‘লোহার চুড়ি’

রীতা রায় মিঠু:

বাঙ্গালী হিন্দু নারীরা বিয়ের পর শাঁখা-সিঁদুরের সাথে আবশ্যকীয়ভাবে বাম হাতে একখানা লোহার চুড়ি পরে, চুড়িটিকে কেউ বলে ‘আয়েস্ত’, কেউবা বলে ‘লোহা বাঁধানো চুড়ি’। হিন্দু সমাজে বিবাহিত নারীকে ‘এয়োস্ত্রী’ সম্বোধন করা হয়। ধারণা করছি, এয়োস্ত্রী থেকেই চুড়ির নাম ‘আয়েস্ত’। আয়েস্ত লোহার তার দিয়ে তৈরি হয়।

হিন্দু বিবাহিতা মেয়েকে কেন আয়েস্ত পরানো হতো? বাবার বাড়িতে মেয়েকে আয়েস্ত পরানো হয়না, বিয়ের পর মেয়েটি যখন শ্বশুরবাড়ি আসে, শাশুড়ি স্থানীয়া যে কেউ নতুন বউয়ের বাম হাতে লোহার চুড়ি (আয়েস্ত) পরিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ করেন, ” লোহা-শাঁখা হাতে সুখী হও, স্বামী সোহাগী হও, পুত্রবতী হও, দীর্ঘজীবী হও”।

আধুনিককালে মেয়েরা লেখাপড়া শিখছে, নিজের বিচার বিবেচনা, বোধ-বুদ্ধি দিয়ে যুগ যুগ ধরে চলে আসা সংস্কার, কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। হিন্দু বিবাহিতা মেয়েদের অনেকেই এখন শাঁখা, সিঁদুর, লোহা বাঁধানো চুড়ি পরে না, তারা মনে করে, এগুলো নারীর পরাধীনতার চিহ্ন, কুসংস্কার। শাশুড়ি ইচ্ছে করেই নতুন বউয়ের হাতে লোহার চুড়ি পরিয়ে দেয় যেন বউ তার ছেলের বাধ্যগত হয়ে থাকে।

আবার অন্যদিকে শাশুড়ি বা বয়োজ্যেষ্ঠগণ ভাবেন, শাঁখা-সিঁথির সিঁদুর, হাতের লোহা হচ্ছে সতী নারীর মাঙ্গলিক অস্ত্র। নারী সতী হয় পতিকে নিয়ে। এই শাঁখা সিঁদুরের জোরে বেহুলা তার সাপে কাটা স্বামীকে বাঁচিয়ে ফেলেছে, সত্যবতী বাঁচিয়েছে স্বামী সত্যবানকে।

আসলে প্রবীণেরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না বলে দাসত্ব, বন্দীত্ব, শৃঙ্খলতার কঠিন দিক সম্পর্কে ভাবতেননা। শাঁখা-সিঁদুরের ব্যাপারটিকে তারা ধর্মীয় সংস্কার বলে মেনে এসেছেন। নারী মাত্রেই স্বামী-সন্তানের মঙ্গল কামনা করে। সকল মা তার ছেলের মঙ্গল কামনায় সমুদ্র সেঁচতেও প্রস্তুত থাকেন, আর এতো একটি মেয়ের হাতে লোহার চুড়ি পরিয়ে দেয়া। তাইতো শাশুড়ি মা পুত্র বধূকে হাতে লোহা পরিয়ে দেন। শাশুড়ি মায়েদেরকেও তাদের শাশুড়ি পরিয়েছে লোহার চুড়ি, ক্ষতিতো কিছু হয়নি। স্বামী-পুত্রের মঙ্গলের জন্য মেয়েরা সব করতে পারে।

