আমরা কি এতোই অসভ্য?

ফাতিমা জাহান:

আমার জাপানিজ বন্ধু শিনো বাংলাদেশে এসেছিলেন ৬/৭ বছর আগে। যারা ভ্রমন করেন নিয়মিত তারা সাধারণত কারো উপর নির্ভরশীল হয়ে ভ্রমন করেননা। তিনি নিজের মতো সিলেট, কক্সবাজার, কুয়াকাটা ইত্যাদি এলাকা একা ভ্রমণ করলেন। ফিরতি পথে আমরা বাসে করে একসাথে কলকাতা যাচ্ছিলাম। অনেক বিষয় নিয়ে আড্ডা চলছিল, কথা প্রসঙ্গে শিনো বলে উঠলেন যে, তিনি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বাংলাদেশের কোনো এক স্থানে।

আমি এতোই লজ্জা পেয়েছিলাম যে তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারিনি। পরে বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মী, নারীবাদীদের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার চেষ্টা করি, কিন্তু কেউ পর্যটকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আলোচনায় আগ্রহী নন।

ফাতিমা জাহান

মানছি যে আমাদের দেশে আমরা কোনো মেয়ের নিরাপত্তাই নিশ্চিত করতে পারছি না, সেক্ষেত্রে পর্যটকদের না টানাই ভালো। পর্যটন ক্ষেত্রও আমরা বিভিন্ন কারণে তেমনভাবে গড়ে তুলতে পারিনি, যদিও প্রাকৃতিক প্রাচুর্যপূর্ণ আমাদের এই দেশ। কিন্তু তাই বলে আমরা এটা কীভাবে মেনে নেবো যে বিদেশীরা আমাদের দেশ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে চলে যাক, আর পরবর্তীতে তাদের দেশের অন্য কাউকে এ দেশ ভ্রমণে উদ্বুদ্ধ না করুক?

একজন নারীবাদী সেলিব্রেটির সাথে বিষয়টি তুলতেই তিনি খেঁকিয়ে উঠলেন, “ওড়না না পড়ে কেন ঘুরতে এসেছে সেই মেয়ে? দেখো না যেই বিদেশী মেয়েই এই দেশে আসে, সেই প্রথমে আড়ং এ গিয়ে প্রথমে ওড়না কিনে।”

এই হলো আমাদের সেলিব্রেটি নারীবাদীর অবস্থা। সেলিব্রেটি নারীবাদীরা আপনাদেরই বলছি, আমাদের দেশে কিন্তু বহু মেয়ে ওড়না ছাড়াই রাস্তায় নির্দ্বিধায় চলাফেরা করেন। আমিও করি। আমি নিতান্ত সাধারণ মানুষ। আমার কথায় হয়তো বা সমাজ নড়েচড়ে উঠবে না, কিন্তু সমাজে নাম কামানো, দশজনের কাছে পরিচিত নারীবাদীদের এহেন পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবে আর কিছু না হলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ভিত যে আরো মজবুত হবে, সেটা একবার ভেবে দেখেছেন কী?

আর একটা বিদেশী মেয়েকে এদেশে এসে যে ওড়না পরতে হবে, সেটা কোন পুস্তকে লেখা আছে সেটা আমার জানা নেই। কিছু বিদেশী মেয়ে বাংলাদেশে ওড়না পরে কর্মস্থলে যান এবং কেন যান সেটা আমরা সবাই জানি। এতে সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। এটাও এক ধরনের চাপিয়ে দেয়া। ওড়না, হিজাব, বোরখা পরা মেয়েরা কি যৌন নির্যাতনের শিকার হোন না? অনেক স্বঘোষিত নারীবাদীকে বলতে শুনি তারা নারীবাদের ওপর লেখা বিশাল বিশাল পুস্তক পড়ে দারুণ জ্ঞান অর্জন করেছেন, আর সেই মুহূর্তেই যখন তিনি আরেকজন নারীর পোশাক নিয়ে (দেশে বা বিদেশে) কটাক্ষ করেন, তখন বিস্ময় চেপে রাখার জায়গা পাই না।

