নাহিদ শামস ইমু:
আমার এই লেখাটি সাধারণ মানুষের জন্য। তাদের জন্য যারা ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ কথাটির প্রকৃত অর্থটি উপলব্ধি করতে অপারগ। এই লেখাটি তাদের জন্য যারা ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ বলতে ‘ধর্মবিদ্বেষ’ বুঝে থাকে, যারা বিশ্বাস করে ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মের প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ করা। তাই এই লেখাটির শিরোনাম দিয়েছি ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রথম পাঠ।
আমার এই লেখাটি সাধারণ মানুষের জন্য। তাদের জন্য যারা ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ কথাটির প্রকৃত অর্থটি উপলব্ধি করতে অপারগ। এই লেখাটি তাদের জন্য যারা ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ বলতে ‘ধর্মবিদ্বেষ’ বুঝে থাকে, যারা বিশ্বাস করে ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মের প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ করা। তাই এই লেখাটির শিরোনাম দিয়েছি ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রথম পাঠ।
আমি পেশায় একজন শিক্ষক। আমার ক্লাসরুমে বিভিন্ন ধর্ম ও মতের শিক্ষার্থী আছে। আছে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ ও খৃস্টান। পুরান ঢাকার দিকে হওয়ায় মুসলিমদের ভেতর আবার শিয়া এবং সুন্নিও আছে। হয়তো আছে সুফিবাদীও। ধর্ম নির্বিশেষে এরা সবাই আমার শিক্ষার্থী এবং ক্লাসরুমের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

ধর্ম নির্বিশেষে আমি তাদের সবারই শিক্ষক। আমার লেকচার প্রদানের সময় আমি সবার দিকেই তাকিয়ে কথা বলবো। আমি ভুলে যাবো এদের মধ্যে কে হিন্দু আর মুসলিম। আমি জানি না পুরো ক্লাসরুমে মুসলিমরা কোথায় বসেছে এবং হিন্দুরা কোথায় বসেছে। কেউ যদি লেকচারের কোনো বিষয় বুঝতে না পারে, সে আমাকে নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করতে পারবে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো তার সমস্যাটা দূর করার। এক্ষেত্রে আমি তাকে জিজ্ঞেস করবো না- ‘তুমি কি হিন্দু? নাকি মুসলিম?’ সে প্রশ্ন কেউই কখনও করবে না। অর্থাৎ, প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম সকলেরই অধিকার সমান। ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বসার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি একই রকম। যে আগে আসবে বা যে প্রথম বেঞ্চ ফাঁকা পাবে, সেই প্রথম সারিতে বসতে পারবে। এমন নয় যে মুসলিমরা প্রথম সারিতে বসবে আর হিন্দুরা পেছনে বসবে।
ধরা যাক, আমরা একটা পরীক্ষা নিলাম। পরীক্ষায় সব শিক্ষার্থীই অংশ নিলো। যে সবচে’ ভালো লিখবে, ভালোভাবে উপস্থাপন করবে, সব প্রশ্নের শুদ্ধ উত্তর করবে- সেই প্রথম হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমরা শিক্ষকরা তাদের যোগ্যতা বিচার করবো। ধরা যাক- একজন হিন্দুধর্মাবলম্বী সবচেয়ে ভালো পরীক্ষা দিলো এবং যোগ্যতার বিচারে তারই প্রথম হবার কথা। এখন যদি সে হিন্দু হওয়াতে তাকে প্রথম ঘোষণা না করে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা একজন মুসলিমকে মেধাতালিকায় প্রথম ঘোষণা করি- তাহলে তা কি উচিৎ হবে?
একদমই না! তারমানে- পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার ক্ষেত্রে আমরা বিচার করবো তার যোগ্যতা, তার মেধা। তার ধর্মকে নয়। ধরা যাক, ক্লাস চলাকালে এক শিক্ষার্থী আরেক শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে আঘাত করলো। সেই মুহূর্তে আমাকে এ ঘটনার বিচার করতে হবে। বিচার করবার সময় আমি যদি প্রশ্ন করি- ‘যে আঘাত করেছে এবং যে আঘাতের শিকার হয়েছে, তাদের ধর্ম কী? তারা হিন্দু নাকি মুসলিম?’