আধুনিক যুগের অনেক মেয়ে বউ আছে যারা মাঝামাঝি অবস্থানে থাকে, তারা লোহার চুড়ির শৃঙ্খলের বিষয়টিকে যেমন পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারেনা, তেমনি আবার যুগ যুগ ধরে বহমান হিন্দু ধর্মীয় রীতিকেও অস্বীকার করতে ভয় পায়। ঐ যে সকল সংস্কারের সাথে স্বামী আর সন্তানের মঙ্গলের বিশ্বাস মাথায় গেঁথে আছে! তাই দুই কূল বজায় রাখতে তারা সরু শাঁখা, সিঁথিতে সিঁদুরের ছোট্ট সরু রেখা আঁকে। সিঁদুর, শাঁখা ব্যাপারটি অনেক নারীর কাছে পশ্চাদপদতা মনে হয়, লোকসমাজে ‘অচল’ মনে হয়। তাদের অনেকে শাঁখা পরেনা, কিন্তু মা-শাশুড়ির মন রক্ষার্থে, স্বামীকে খুশী রাখতে বাম হাতে শাঁখার পরিবর্তে লোহার চুড়ি পরে, লোহার চুড়িটি সুন্দর ডিজাইনে সোনা-রূপা দিয়ে বাঁধিয়ে নিয়েও পরে অনেকে, সিঁদুরের একটু ছোঁয়া মাথার এক কোণে লাগিয়ে চুল দিয়ে তা ঢেকে দেয় যাতে বাইরে কেউ তাকে ব্যাকডেটেড না ভাবে, তাতে ধর্মীয় রীতিও রক্ষা হয়, আধুনিকতাও দেখানো হয়।

বিয়ের পর আমি অনেককাল শাঁখা, সিঁদুর, লোহাবাঁধানো পরেছি। যতটা না ধর্মীয় রীতি মেনে, তার চেয়ে বেশী যুগ যুগ ধরে চলে আসা মা-দিদিমাদের ঐতিহ্য মেনে। বাঙ্গালী সংস্কৃতির সবকিছুই আমার ভাল লাগে। শাড়ি আমার প্রিয় পোশাক। আমেরিকাতে আসার পর শাঁখা সিঁদুর ব্যবহার অনিয়মিত হয়ে যায়। ওয়েস্টার্ণ ড্রেসের সাথে সিঁথিতে সিঁদুর, দুই হাতে সাদা রঙের শাঁখা মানানসই লাগেনা। সাজগোজের ব্যাপারে আমি যুগের সাথে তাল মেলাতে পছন্দ করি। তাই বলে বাঙ্গালী সংস্কৃতি একেবারে মুছেও ফেলতে পারিনি। বাম হাতে লোহা-রূপা-তামার তারে পেঁচানো চুড়িটাকে খুলিনি। বিভিন্ন বাঙ্গালী অনুষ্ঠান, পূজোপার্বনে শাঁখা-সিঁদুর পরি, শাড়ির সাথে খুব ভাল দেখায় তাই।

দেশে বেড়াতে গেলে আমার শাঁখা-সিঁদুর বিহীন সাজগোজ নিয়ে আত্মীয় বন্ধু, প্রতিবেশীদের কেউ কেউ আমার পতিপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন করলে বিনয়ের সাথে বলি, শাঁখা সিঁদুরতো বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে কুমারী আর বিবাহিত মেয়েদের আলাদা করার চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়, শাঁখা সিঁদুর দিয়ে তো পতিপ্রেম বুঝানো হয় না। অবাঙ্গালী হিন্দু সমাজে বিবাহিতা মেয়েরা মঙ্গলসূত্র পরে, এটাই বিবাহিতার চিহ্ন। আমেরিকায় বিবাহিত এবং অবিবাহিত মেয়েদের আলাদা করার চিহ্ন হচ্ছে অনামিকায় আংটি। অবিবাহিত মেয়েরা কখনও অনামিকায় আংটি পরে না।

বিবাহিত-অবিবাহিত কন্যা আলাদা করা হয় যেন কোন পুরুষ ভুলবশতঃ অন্যের স্ত্রীকে বিয়ের প্রস্তাব না দেয়। আর পতিপ্রেম! শাঁখা সিঁদুর সব সময় না পরেও আমি পতিকে অনেক ভালোবাসি, সেটা আমার পতি জানেন।
**যদিও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনের মতে, নারীর হাতে চুড়ির অন্যরকম ইতিহাস আছে, মেয়েদের হাতে লোহাবাঁধানো চুড়ি নাকি দাসত্বের শৃঙ্খল, লোহার চুড়ি পরিয়ে মেয়েদেরকে পুরুষের বন্দী ভাবা হতো। মেয়েরা হচ্ছে পুরুষের জন্য, সুন্দরী মেয়ে ছিল পুরুষের সম্পত্তি। যার যার সম্পত্তিকে নিজের বলে চিহ্নিত করার ঊদ্দেশ্যে রাজরাজড়া, ধনীগণ নিজের নারীর কপাল থেকে সিঁথি বরাবর হাতের তরবারি দিয়ে চিড়ে রক্তাক্ত চিহ্ন এঁকে দিতেন যাতে তার ‘সম্পত্তি’তে অন্য কেউ ভাগ না বসায়।

সেদিন এক আড্ডায় এক দাদা আমাদের মেয়েদের ঊদ্দেশ্য করে বললেন, ” আচ্ছা, তোমরা বিবাহিত মেয়েরা হাতে লোহা বাঁধানো চুড়ি পরো কেন?”
দাদার স্ত্রী বলল, ” হিন্দু রিচুয়াল মেনে পরি।”
দাদা বলল, “কিসের রিচুয়াল? আচ্ছা তোমরা কি জানো যে বিবাহিত মেয়েদের হাতে লোহার চুড়ি পরানো হতো কেন? বিয়ের পরে মেয়েটিকে দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়ে দেয়ার ছলে।”
আমি মিটিমিটি হাসছিলাম, দাদাকে বললাম, দাসত্বের শৃঙ্খল নয় কথাটা, কথাটা হবে নির্দিষ্ট পুরুষের জন্য বন্দী করা হতো।
দাদা বলেন, বৌদি, আপনিও হাতে লোহার চুড়ি পরে আছেন, আপনিও বন্দীত্ব মেনে নিয়েছেন।

-হেসে বললাম, দাদা আমার কাছে এই বন্দীত্ব খারাপ লাগে না। ভালোই তো, আমি খাঁচার পোষা পাখি, আমার মালিক আমায় তিন বেলা দানাপানি দেয়, আমাকে কষ্ট করে দানা জোগাড় করতে হয়না, খাঁচার বাইরে থাকলে আমাকে সারাদিন উড়তে হতো দুটো দানা খোঁজার আশায়। এখনতো মালিকের পোষা হয়ে গেছি, খাঁচার দরজা খোলা রাখলেও আমি বাইরে যাইনা, ঘরের মধ্যেই ফুড়ুত ফুড়ুৎ ওড়াওড়ি করি, মালিকের কাঁধে বসি, গালে আলতো করে ঠোকর দেই, তাকে গান শোনাই, সে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়, মজাইতো!।

দাদা বেশ জোরে হেসে ফেললেন, দৃষ্টি দিলেন আমার উত্তমের দিকে, বললেন, “কি ব্যাপার, জীবেনদা একেবারে চুপ করে আছে, কিছু বলুন। বৌদি নিজেকে খাঁচার পাখি বলছে।

-উত্তম বললো, আমার পাখিকে আমি ২০০% ফ্রিডম দিয়ে রেখেছি। সে যেথা খুশী যেতে পারে, আমার ভয় নেই, শুধু হারিয়ে না গেলেই হলো।

**দাদার বউ ততক্ষণে হাত থেকে সোনা দিয়ে বাঁধানো লোহা খুলে ফেলেছে, পাশে বসা করবী নিজের সোনা দিয়ে বাঁধানো লোহার চুড়ি দেখিয়ে বলছে, এর মধ্যে লোহা নেই, পুরোটাই সোনার। আমরা তিন নারীই হাসতে হাসতে বলছি, শৃঙ্খল, দাসত্ব, বন্দীত্ব—ওগুলো ব্যক্তিমনের ব্যাপার, হাতে চুড়ি না পরেও অনেক মেয়ে নানাভাবে, নানা জনের কাছে বন্দী হয়ে আছে, আবার দুই হাত ভর্তি চুড়ি পরেও অনেক মেয়ে ২০০% স্বাধীনতা ভোগ করছে, তাদের কাছে হাতের চুড়িটা সাজুগুজুর অংশ, পোশাকের সাথে মানিয়ে পরার মতো ব্যাপার। দাসত্ব, বন্দীত্বের যুগ আমরা অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি।

আরেকটি কথা, ধাতব চুড়ি, ব্রেসলেট বা আংটি কিন্তু আমেরিকাতেও বিক্রি হয়, আর্থ্রাইটিসের সমস্যায় যারা ভুগে, তারা এসব কপার ব্যান্ড হাতে পরে। পাশ থেকে করবীর বর সায় দিল, “হ্যাঁ তাই তো, আমার বাবাকেও দেখেছি আঙ্গুলে তামার আংটি পরতে”। হুম! কাজেই চুড়ি-আংটি দাসত্ব মনে করে পরলে দাসত্ব, প্রয়োজন মনে করে পরলে প্রয়োজন, ভালোবেসে পরলে নিখাদ ভালোবাসাটুকুই জড়িয়ে থাকে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.