আমি নিজে সোলো ট্রাভেলার। সাধ্যমতো একা একা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মনের শখ মেটাই। একা ভ্রমণে অসুবিধার চেয়ে সুবিধা বোধ করি বেশি। কারো উপর নির্ভর বা অপেক্ষা করার নেই, কারো আমার জন্য অসুবিধাও সৃষ্টি হয় না। বাজেট ট্রাভেলারদের জন্য বিদেশে খুব কম খরচায় ভ্রমণ করার ব্যবস্থা আছে, এই যেমন ডরমিটরিতে থাকা বা সাধারণ মানের রেস্টুরেন্টে খাওয়া, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে নির্দ্বিধায় চলাফেরা করা ইত্যাদি।

অনেক বিদেশী পর্যটক আমার কাছে জানতে চান যে, বাংলাদেশ ভ্রমণে খরচ কেমন বা নিরাপত্তা কতোখানি দৃঢ়। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি তাদেরকে যে, এদেশে নারী-পুরুষ যে কাউকে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। একথা শুনে আমার এক ফরাসি বন্ধু বলেছিল, “তাহলে কী আমায় ফুলপ্যান্ট আর ফুলহাতা শার্ট পরতে হবে বাংলাদেশে আসলে?”

গত বছর হাইকোর্টের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। যানজটের কারণে রিক্সা থেমে ছিল এক জায়গায়। দেখলাম ফুটপাথ ধরে একটি শ্বেতাঙ্গ ছেলে হাঁটতে হাঁটতে  চারপাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছে। দৃশ্যটি আমার জন্য খুবই স্বাভাবিক। আমি নিজে ভ্রমণে গেলে পায়ে হেঁটে একটা শহর বা গ্রামের কিছু অংশ দেখে নেই। কিন্তু সেই ছেলেটির জন্য সেই হাঁটার অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল কিনা জানি না। আশপাশ থেকে প্রতিটি মানুষ তাকে দেখে চিৎকার করে ছুঁড়ে দিচ্ছিল  “হাই, হাউ আর ইউ” বা এ জাতীয় কিছু শব্দ, যা পাশের দেশ ভারত বা নেপালের সাধারণ মানুষ করে না। মানুষজনের এহেন আচরণে আমার নিজের বিরক্ত লাগছিল, ছেলেটিকে শান্তি মতো একটা জায়গা দেখার অধিকার আমরা কেড়ে নিয়েছি। ব্যক্তি স্বাধীনতা চিনতে শিখিনি। আমরা তাহলে এতোই অসভ্য?

অনেকের সাথে কথা বলতে গিয়ে তাদের এ ধরনের মানসিকতার পরিচয় পেয়েছি, “বিদেশীরা বেড়ালে বেড়াক, ওরা অসভ্য। আমাদের মেয়েরা কেন দেশে-বিদেশে অকারণে ঘুরে বেড়াবে, এসব করলে পড়ালেখা, চাকরি, ঘরসংসার করবে কে!” তারা প্রগতিশীল তাই পড়ালেখা, চাকরি ইত্যাদিও উল্লেখ করেন। কিন্তু আমি ব্যথিত হই তখনই যখন দেখি মেয়েরাও সেই তথাকথিত প্রগতিশীলদের তালে তাল মিলাচ্ছে।

আমি এই সব মেয়েদের বুঝিনা, এতো সুন্দর সুন্দর প্রগতির কথা বলে, অথচ পেছনে সেই পিতৃতন্ত্রের বুলি আওড়ায়। কতো অভাগা আমরা যে এখনো পার্থক্যটাই ধরতে পারি না। বা পার্থক্য ধরতে পারলেও মুখের উপর দু চার কথা শুনিয়ে দিতে পারি না। এখনেও মেয়েরা কত পরাধীন!

খানিকটা সোলো ট্রভেলিং এর কথায় আসি। আমাদের দেশের কোনো ছেলে বহু বছর বিদেশে থাকলেও একা ভ্রমণ করতে ভয় পান, অনেকেই একথা শেয়ার করেছেন আমার সাথে। দেশে থাকা প্রগতিশীল ছেলেদের অনেকেরই বাইরের জগত সম্পর্কে ধারণা নেই, তাই তাদের প্রসঙ্গ নাই বা তুলি। কেন ছেলেরা ভয় পান বা কেন মেয়েরা একা ভ্রমণের (এখানে ভ্রমণ বলতে বুঝিয়েছি একা কোথাও যাওয়া, সেই জায়গাকে চেনা, কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ/মাস থাকা, তারপর ফিরে আসা। কোন কাজের জন্য নয়, শুধুই ভ্রমণের জন্য) কথা চিন্তাই করতে পারেন না?

ছোটবেলা থেকেই আমাদের (ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে) বিভিন্ন জিনিষের ভয় দেখানো হয়ে থাকে যেমন, অন্ধকার, ভূত প্রেত, জ্বীন পরী, তেলাপোকা, ইঁদুর, ডাক্তার, পুলিশ, ডাকাত ইত্যাদি যেগুলোকে আদৌ ভয় পাবার মতো কিছু নেই। ভয় দেখাতে দেখাতে এবং ভয় পেতে পেতে আমরা নতুন কিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। আমাদের সহজাত তখন হয়ে যায় পুরনোটাকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা। আমরা এটাও ভাবতে শুরু করি যে বাইরের পৃথিবীতে সব ধরনের অমঙ্গল ছড়িয়ে রয়েছে।

আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে একটি শিশুকে খুব সহজেই দাবিয়ে রাখা যায়। শৈশব থেকে আমাদেরকে সমাজ দাবিয়ে রাখে, আমাদের শিশুসুলভ প্রশ্নের উত্তর আমরা পাই না, পড়ার সময় স্বাধীনভাবে পড়ার অনুমতি নেই, মানসিক বিকাশের অনুমতি নেই, আমাদের স্বাধীনভাবে খেলার মাঠ নেই, বাইরে বের হতে পারি না বাচ্চা চুরি হয়ে যাবার ভয়ে। এই করে করে আমাদের বুদ্ধির বিকাশ যে চুরি হয়ে যাচ্ছে সে খবর কি কারো আছে?

আমাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশেও পড়ছে বাধা। অভিভাবক চান সন্তান তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী পড়ালেখা, চাকরি, জীবন সংগী নির্বাচন ইত্যাদি করবে, সন্তানের ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছুই থাকতে নেই। কারো হয়তো বা কর্পোরেট চাকরির চেয়ে সমাজসেবার কাজ বেশি পছন্দ, কারো ডাক্তার হবার চেয়ে খেলাধুলায় বেশি আগ্রহ। নিজেকে নিজের ইচ্ছেকে বলী দিয়ে আমরা পরাধীন থেকে যাই শেষ নিঃশ্বাস ফেলা পর্যন্ত।

ভ্রমণ যে মানুষকে বিকশিত করে সেটা আমি নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি। বিভিন্ন দেশ বা জাতির সাথে পরিচয় জ্ঞানবৃদ্ধির সাথে সাথে আরো সভ্য, রুচিশীল, মার্জিত, সহনশীল হবার পথ খুলে যায় (এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছেন যারা ভাল জিনিষ গ্রহন করতে চান না হাজার প্রগতির মাঝে থাকলেও। তাদেরকে অসভ্যের ট্যাগ লাগানো ছাড়া আর উপায় থাকে না)।

নিজেরা সভ্য হলে অন্যদের শ্রদ্ধা করার পথও খুলে যায়। তাই আসুন নিজেদেরই প্রশ্ন করি, “আমরা কি এতোই অসভ্য?” প্রশ্ন করতে শিখলে উত্তরও পাওয়া যাবে।

শেয়ার করুন: