পৃথা শারদী:
“আমার মা বাবা আমাকে কখনো গায়ে হাত তুলে শাসন করেননি, আমি ছোটবেলা থেকে তাও খুব মানসিক চাপে বড় হয়েছি, সারাক্ষণ পান থেকে চুন খসলেই তাঁরা আমাকে খোটা দিতেন। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট না করলে কিংবা বাসায় ফিরতে একটু দেরী হলে, একটু ফোনে বেশি কথা বললে হাজারটা কথা, হাজার জনের সাথে তুলনা করা…… তার মেয়েটা নাচে ভালো, ওই ছেলেটা গায় ভালো, সেই মেয়েটা নাম্বার পেল ভালো, তোমারই কেন এতো দুরবস্থা?”
এসব শুনে এতো নজরদারি খবরদারিতে কোথায় যে আমার আত্মবিশ্বাস চলে গেল, নিজেও জানি না। আজকাল পাঁচজনের মাঝে গেলে আমি মিশতে পারি না, বিষন্নতা, হীনমন্যতা ছাড়া কিছুই আর ভর করে না আমার ওপর। আমার মা বাবা যদি ছোটবেলায় আমাকে দুটো কথা না শুনিয়ে দুটো মার দিয়েও আমাকে শিখিয়ে দিতেন চলার পথটা, ধাক্কা দিয়ে আঁকাবাঁকা সেই পথটায় পাঠিয়ে ভুলগুলো ধরিয়ে দিতেন, আমি এমন থাকতাম না। সব কাজে পিছিয়ে থাকা লাজুক মেয়েটার ভেতরে উঁকি মেরে দেখি, “বাহ! এই মেয়েটিও হেরে গেছে মনে মনে জীবনের কাছে, পা মুড়ে চুপ করে বসে আছে ক্লান্ত যোদ্ধার মতোন, জীবন তার দিকে তাকিয়ে বীরের মতো অট্টহাসি দিয়েই চলছে। মানসিকভাবে মেয়েটি পঙ্গু”।

“আমার কলেজের সেই স্যার খুব ভালো পড়াতেন, জানো? সেই স্যার কখনো আমার গায়ে হাত দেননি, তার চাহনিটা কেমন ধারা ছিল যেন, আমার খুব ঘেন্না লাগতো। চোখ দিয়ে শরীর ভোগ করতেন, তার চোখের দৃষ্টি আমার সারা শরীরে ঘুরে বেড়াতো, আমার এতো অস্বস্তি হতো, বাসায় এসে একা একা কাঁদতাম। কাউকে কিছু বলতে পারিনি, সবার দিকে স্বাভাবিকভাবে তাকাতেন, আমার দিকেই কেমন যেন, আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আজকে বিয়ের পরের স্বামীর সাথে ঘনিষ্ঠ হতেও কেমন যেন অস্বস্তি হয়। ঘেন্না লাগে, স্যারের মুখটা সামনে ভাসে,নিজেকে মোলেস্ট মনে হয়। কতো চাইছি বের হয়ে আসতে পারছিই না, এ যেন দু:স্বপ্ন, “মেয়েটি ঘৃণায় কষ্টে কুঁকড়ে থাকে, রাতের বেলা স্বামীর ছোঁয়ায় নিরেট সুখ খোঁজে, স্যারের সেই পশুর মতো মুখটা মনে করে দুখের সাগরে ভাসে।
দেখলাম মেয়েটি ভেতরে গুমড়ে মরছে, অথবা মরে মরে বেঁচে আছে, মানসিকভাবে নিজেকে সে ধর্ষিতা মনে করে, অথচ দেখো তাকে সামনাসামনি! কেউ তো বলবে না মেয়েটি অসুখী! কষ্ট হলো মেয়েটির জন্য, আহা, কতদিন পর মেয়েটি নিজেকে মানসিকভাবে তুলে ধরলো অন্য কারো সামনে!
”আমাদের সম্পর্কটা অনেকদিনের, আমি হঠাত করেই জানতে পারলাম ও আরো একজনের সাথে অনেকদিন আগে থেকেই সম্পর্কে জড়ানো, আমি কোন রাগারাগি করিনি, জোরাজুরিও করিনি, কিছুই করিনি, তবে আমি ভেতরে ভেতরে মরে গিয়েছি, ও আমাকে মানসিকভাবে খুন করেছে, এর চেয়ে যদি ও আমাকে মেরেও ফেলতো, আমার জন্য ভালো হতো।আমার সুন্দর সময়গুলোকে ঠকিয়ে চলে গেলো। কিছু বললে এখন আমাকে ও বলে, জীবনে এমন হতেই পারে! তুমি তো আমাকে ছাড়া বেঁচে আছো! এখন আমিও ভাবি, জীবনে এমন হতেই পারে, আমি তো মরে যাইনি! সবই ঠিক আছে, আমিও ঠিক আছি, দিনের সব কাজ চালিয়ে নিচ্ছি, তবে আগের মতো কোনো কিছুতেই বোধ কাজ করে না, “আমি কথায় কথায় হেসে ঝলমল করতে থাকা, চারপাশ মাতিয়ে রাখা সপ্রভিত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটি সত্যি মরে গেছে। তার চোখ দুটো সারাক্ষণ কাঁদছে, মুছে দেবারও কেউ নেই! মানসিকভাবে মৃত সেই মেয়েটির অভিনয় দেখে তারিফ না করে আমি পারলাম না।
“শ্বশুরবাড়িতে আসার পর, আমি রাঁধতে পারি না, আমি জিন্স পরি, আমি আলাপী, মিশুকে, নিজের মতো প্রকাশ করি, আমি বাড়ির তথাকথিত বউয়ের মতো হতে পারিনি হয়তো। আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই আমাকে উঠতে বসতে কথা শোনাতো, বারবার বলতো, ”মা-বাপ কিছু শিখিয়ে-পড়িয়ে দিতে পারেনি। নতুন বউ আমি, একা একা কাঁদতাম, স্বামীকে বলার পরে ও বলে, ”সহ্য করো, সহ্য করো। বাসার সবার উপরে কথা বলতে পারবো না আমি।“ বলতে পারো, এই মানসিক যন্ত্রণার শেষ কোথায়।“ আমি নীরবে মাথা নেড়ে ‘না’ বলি, তাকিয়ে দেখি, সুন্দর বেশভূষার এক নারীর বদলে কথার চাবুকে রক্তাক্ত এক নারীকে।
“আমার কোনো স্বাধীনতা নেই”। ও বলে,”আমার টাকা আছে, খরচ করো, চাকরি করা যাবে না। আমি অনার্স-মাস্টার্স পাশ দিয়ে বাসায় বসে থাকি”। একদিন বলেছিলাম, ”যদি ঘরে থাকা বউ চেয়েছিলে, তাহলে আমাকে কেন বিয়ে করা!” তার একটাই উত্তর ছিল, ”শিক্ষিত বউ চেয়েছিলাম, বাচ্চা মানুষ করার জন্য।“
“একটা সময় আমি অনেক ঝগড়াঝাঁটি করেছি, দেখলাম ও অনড়, চাকরি করতে দেবেই না, ঘর ভাঙ্গার দশা। ঘর তো আর ছাড়তে পারি না, শেষমেশ এখন ঘর দেখি, বাচ্চা দেখি, কোনদিন কী রান্না হবে তাই দেখি”, প্রশ্ন করি, ”নিজেকে দেখো না? উত্তর পাই, “নাহ, পরাধীন মানুষকে দেখতে ইচ্ছে করে না।“ সে যুগল সুখে আছেন, থাকবেনও হয়তো আর লোকচক্ষুর আড়ালে ভদ্রমহিলা নিজের পরাধীনতার ক্ষততে একা একা ডেটল লাগাবেন।
“আমাকে ও মারে না, এতো ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে, আমরা রাগারাগি করে মুখ দেখা বন্ধ করেছি, ও কোনদিন আমার গায়ে হাত তোলেনি”। সামনে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখে আমার ভালো লাগে, তার স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা জাগে। বললাম, ”তাহলে তো তোমার তেমন সমস্যা নেই, তুমি ভালো আছো, আজকাল তো অনেক শিক্ষিত ছেলেও গায়ে হাত তোলে, মারামারি করে।“ “ও আমাকে মানসিকভাবে খুব কষ্ট দেয়, সে তুমি বুঝবে না। এর থেকে দু’চার ঘা যদি আমার শরীরে দিতো, শরীর সয়ে যেত।“
মেয়েটির এ কথায় আমি অবাক হই, আজকাল শারীরিক নির্যাতন নিয়ে এতো কথা হচ্ছে, আর এখানে সে মেয়ে বলে কিনা স্বামী তাঁকে দু’চার ঘা কেন দিচ্ছেন না! জিজ্ঞাসা করি, ”কেমন কষ্ট? ও আমার সাথে দিনের পর দিন কথা বলে না, ও অন্য কারো সাথে জড়িয়ে গেছে। বিয়েটা এখন বোঝা মনে হয়।“
আমার মুখ ফসকে বের হয়ে গেল, ”পরকীয়া? ও তো তোমাকে ঠকাচ্ছে। বাসায় বলে দাও!” মেয়েটি চুপ করে থাকে, সমাজের ভয়ে মুখ খোলে না। ভালোবেসে যাকে বিয়ে করেছিল তার এই ঠকানো চরিত্র কাউকে দেখাতে সে নারাজ। বাপের বাড়িতে তাও একবার বলেছিল“, সবাই বলেছে, ”নিজে করেছ বিয়ে, হ্যাপা নিজে সামলাও, জামাই ভালো তো, তোমাকে মারে না, আমাদের সাথেও ভালো, তোমারই সমস্যা, মানিয়ে নাও!“ শ্বশুরবাড়ির কেউ মানেই না তার কথা, তাদের মতে, ছেলে ভালো। মেয়েটি সহ্য করে যাচ্ছে এই মানসিক অত্যাচার, অত্যাচারের শেষ কবে হবে কে জানে! আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে এক জীবনের জন্য বাসা বেঁধেছে সীমাহীন ধৈর্য্য। খুব ভালো করে তাকালে দেখা যায় খুব সুন্দর শরীরের আড়ালে লুকানো একজন মানসিকভাবে দিক হারানো রমণীকে।
দূর থেকে দেখা প্রেমগুলো, অনেক গভীরে যাওয়া সম্পর্কগুলো, সুখের দাম্পত্য হঠাৎ করেই ভেঙ্গে যায়, দেখা যায় একজন হাসিখুশি থাকা মেয়ে হঠাৎ করে আত্নহত্যা করেন, সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের শতকরা আশি ভাগ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হোন, হালকা পাতলা কিংবা ভারী কিল-চড়-লাথি-থাপ্পড় খান, খেয়েও চুপ করে থাকেন তা লজ্জাবোধ থেকেই হোক, ঘর কিংবা সম্পর্ক সামলানোর জন্যই হোক না কেন। যদি অত্যাচারের মাত্রা বাড়ে, তাহলে নারীরা দ্বারস্থ হোন আইনের, হাত পায়ে মারের দাগ তাদের নির্যাতনের সাক্ষী হয়।
তবে এদেশে মানসিকভাবে কত নারী লাঞ্ছিত হয়েছেন, কত নারীকে মানসিকভাবে হত্যা করা হয়েছে তার শারীরিক মৃত্যুর আগে, সে জরিপ করা হয়নি। মানসিকভাবে মৃত নারীরা জীবন্ত লাশ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন,তাদের সে খুনের বিচার হয় না, হঠাৎ করেই কোনো নারী যদি বের হতে চান সেই অসুস্থ সম্পর্কগুলো থেকে, যদি হাউ মাউ করে বলে যান, আমাকে অত্যাচার করা হচ্ছে, আমাকে বাঁচাও, আমি মরে যাচ্ছি, কেউ ওকে শাস্তি দাও” আমরা তার সারা শরীর তন্ন তন্ন করে খুঁজি কোথায় মারের আঘাত আছে। একটা সময় পর কানাঘুষা করে বলা হয়, ”মেয়ে খারাপ, নইলে মারামারি নেই, কাটাকাটি নেই, ভালো ছেলে, ভালো স্বামী, ভালো শ্বশুরবাড়ি এতো সুন্দর সম্পর্ক থেকেও কেন তার এতো অশান্তি! মেয়ে সুখ ধরে রাখতে জানে না।“ জানতে ইচ্ছে হয়, সুখকে লালন করা কি শুধুই মেয়েদের কাজ!