যদি আঘাতকারী মুসলিম এবং আঘাতের শিকার হিন্দু হয়, তাহলে আমি কি করবো? এ ঘটনার বিচার করবো না? নাকি আমি বলবো- ‘মুসলিম শিক্ষার্থী এই কাজ করতেই পারে না।’ বা ‘যা করেছে ঠিক করেছে। নিশ্চই হিন্দুটার কোনো ভুল ছিলো।’ কিংবা ‘মালাউনদের এত বাড়াবাড়ি করা ঠিক না।’ এরকম কিছু কি বলবো? মোটেও না! আমার অপরাধীকে সাজা দিতে হবে, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একজন মুসলিম কোনো অপরাধ করলে যে সাজা পাবে, একজন হিন্দু অপরাধ করলেও একই সাজা পাবে। ক্লাসে কারো অধিকার নেই একে অপরকে আঘাত করার। যদি কেউ কাউকে নিয়ে কটাক্ষ বা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে, তাহলে অন্যজন আমার কাছেই বিচার চাইবে, আমার কাছেই নালিশ করবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সে অন্যের গায়ে হাত তুলতে পারবে না। একজন মুসলিম ক্লাসে যতটুকু স্বীকৃতি পাবে, একজন হিন্দুও ততটুকুই পাবে, একজন বৌদ্ধ ও খৃস্টানও তেমন পাবে। আমি সবার সবার সঙ্গে সমান আচরণ করবো, সবাইকে সমান সুযোগ দেবো, সবাইকে সমানভাবে বোঝাবো, অপরাধীদের সবাইকে সমানভাবে শাস্তি দেবো! মোটকথা, আমাদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত ধর্ম থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের ক্লাসরুমের কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম থাকবে না। ক্লাসরুম হবে ধর্ম নিরপেক্ষ।
আমাদের এই ছোট্ট ক্লাসরুমের উদাহরণটি এবার আপনি আমাদের সমাজ, আমাদের দেশ ও রাষ্ট্রের ওপর প্রয়োগ করুন। মূল ব্যাপারগুলো একই। শুধু পরিসরটা বাড়ছে, আর কিছু নয়। আমাদের রাষ্ট্রে নানা ধর্ম ও মতের মানুষ বাস করছে। ধর্ম ও মত নির্বিশেষে তারা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই রাষ্ট্র সকলের। সংবিধান অনুযায়ী একজন নাগরিকের যে সকল অধিকার আছে, তারা সবাই সেই অধিকার সমানভাবে পাবে। তাদের প্রত্যেকেরই আছে চলা-ফেরার স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। রাষ্ট্রের বিভিন্ন চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে সবাই সমান সুযোগ পাবে। ক্লাসরুমের মতো এক্ষেত্রেও আমরা বিচার করবো তার যোগ্যতা। যোগ্যতা বলে কেউ চাকরি পেলে তাকে চাকরি দেয়া হবে, প্রশ্ন করা হবে না তার ধর্ম কী। (এখান থেকে আমরা বুঝতে পারলাম প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা কেবলমাত্র হিন্দু হবার কারণে তার পদত্যাগ দাবি করাটা সাম্প্রদায়িকতা।
আমাদের এই ছোট্ট ক্লাসরুমের উদাহরণটি এবার আপনি আমাদের সমাজ, আমাদের দেশ ও রাষ্ট্রের ওপর প্রয়োগ করুন। মূল ব্যাপারগুলো একই। শুধু পরিসরটা বাড়ছে, আর কিছু নয়। আমাদের রাষ্ট্রে নানা ধর্ম ও মতের মানুষ বাস করছে। ধর্ম ও মত নির্বিশেষে তারা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই রাষ্ট্র সকলের। সংবিধান অনুযায়ী একজন নাগরিকের যে সকল অধিকার আছে, তারা সবাই সেই অধিকার সমানভাবে পাবে। তাদের প্রত্যেকেরই আছে চলা-ফেরার স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। রাষ্ট্রের বিভিন্ন চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে সবাই সমান সুযোগ পাবে। ক্লাসরুমের মতো এক্ষেত্রেও আমরা বিচার করবো তার যোগ্যতা। যোগ্যতা বলে কেউ চাকরি পেলে তাকে চাকরি দেয়া হবে, প্রশ্ন করা হবে না তার ধর্ম কী। (এখান থেকে আমরা বুঝতে পারলাম প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা কেবলমাত্র হিন্দু হবার কারণে তার পদত্যাগ দাবি করাটা সাম্প্রদায়িকতা।
এও বুঝতে পারলাম যে, দুর্গাপূজা উপলক্ষে হিন্দুদের তিনদিন ছুটি দাবি করার বিরুদ্ধে ‘ওলামা লীগ’-এর আন্দোলনও একটি সাম্প্রদায়িকতা।) রাষ্ট্রের আইন-কানুন সবার জন্য সমান। একজন মুসলিম অপরাধ করলে যে সাজা পাবে, একজন হিন্দু অপরাধ করলেও একই সাজা পাবে। কিছুদিন আগে নাসিরনগরে যে হামলাগুলো হলো, তা সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িক অপরাধ। এই অপরাধের সপক্ষে পশুমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন- ‘মালাউনরা ব্যাপারটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে।’
এটিও একটি সাম্প্রদায়িক অপরাধ! একজন শিক্ষক হয়ে আমি যদি কোনো শিক্ষার্থীর অন্যায়ের বিচার না করে হিন্দু শিক্ষার্থীকে কটাক্ষ করে বলতাম- ‘মালাউনদের এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক না।’ তাহলে তা যেমন অশোভন শোনাতো, এবং এমন একটি মন্তব্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে এবং আমি বরখাস্ত হতে পারি; ঠিক তেমনি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন একজন মন্ত্রীর এরকম একটি মন্তব্য তীব্র্য অশোভনীয়, অশালীন; এবং এ জন্য পশুমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ আনা যেতে পারে এবং তাকে মন্ত্রী পদ থেকে অপসারণ করা যেতে পারে! আমাদের সেই ক্লাসরুমের মত রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও ব্যাপারটা একই। প্রত্যেকেরই নিজ নিজ ধর্ম থাকবে। কিন্তু রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনো ধর্মমত থাকবে না। রাষ্ট্র হবে ধর্ম নিরপেক্ষ।
ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মকে খাটো করা নয়, ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্মকে ঘৃনা করা নয়, ধর্মকে উপেক্ষা করা নয়। ধর্ম নিরপেক্ষতায় কোনো ধর্ম ক্ষতিগ্রস্থ হয় না, ধর্ম নিরপেক্ষতায় কারো ধর্ম কলংকিত হয় না। ধর্ম নিরপেক্ষতায় কারো নামাজের ক্ষতি হয় না, কারো পূজারও ক্ষতি হয় না। ধর্ম নিরপেক্ষতায় নাগরিকেরা পায় নির্দ্বিধায় রোজা রাখার কিংবা উপোস থাকার অধিকার, আরাধনা কিংবা ইবাদতের অধিকার, আগরবাতি কিংবা ধূপকাঠি জ্বালানোর অধিকার, আযান দেবার কিংবা ঘন্টা বাজানোর সমান অধিকার। ধর্ম নিরপেক্ষতা মানুষকে দেয় মানুষের মতো করে বাঁচার অধিকার।