তামান্না ইসলাম:
মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু, এগিয়ে যাওয়ায় বড় অন্তরায় কী? বাইরের ফ্যাক্টরগুলো বাদ দিলে, নিঃসন্দেহে তাদের আবেগ, সেইসাথে আত্মবিশ্বাসের অভাব। এটা আমার মেয়ে জন্মের পরীক্ষিত সত্য। আমার মা, খালা, বান্ধবী, সহকর্মী সবার প্রতিদিনের জীবন থেকে দেখা এবং জানা সত্য।

আমরা দিতে ভালোবাসি, ভালোবাসতে ভালোবাসি। দিতে দিতে, ভালোবাসতে বাসতে সব উজাড় করে দিয়ে বসে থাকি। একসময় ফিরে তাকিয়ে দেখি, নিজের জন্য তো কিছুই অবশিষ্ট নাই। এমনকি নিজের শখ, আহ্লাদ পর্যন্ত, কখনো কখনো বেঁচে থাকার নুন্যতম ইচ্ছাটুকু। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে আমার আমিত্ব। ততোদিনে হয়তো বড্ড দেরি হয়ে গেছে। হয়তো চলে গেছে বয়স, হয়তো ধসে গেছে ক্যারিয়ার, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য, ভেঙ্গে গেছে সম্পর্ক, দূরে সরে গেছে কাছের মানুষ, চূর্ণ হয়ে গেছে আত্মবিশ্বাস, সম্পদ, সুখ, বন্ধু, আত্মীয় হারিয়ে হয়ে গেছে সে একা, ভগ্ন, শূন্য।
ভালোবাসার আর দেওয়ার নেশায় যখন পেয়ে বসে, বোকা মেয়েগুলো তখন কেন যেন নিজেকে থামাতে পারে না আর। জানি না, এটা আমাদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য, নাকি শত বছরের সামাজিক শিক্ষার সুফল! আমার মা, খালাদের দেখেছি দুপুরে অফিস থেকে এসে না খেয়ে স্বামীর জন্য বসে থাকে। সেই দেখে দেখে আমিও শিখেছি। মস্তিষ্কের নিউরনে ঢুকে গেছে এভাবেই ভালবাসতে হয়, নাহলে তোমার নারী জন্ম বৃথা। উজাড় করে ভালবাসাই নারী জন্মের সার্থকতা।
কেউ বলেনি, ভালবাসা দ্বিপাক্ষিক। রূপকথার মতো ‘অবশেষে তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করলো’ সংসারের জন্য চাই প্রেমিক রাজপুত্র, রাজকন্যা একা একা সেই সংসার গড়তে পারবে না। নিউরনে লেখা কোড থেকে মুক্ত হওয়া সহজ নয়। নিজে হাড্ডি, গলা, পাখনা খেয়ে ছেলেমেয়ের পাতে রান, থান তুলে দেওয়া, স্বামীর পাতে মাছের মাথা তুলে দেওয়া, এগুলোও সব নিউরনে লেখা কোড। সেজে, গুজে মনে মনে আশা করা সেই মানুষটি খেয়াল করবে, ‘কেমন লাগছে আমাকে?’, আর শতকরা একশ ভাগ সময়ে যখন খেয়াল করবে না, তখন নিজের সাজের আনন্দটাই মাটি করে ফেলা, সেটাও নিউরনে লেখা কোড।
কন্যা হিসাবে বাবা-মাকে খুশি করতে করতে, প্রেমিকা হয়ে প্রেমিককে খুশি করতে করতে, স্ত্রী হয়ে স্বামীকে খুশি করতে করতে আর মা হয়ে সন্তানকে খুশি করতে করতে নিজের সুখ পাখি কখন উড়ে চলে যায়, তার খবরও রাখে না মেয়েরা। যেসব মেয়ে ভাগ্যবান, বা বোকা, তারা এই খুশি করাকেই নিজের জীবনের চরম পাওয়া, পরম খুশি ভেবে নিজের মনকে মিথ্যা আশ্বাস দিতে পারে।
কিন্তু বেশিরভাগ মেয়ের ভাগ্যটা ততটুকু ভালোও হয় না। যাদের হাতে সে তুলে দিয়েছে নিজের সুখের চাবিকাঠি, যাদের হাসিতে তার মন ভরে, যাদের চোখে কষ্টের এক পলক ছায়ায় তার মন হু হু করে, তারা একদিন তাকে খুশি করার সুযোগটুকুও আর দিতে চায় না। যতটুকু কাছের মানুষ হলে কাউকে খুশি করার সুযোগ পাওয়া যায়, যোগ্যতার মাপকাঠিতে সেই পরীক্ষায়ও সে আর উত্তীর্ণ হয় না।
প্রেমিকা পুরনো হয়, বউ পুরনো হয়, পুরনো প্রেমিকা ভালো লাগে না, এই সম্পর্ক ভেঙ্গে দেওয়া বড্ড সহজ, কোন দায়বদ্ধতা নেই, পুরনো বউয়ে যখন রুচি হয় না, সেটা না ভাঙলেও একটা মৃত সম্পর্কের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া যায় সহজেই আর তখনই মেয়েরা টের পায় চাবিটি হাতছাড়া হয়ে গেছে। আবেগের বশে, সম্পর্কের শুরুতেই নিজেকে ভালো রাখার সেই চাবি তুলে দিয়েছে সে অন্য এক মানুষের হাতে। মানুষটি অবহেলায় সেই চাবিটি ছুঁড়ে দিয়েছে। এই চাবি একবার দিয়ে দিলে ফেরত পাওয়া বড্ড কঠিন। চাবি যার, চাবি সামলানোর গরজও শুধুই তার।
তাই, সময় থাকতে সচেতন হও। ভালোবাসো, কিন্তু নিজের জন্য কিছু ভালোবাসা রেখে দিয়ে। আগে নিজেকে ভালোবাসো, তারপরে অন্যকে। হোক সে প্রেমিক বা স্বামী। তার পাশে থাকো, সুখ, দুঃখ ভাগ করে নাও। কিন্তু নিজেকে, নিজের আত্মসম্মান, ভালো লাগা, খারাপ লাগা বিকিয়ে দিয়ে নয়। সে যদি কোন দিন তোমার জন্য দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে, তবেই তুমি তার জন্য দু ফোঁটা জল ফেলো। চোখের জল অনেক মূল্যবান।
এক তরফা প্রেম, অন্ধ ভালোবাসা, মৃত প্রেম বা দাম্পত্য বয়ে বেড়ানো আত্মহত্যার আরেক নাম, সেই আত্মহত্যা হয়তো চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয় আত্মাকে সবার অগোচরে। তোমাকে যেন তুমি নিজেই সুখী করতে পারো, নিজেই পারো কান্না মুছে নিজেকে হাসাতে, উঠে দাঁড়াতে। তোমার সুখের চাবিটি কক্ষনো কোন কিছুর বিনিময়েই হাতছাড়া করো না, শক্ত করে বেঁধে রাখো নিজের আঁচলে।