অবাক করা ব্যাপার আমরা নারীর শরীর ঘেঁটে তার অত্যাচারের মাত্রা দেখি, কেউ তার মনের ভেতর উঁকি মারি না, যেখানে তাকালে দেখবো কোনো শারীরিকভাবে অক্ষত নারীও অর্ধমৃতা, রক্তাক্ত হয়ে মুমূর্ষুভাবে দিন যাপন করছেন, বেঁচে আছেন শুধু বেঁচে থাকতে হয় তাই, আত্মহত্যা করছেন না সন্তান,পরিবারের পিছু টানে, অসম্ভব বিষন্নতায় ভূগে মরে মরে রোবটের মতো করে তাঁরা বেঁচে আছেন কোনমতে।
মানসিকভাবে এত ভেংগে যাওয়া এমন নারীদের কোন চিকিৎসা দেয়া হয় না, মানসিকভাবে এতো কষ্ট পেয়ে বেঁচে থাকা নারীদের আজও এ দেশে পাগল বলে গণ্য করা হয়, ভদ্র ভাষায় কেউ তাদের বলেন, ”অন্যরকম।“ যদিও শারীরিক কষ্টের তুলনায় মানসিক এসব কষ্ট, লাঞ্ছনা কোনো অংশে কম নয়, অনেকাংশেই বেশি, যথেষ্টই বেশি। মানসিক যন্ত্রণা এতোটাই বেশি একটা সময় পর কেউ হয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, কেউ লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান কেউ চুটিয়ে বাঁচেন, সবার সাথে কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক সমুদ্র শূন্যতা নিয়ে বেঁচে থাকেন।
হাত কাটলে রক্ত পড়ে, মাথা ব্যথা করলে পেইনকিলার দিয়ে ব্যথা কমে, আমাদের পাশে থাকা শুভাকাঙ্খীরাই আমাদের ওষুধ দিয়ে ভালো করেন, যত্ন নেন। যারা শারীরিক কষ্ট লাঘব করতে এতো ব্যস্ত কেন তাঁরা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়া নারীর পাশে দাঁড়ান না? শুধু একতরফা দোষারোপই কেন করে যান?
আত্মহননের পথ, যখন আর কোনো উপায় থাকে না মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনার। ধীরে ধীরে এভাবে মানসিক অত্যাচারে অসুস্থ হয়ে যাওয়া নারীর সংখ্যা বেড়েই চলছে, আত্মহত্যা বাড়ছে বহুগুণে, রাস্তায় বের হলে গায়ে এসে ধাক্কা লাগে কতো মেয়ের বিষন্ন দীর্ঘশ্বাস! খেয়াল করে দেখি কতো কতো নারী পরেছেন মাথায় অদৃশ্য মানসিক অত্যাচারের কাঁটার মুকুট!
আহারে!
আমি খুব আশাবাদী মানুষ। সুন্দর একখানা মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করে আজকাল, যার শরীরের পাশাপাশি মনটাও এখনো অক্ষত আছে, নোংরা সমাজের নোংরা মানুষের নোংরামিতে পরে যাকে করা হয়নি কোনো মানসিক হেনস্তা , কবে দেখবো জানি না, তবুও আজও আশায় বুক বাঁধি।
এই এক জীবনে একজন মানুষ যদি হেসে খেলে বেঁচে না যেতে পারলেন তো জীবনের অর্থ কোথায়!
হায় সেলুকাস! হায়, মানসিক কষ্টে কাবু হওয়া নারীকূল! কবে সমাজ বুঝবে, চারপাশের মানুষ বুঝবে তোমার চকচকে চামড়ার নিচে ছিন্নভিন্ন হয়ে থাকা অন্য এক নারী বাস করে, কবে তোমার শুশ্রুষা মিলবে?
কথায় আছে ,”শরীরের নাম মহাশয় , যা সওয়াবে তাই সয় “
এই অধমের মনে প্রশ্ন জাগে ,”ভেতরের মনপাখি কি সবটা সয়, এই মানসিক অদেখা অত্যাচার ,আর তো সয় না প্রাণে “