মানসিক অসুস্থতার দিকে নজর দেয়া উচিত

তানিয়া মোর্শেদ:

ক’দিন আগে আমার এক বন্ধু একটি পোস্ট শেয়ার করেছিল। আত্মহত্যা প্রতিরোধের বা সুইসাইড হটলাইন নাম্বার, ইউএসএ। আমি সেই পোস্টটি শেয়ার করি তা দেখার পর। সেখানে একজন ফেইসবুক ফ্রেন্ড মন্তব্য করেছিলেন, যে আত্মহত্যা করবে, সে কেন ফোন করবে? মানে যে সিদ্ধান্তই নিয়েছে, সে কি আর ফোন করে? সেখানে উত্তর দেওয়া হয়নি সময়াভাবে এবং পরবর্তীতে ভুলে যাবার জন্য। উত্তরটি এখানেই দিচ্ছি।

যাঁরা আত্মহত্যা করেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই বা অধিকাংশই একবারের সিদ্ধান্তে করেন না। খুব কম মানুষই হঠাৎ করে আত্মহত্যা করে বসেন। অধিকাংশ আত্মহত্যাকারী কোন না কোন মানসিক অসুস্থতা যুদ্ধ করেন। কেউ কেউ হয়তো দীর্ঘ সময়, বৎসরের পর বৎসর। মানসিক অসুস্থতা যেমন বিষন্নতা, স্কিৎজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার এবং অন্যান্যগুলোর রোগী আত্মহত্যা ঝুঁকিতে থাকেন অনেক সময়ই।

তানিয়া মোর্শেদ

আবার কিছু কিছু ঔষধ, তা বিভিন্ন রোগের হতে পারে, মানুষকে আত্মহত্যা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। উন্নত সমাজের দেশগুলোতে প্রতিটি ঔষধের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জানানো হয় রোগীদের ঔষধ সেবন শুরুর আগেই। কিছু মানুষ জন্মগত ভাবেই আত্মহত্যা ঝুঁকিতে থাকেন জেনেটিক্যালি। আবার কেউ বিভিন্ন বায়োকেমিক্যাল ভারসাম্যহীনতার জন্য। কোন মানুষ কতটা ঝুঁকিতে তা অচেনা মানুষের অজানা। মানুষ নিজের বা পরিবারের কারো কঠিন অসুখ, মারণব্যাধি, মানসিক ব্যাধি নিয়ে কথা বলে না।

সামাজিক ভাবে এগুলো ট্যাবু। সময়ের সাথে মানুষ বদলাচ্ছে। কখনো প্রয়োজনেও প্রথম দুটো নিয়ে কেউ কেউ কথা বলেন। তবে মানসিক অসুস্থতা নিয়ে কেউ কথা বলেন না। শরীরের অসুখকে হয়তো “ভাগ্য” নামে ট্যাগ দেওয়া যায়! কিন্তু মানসিক অসুস্থতা! এ যেন নিজের এক ধরণের দোষ বা অপরাধ বা কমতি বা অভিশাপ! অনুন্নত সমাজে মানসিক অসুস্থতা এক নামে “পাগল” বলে পরিচিত! কে চায় এই ট্যাগ নিয়ে নিজের বা প্রিয় কারো জীবন নষ্ট করতে!

তাই মানসিক রোগীদের রোগের যুদ্ধের সাথে সাথে বিষয়টিকে পৃথিবীর সব মানুষের থেকে আড়াল করার যুদ্ধও করতে হয়! কোন ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মানসিক অসুস্থতা, ড্রাগ নেওয়া (বিভিন্ন ধরনের) আত্মহত্যার কারণ হতে পারে। এছাড়া কিশোর বয়সের ছেলে মেয়েদের মধ্যে অভিমান করে আত্মহত্যার প্রবণতা থাকতে পারে। বেড়ে ওঠা শরীরে বিভিন্ন হরমোনের বিভিন্ন কার্যকলাপ চলে। এবয়সে সেকারণে অভিমান, রাগ, জেদ ইত্যাদি আবেগ অনেক বেশী হয়। সে অনুপাতে অনেক সময় যুক্তিবাদী চিন্তা কম থাকে। তাই এ’ বয়সের ছেলে-মেয়েদের সাথে যথেষ্ট ভেবে চিনতে কথা বলতে হয়।

শাসন, আদর, ভালবাসা সব কিছু দিয়ে তাদের বোঝাতে হয়, জীবনে যা কিছুই আসুক না কেন তার মধ্য দিয়ে যাওয়াই জীবন। জীবন মানে কোন একটি অপছন্দের, ঝড়ের, অনাকাংখিত সময় আত্মহত্যা দিয়ে সমাধান নয়। আত্মহত্যা কোন কিছুর সমাধান নয়। আর সে সাথে অন্যান্য মানুষের জীবনও কত কঠিন, কষ্টের সেগুলোও দেখার দৃষ্টিভংগী তৈরী করতে হয়। বিভিন্ন বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবা দান করার ব্যাপারে আগ্রহী করতে হয়। অন্যের কষ্ট কাছ থেকে দেখলে অনেক সময় মানুষ নিজের জীবন ততটা খারাপ নয় তা ভাবতে শেখে।

তবে এতো কিছুর পরও কেউ কেউ আত্মহত্যার কথা ভাবতে পারে। হয়তো সত্যিই সে আর আর কোন আশা দেখে না। এই সব মানুষদের জন্যই সুইসাইড হটলাইন থাকে উন্নত সমাজে। এধরনের অনেকেই বেশ কিছুটা সময় ধরে আত্মহত্যার চিন্তা করে হয়ত। সেই সময় যদি কেউ তাদের কথা শোনে, যদি প্রফেশনাল ট্রেনিং আছে এমন মানুষ কথা বলে তাহলে কেউ কেউ ফিরে আসে সেই চিন্তা থেকে। অনেকেই একবারেই আত্মহত্যা করে না। অনেক মানুষ নিঃসঙ্গতায় ভুগতে পারে। যারা মানসিক কোনো অসুস্থতায় ভোগে তারা আরও বেশি চাপা স্বভাবের হয়ে যায়। সবার সাথে সব কথা শেয়ার করে না। আর যদি তার কথা শোনার মতো সত্যিই কেউ না থাকে তবে ব্যাপারটি আরও জটিল।

শুধু মানসিক অসুস্থতাই নয়, অনেক উঠতি বয়সের ছেলে মেয়ে মা-বাবার সাথেও সব কথা শেয়ার করে না। এজন্য বাচ্চাদের ছোট্টবেলা থেকে সব কথা মা-বাবা বা প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করা শেখানো অবশ্য কর্তব্য। যেসব ছেলে-মেয়ে হয়ত যৌক্তিক কারণেই ভীষণ ব্যস্ত মা-বাবা, বা সিংগেল প্যারেন্ট, সংগ ততটা পায় না তারা আরও বেশী ঝুঁকিতে। সুইসাইড হটলাইন যদি কোন কাজেই না দিতো তাহলে কি এমনি এমনি এসব কার্যকলাপ চলে উন্নত সমাজে?

যদি একটিও প্রাণ রক্ষা পায়, সেটাও কি কম কিছু? অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়েরা মানসিক অসুস্থতা, ড্রাগ নেওয়া, ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, অভিমান বা জেদ ছাড়াও আরেকটি কারণে আত্মহত্যা করে। বুলিইং। স্কুলে, অন্য জায়গায়, অনলাইনে (সাইবার বুলিইং), বন্ধুদের বুলিইং শিকার হয়ে আত্মহত্যা করা বাচ্চাদের বয়স কমতে কমতে নয় দশ বৎসরে গিয়ে ঠেকেছে! সমাজ, দেশ ভেদে আত্মহত্যা করা মানুষের “কারণ” কখনো কখনো ভিন্ন হতে পারে। বাংলাদেশে প্রেমে ব্যর্থ, বা প্রেমিক/প্রেমিকা ছেড়ে চলে গেছে এটা প্রায়ই শোনা যায়। এটাও উঠতি বয়সের হরমোনের কারণে। সেজন্য মা-বাবা-প্রিয়জনদের কিশোর বয়সী ছেলে-মেয়েকে শেখাতে হবে কী ভাবে জীবনে ব্যর্থতাকে, প্রেমেই হোক আর পরীক্ষায় ফল খারাপ করাই হোক, মোকাবেলা করতে হবে।

জীবন মানে সব ক্ষেত্রে সফলতা নয়। জীবনে সব কিছুতে কেউ এ+ পায় না। পরীক্ষায় এ+ না পেলেও জীবন শেষ হয়ে যায় না। জীবনটা অনেক বড়। আর যদি কেউ কোন মানুষের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা দেখেন তাকে বিচার না করে তার পাশে দাঁড়ান, চিকিৎসা করান। সময় দিন। চিকিৎসা সবার যে পুরো কার্যকরি হবেই তা নিশ্চিত নয়। কাউন্সেলিং সাহায্য করে। তবে সবার ক্ষেত্রেই শত ভাগ করবে তা নয়। মেডিসিনের বেলায়ও তাই। সবার সব মেডিসিন কাজে দেয় না। আর যেহেতু মানসিক অসুস্থতা কেউ শেয়ার করেন না, করতে পারেন না, এধরণের মানুষদের যুদ্ধটা আরও অনেক বড়। তাঁদের পাশে দাঁড়ানো ভীষণ জরুরি।

কেউ বলছে না আত্মহত্যাকে উৎসাহ দিতে, কিন্তু আত্মহত্যা প্রবণ মানুষকে বিচার করে তিরস্কার করা তাকে আরও বিষন্ন, নিঃসঙ্গ করে আত্মহত্যার দিকেই ঠেলে দেবে। আর যে আত্মহত্যা করেই ফেলেছে তাঁকে চুল চেরা বিচার করে কি তাঁকে ফিরিয়ে আনা যাবে? না তাঁর ঘটনা দেখে সবার সচেতন হতে হবে, চেনা জানা কেউ এই ঝুঁকিতে আছে কিনা, থাকলে কি ভাবে পাশে দাঁড়ানো যায়!

(কোন কোন ক্ষেত্রে আত্মহত্যা মানুষের অধিকার। যে রোগীর আর কোন চিকিৎসা নেই, তীব্র যন্ত্রণা কমানোর কোন উপায় নেই ইত্যাদি।)

শেয়ার করুন: