শান্তা মারিয়া:
আর তো সহ্য হয় না। একের পর এক শিক্ষিত মেয়ে আত্মহত্যা করছে। বললাম বটে শিক্ষিত, কিন্তু জীবনের প্রকৃত শিক্ষায় এরা শিক্ষিত হয়নি। অবশ্য শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গ্রামীণ-শহুরে, প্রান্তিক-মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত যেই আত্মহত্যা করুক সবারটাই দুঃখজনক। আত্মহত্যা নারী করলেও দুঃখজনক, পুরুষ করলেও দুঃখজনক। ইদানিং নারীর আত্মহত্যার খবর বেশি পাচ্ছি বলেই নারীদের নিয়ে বলছি। একই কথা সমভাবে পুরুষেরর জন্য প্রযোজ্য হতে পারে।

সাম্প্রতিক আত্মহত্যার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে মোটামুটি পাওয়া যাচ্ছে যে, আবেগগত টানাপোড়েন থেকেই মৃত্যুকে বেছে নিচ্ছেন এরা। প্রেমিক বা সাবেক প্রেমিক, স্বামী বা প্রাক্তন স্বামীর উপর অভিমান থেকে আত্মহনন। একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, জীবনের আনন্দ হারিয়ে ফেলা সেসব থেকে আবেগগত চূড়ান্ত কষ্ট এবং শেষ অবধি জীবন ত্যাগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। কেন বিষন্নতায় ভুগছেন এরা? বিশেষ করে নারীর এই মানসিক সংকটের কারণ কি? পারিবারিক ও সামাজিক চাপ, ক্যারিয়ারে আশানুরূপ উন্নতি না হওয়া, প্রেমিক বা স্বামীর নির্মমতা, হতাশা সবকিছু মিলিয়ে তাদের মনে হতে থাকে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াটা সহজ।
যারা প্রেমের কারণে আত্মহত্যা করার কথা ভাবছেন তাদের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলতে চাই, যদি তুমি জানো তোমার মৃত্যুতে সে খুব কষ্ট পাবে তাহলে তো সে তোমাকে ভালোই বাসে। আর যদি মনে করো সে তোমাকে ভালোবাসে না, তাহলে যে ভালোবাসে না তার জন্য নিজের জীবনটা ত্যাগ করার দরকার কী?
আসল কথা হলো এত প্রেম লইয়া আমরা মানে নারীরা কী করিবো? প্রেম খুবই বড়, জীবনের চেয়েও বড়, শুধু একদিন ভালোবাসা মৃত্যু যে তারপর, ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়—এসব ফিল্মি আবেগ ঝেড়ে ফেলুন। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। তেমনি নিজে বাঁচলে, এই তুচ্ছ জীবনটা বাঁচলে, তবে না প্রেমের জন্য দুঃখ কষ্ট, বিরহ বেদনা এসব আবেগ বাঁচবে। বেঁচে থাকলে দেখবেন, সালমান খান গেছে তো শাহরুখ খান দরজায় হাজির।
আর নিঃসঙ্গতা? সমাজের কাজে জড়িত হয়ে পড়লে নিঃসঙ্গতাও দুর হতে সময় লাগবে না। আমার জীবনটা একা আমার নয়। এটাকে যখন খুশি দিয়ে ফেলা যায় না। সমাজের প্রতি প্রত্যেকেরই দায়বদ্ধতা আছে। সমাজের মানুষের জন্য হলেও তো বাঁচতে হবে। পথশিশুদের জন্য কাজ করুন। কাজ করুন বৃদ্ধ, অসহায মানুষের জন্য। সময় কোন দিক দিয়ে কাটবে টেরই পাবেন না।
আর আগেও অনেকবার বলেছি আবারও বলছি, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্ম প্রতিষ্ঠানে, পাড়ায়, মহল্লায় দরকার কাউন্সেলিং সেন্টার। আমাদের সমাজে মানসিক রোগ ক্রমশ বাড়ছে। বিষন্নতা, হতাশা জেঁকে বসছে। এজন্য পেশাদার মনোচিকিৎসকের প্রয়োজন অনেক অনেক বেশি করে।
পাশাপাশি প্রয়োজন সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। কবিতা,গান,আবৃত্তি, নাটক ইত্যাদির চর্চা হওয়া দরকার সমাজের সর্বস্তরে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে হতাশা, একাকিত্ব অনেকটা দূর হয়। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার পরও অনেকে অবশ্য আত্মহত্যা করে। অনেক কবি সাহিত্যিক নাট্যকর্মী আত্মহত্যা করেছেন।সেজন্যই দরকার কাউন্সেলিং সেন্টার।
জীবনে আবেগ থাকবে। আবেগই জীবনকে গতি দেয়। কিন্তু তা যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আত্মবিধ্বংসী না হয়ে ওঠে। আজকাল ফেসবুক আছে। যখনই যার স্ট্যাটাসে ক্রমাগত হতাশার, বেদনার প্রকাশ দেখবেন, প্লিজ একটু সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দিন। প্রয়োজনে ফোন করে একটু খোঁজ নিন। ইনবক্সে জিজ্ঞাসা করুন, তার পাশে দাঁড়ান। মানুষই তো মানুষের জন্য।
আর রিলেশনশিপ নিয়ে জটিলতা থেকে হবু আত্মহত্যাকারীদের বলছি প্লিজ, মরার সিদ্ধান্ত নেবেন না। প্রেম বিষয়ে একটা সার সত্যি কথা শুনুন। অল্পবয়সে প্রেম হলো অ্যাসিডিটি। বুক জ্বালা, অনিদ্রা, ক্ষুধাহীনতা। আর বেশি বয়সে প্রেম হলো ক্যান্সার। মান সম্মান ক্ষয় করে ফেলে।
প্রেম নিয়ে তাই বেশি আবেগতাড়িত না হওয়াই ভালো। আর একটি কথা, যিনি মরে গেছেন, আত্মহত্যা করেছেন তাকে নিয়ে আমরা যেন অহেতুক বাজে মন্তব্য না করি। জীবনে তার পাশে বন্ধুত্বের, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারিনি, মৃত্যুতে তাকে অন্তত আমরা রেহাই দেই আসুন। আত্মহত্যাকারীর পথ অনুসরণীয় নয়, কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে সেই দুঃখী, অভিমানী মানুষটি যেন সহানুভূতির সঙ্গে স্মরণীয় হয়।