতে, না পারছেন এড়াতে, কারণ তার বাচ্চাটিও এই স্কুলে পড়ে।

পরে আলাপকালে তার লজ্জার কারণ জানতে পেরেছিলাম। তিনি তার ফ্লাটেও কারো সাথে মেশেন না স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে বলে! সরব হয়ে মিশতে না পারলেও ভদ্রমহিলা সমাজে আসেন গুটিসুটি দিয়ে হলেও। আরেকটি বাচ্চার মা ডিভোর্সি হওয়ার অপরাধে স্কুলেই আসেন না। বাচ্চাটিকে  টিনেজার একটি ছেলে অথবা ড্রাইভার আনা নেয়া করে। তিনি এমনকি রিপোর্ট কার্ড ,বা প্যারেন্টস মিটিং জাতীয় জরুরি দিনেও আসেন না।

সোশ্যাল ফোবিয়ায় আক্রান্ত এইসব মায়েরা নিজেদের অস্পৃশ্যা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। এমন একজনকে দেখেছি বিশ বছর তিনি লোকালয়, দোকানপাট, কোথাও না যেয়ে কেবল তার ঘরবন্দী জীবনযাপন করতেন অনেকটা সুচিত্রা সেন এর মতো। ঘর ভর্তি বই, পত্রিকা, জি বাংলা আর পরিবারের দু একজন মানুষ! অথচ স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে ঘর বেঁধে সমাজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে! আর তিনি সেই লজ্জা আজীবন বহন করে যাচ্ছেন মুখ লুকিয়ে।

এদিক দিয়ে আমার এক বন্ধু নবনীতাকে স্যালুট দিতে হয়!  স্বামী নামক এক জন্তুর সাথে দীর্ঘ দুঃসহ জীবনের ইতি ঘটিয়ে একদিনের জন্যেও ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি তাকে। নিজের ফ্ল্যাট (স্বামীর নয়), ভালো বেতনের চাকরি, সন্তানের ভালো লেখাপড়া নিয়ে সে মাথা উঁচু করে চলে। অফিসে, বাচ্চার স্কুলের বিশিষ্ট সমালোচনাপ্রিয় নারীরাও তার নিন্দা কম করতে বাধ্য হয় তার মাথা উঁচু করে চলার কারণেই! কারণ ঐ সব স্বামী পালনকারী নারীদের চেয়ে তার পজিশন অনেক উঁচুতে।

আসলে সমালোচনাপ্রিয় ঐ সব নারী মহল বা সমাজ কেউ কখনো খোঁজ রাখে না নওশীন তার সাবেক স্বামীর কাছ থেকে কী প্রকারের জীবন পার করে এসেছে, কিম্বা গুণী অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা শেষ দিকে প্রিয় অভিনেতার সাথে কতটা সহনীয় জীবন যাপন করতেন!  

সাবেক স্বামীদের কাছে ছাড় দিয়ে কেন অপি করিমের সংসার টেকানো হলো না! কেন ডলি সায়ন্তনিকে বার বার সংসার খুঁজে ফিরতে হয়। তাই নারী সাহসী হও। সমাজকে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে দাও, ‘আমরা মরি, মরবো, তাতে তোদের কিরে সমাজ?’

শেয়ার করুন: