একটি বিজ্ঞাপন ও ডমেস্টিক ভায়োলেন্স: কষ্ট পাবো, নাকি রাগ হবো?

ফারজানা শারমীন সুরভি

জুঁই তেলের বিজ্ঞাপনটি নিয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন মানুষের পক্ষ এবং বিপক্ষের যুক্তি পড়লাম। একটা যুক্তি হচ্ছে, “মারধর খেয়ে সংসার করে যেতে হবে – চিরাচরিত এ ধারণাকেই সকলের মধ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করছে বিজ্ঞাপনটি/পাষণ্ড স্বামীর সাথে মানিয়ে থেকে যাবার কৌশল বাতলে দিচ্ছে”।

তো আমি বিজ্ঞাপনটাকে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স এর সারভাইভর এর প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করেছি।

আমি আমেরিকার একটা শহরে ভিক্টিম সেন্টারে কাজ করি। সেই সুবাদে ডমেস্টিক ভায়োলেন্স নিয়ে বিভিন্ন কনফারেন্স এবং ট্রেনিং এ যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। একবার একটা ট্রেনিং এ খুব বিরক্ত হয়ে আমি ইন্সট্রাক্টরকে বলেছিলাম-“এই মেয়েগুলার কি সেলফ রেস্পেক্ট নেই? নিজেরা চাকরি-বাকরি করে। ৯১১ এ কল দিলে পুলিশ এসে তাকে প্রটেক্ট করবে। তারপরেও দিনের পর দিন এরা স্পাউসের কাছে মার খেতেই থাকে। এদের সমস্যাটা কী?

ফারজানা শারমীন সুরভি

তখন ইন্সট্রাক্টর আমাকে যা বলেছিলো, সেটা সারা জীবন মনে থাকবে।

“ফারজানা, মানুষের সাইকোলোজি খুব কমপ্লেক্স। দিনের পর দিন মার খেতে খেতে এই মেয়েগুলার সেলফ এস্টিম এতো লো হয়ে যায় যে ওরা ভাবে নিশ্চয়ই আমিই কিছু করেছি। আমার দোষেই আমি মার খাচ্ছি। তখন ওরা প্রটেস্ট করে না। ওদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। আবার, ধরো অনেকের ফিনান্সিয়াল অবস্থা অনেক খারাপ থাকে। সে হয়তো চাকরি করে। কিন্তু তার ছেলে-মেয়েদের ফিনান্সিয়ালি হেল্প করার মতো টাকা তার নেই। তখন তার কোপিং মেকানিজম হয়- “হাজবেন্ড এর মার খাওয়া এবং নিজের বাচ্চাদেরকে প্রোটেক্ট করা”।

“ফারজানা! প্লিজ একটা জিনিস মনে রাখবে, ভিক্টিমের উপর কখনো রাগ করবে না। কে, কীভাবে স্ট্রাগল করছে, তুমি জানো না। অনেক সময় ভিক্টিম এসে বলবে, আমি আমার হাজবেন্ড এর কাছে আবার ফেরত যেতে চাই। তখনও রাগ হবে না। তাকে কাউন্সেলিং করবে। কারণ, তুমি তার স্ট্রাগলটা জানো না।”

হ্যাঁ! আমি ভিক্টিম এর উপর রাগ করি না। জুঁই তেলের এই বিজ্ঞাপন বাজারে প্রচলিত “আপনার সংসার সুখের হবে, যদি আপনি এই তেল লাগান”-এই কনসেপ্ট এর বিপরীতে গিয়ে, একজন ভিক্টিম মেয়ের সেলফ ব্লেমিং সাইকোলোজি তুলে ধরছে। আমি এটাতেই খুশি।

https://www.youtube.com/watch?v=Lp2h583f1NQ

আজকাল নারী নির্যাতনের কথা বললে, লোকজন পুরুষ নির্যাতনের কথা শোনান (তথাকথিত “প্রগতিশীল মানুষ” রাও এই কাজ করেন)। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে, যখন কালো মানুষেরা পুলিশের গুলিতে মারা যাচ্ছে শুধু কালো হওয়ার কারণে- আর প্রতিবাদ করছে “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার”। তখন হোয়াইট সুপ্রিমিস্টরা হাজির হয়- “অল লাইভস ম্যাটার” স্লোগান নিয়ে।

বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের কথা বললেই, বাংলাদেশের লোকজন পুরুষ নির্যাতনের কথা শোনায়। সেই দেশে একটা তেলের বিজ্ঞাপন এ যখন বাংলাদেশের নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান বলে, তখন আমি খুশি হই। আমি জানি, দেশে রাতারাতি বিপ্লব হবে না। কিন্তু একটু একটু করে যদি এই পরিবর্তনগুলো শুরু হয়, তাহলেই হয়তো একদিন বিপ্লব হবে। আজকে জুঁই তেলের একটা বিজ্ঞাপন প্রথম ডমেস্টিক ভায়োলেন্স এর সমস্যাটাকে স্বীকার করে নিল, যেখানে আমাদের সমাজ এই ইস্যুতে এখনো প্রব্লেম ডিনায়াল বা সমস্যাকে অস্বীকার করার “উটপাখি সিনড্রম” এ  ভুগছে। আমি এটাতেই আশাবাদী। একসময়, জুঁই তেলের বিজ্ঞাপন এর ট্রেন্ড ছিল তাহসান আর মিথিলা অভিনীত সেই বিরক্তিকর খুনসুটি। যেখানে তাহসান এমনিতে স্ত্রী মিথিলাকে পাত্তা দেয় না। কিন্তু যেই মিথিলার ঘন লম্বা চুল দেখে, তখন সে গান গাওয়া শুরু করে। চুলে হাত দেয়। মানে কতোটা অপমানজনক একটা বিজ্ঞাপন! আমার চুল লম্বা আর সুন্দর হলেই, আমার সঙ্গী আমাকে পাত্তা দিবে! না হয়, মুখ ফিরিয়ে রাখবে। কী সুপারফিশিয়াল কনসেপ্ট! সেখানে এই নতুন ধারার বিজ্ঞাপন একটা পরিবর্তন তো বটেই!

আমার এক বন্ধু একটা দারুণ কথা বলেছে। “লম্বা চুল সিম্পলি খোঁপা করে বেঁধে উল্টো ব্যাটাকে পিটিয়ে দেয়া দেখালে বেটার হতো না?”। হ্যাঁ, এটা দেখালে অবশ্যই ভালো হতো। একটা সমাধান দেয়া হতো। বিজ্ঞাপনটাতে সমস্যা আছে। কিন্তু সমাধান দেয়া নেই। তবে এ ব্যাপারে আমার মনে হয়,  সব ভিক্টিম এরকম প্রতিবাদ শুরুতে করতে পারে না। সময় লাগে। ডে ওয়ান থেকেই এই সাহস অনেকের হয় না। ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হয়ে যাওয়া একটা মানুষের উঠে দাঁড়াতে সময় লাগে।  

একটা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স এর কনফারেন্সে গিয়েছিলাম। কী নোট স্পিকার ছিলেন Susan Still নামের একজন উইমেন রাইটস একটিভিস্ট। তিনি নিজেই একসময় ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের ভিক্টিম ছিলেন। ১২ বছর ধরে Susan Still এর স্পাউস তাকে এবিউজ করেছে খুব নিষ্ঠুরতার সাথে, শারীরিক এবং মানসিকভাবে। ১২ বছর পরে অবশেষে তিনি সাহস করে বেরিয়ে এসেছেন। এবিউজার “স্বামী” এর বিরুদ্ধে কেস করেছেন। এবং ঐ এবিউজার এর ৩৬ বছরের জেল হয়েছে। Susan Still এর স্পিচ শুনে আমি বুঝতে পারছিলাম যে, আমি কতোটা ভুল ছিলাম। আমি সব সময় ভাবতাম, “মেয়েরা কেন মুখ বুঁজে সহ্য করে? পালটা মার দেয় না কেন?”। বিষয়টা আসলে এতো সহজ নয়। সবার মানসিক ক্ষমতা একরকম থাকে না। আমার মানসিক ক্ষমতা দিয়ে আমি যদি সবাইকে বিচার করি, তাহলে সেটা ভুল।

Susan Still সেই কনফারেন্স এ বলেছিলেন,

“আমাকে প্রায়ই মানুষ বলে-কেন তুমি ১২ বছর ধরে অত্যাচার সহ্য করেছো? আমার এক্স হাজবেন্ড আমাকে মেরে আমার বাচ্চাকে দিয়ে ওই মারধরের ভিডিও করেছিল। আমি যখন সাহস করে প্রতিবাদ করলাম, তার অনেক পরে একদিন আমি ওই ভিডিও দেখছিলাম। আমাকে লোকটা মেরেই যাচ্ছে। মেরেই যাচ্ছে। ৫১ মিনিট ধরে আমাকে রুথলেসলি মেরেই যাচ্ছে। আর আমি মার খাচ্ছি। আমি ভিডিও দেখে চিন্তা করছিলাম, এই ভিডিওতে যে মেরুদণ্ডহীন মেয়েটাকে মার খেতে দেখা যাচ্ছে – সেই মেয়েটা আমি? কীভাবে আমি এরকম মেরুদণ্ডহীন হয়ে গিয়েছিলাম? কীভাবে? দেখো, আমি যখন বিয়ে করি- আমি ভালোবেসে আঠারো বছর বয়সে আমার প্রিন্স চার্মিংকে বিয়ে করেছিলাম। ডে ওয়ান থেকে সে আমাকে মারেনি। প্রথমে ব্যাপারটা ছিলো এরকম- “তুমি এই বড় গলার জামাটা পরো না। তুমি তোমার ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিতে যেয়ো না। আমি তো তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তাই আমার জেলাস লাগে”।

ধীরে ধীরে ব্যাপারটা দাঁড়ালো, “তোমার মায়ের সাথে তুমি আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না। ওই মহিলাকে আমি পছন্দ করি না।” তারপরে, “তুই তো হোয়াইট স্লাট। তোর কলিগদের সাথে তুই শুচ্ছিস, আমি শিওর। এইসব কী ফাকিং খাবার রান্না করেছিস, মুখে দেয়া যায় না”।

তারপরে শুরু হলো, আমাকে মারধর করা। আমার বাচ্চাদেরকে শেখানো যে, আমি একজন ইনএফিসিয়েন্ট মা। এইভাবে ধীরে ধীরে ব্যাপারগুলো হয়। আর আমি খালি প্রাণপণ চেষ্টা করতাম, নিজেকে সংশোধন করার। আমার মনে হতো, আমারই সব দোষ। আমার ডিপ্রেশন আর আমার লো সেলফ এস্টিম আমাকে বলতো, আমি সবকিছু ঠিক করে করতে পারছি না দেখে আমার ‘প্রিন্স চার্মিং’ রাগ হচ্ছে। আমি সবকিছু ঠিক করে করতে পারলেই, আবার আমার একটা হ্যাপি ফ্যামিলি হবে। সবকিছু ঠিক হবে তখন। এমনকি আমি যে কতোটা দুর্বিষহ অমানবেতর অবস্থায় আছি- এটা আমি নিজেও বুঝতাম না।

ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের ভিক্টিম অন্য কোনো মেয়েকে যখন দেখতাম, ভাবতাম- ‘আহারে! কি কষ্ট মেয়েটার’! অথচ আমি নিজেই যে এই অবস্থায় আছি, এটা বুঝতে আমার এক যুগ লেগে গেলো। আমি চাকরি করতাম। আমার হাজবেন্ড চাকরি করতো না। আমার টাকায় সংসার চলতো। তাও আমি মার খেয়ে গিয়েছি। রিয়েলাইজ করিনি যে, আমাকে উঠে দাঁড়াতে হবে। প্রতিবাদ করতে হবে। কারণ আমার ডিপ্রেশন- লো সেলফ এস্টিম। প্লিজ, ভিক্টিম এর উপর রাগ করো না কখনো। তাকে অভিযুক্ত করো না, কেন সে প্রতিবাদ করেনি”।

তাই এই বিজ্ঞাপন দেখে আমার ভিক্টিম/সারভাইভর এর জন্য কষ্ট লাগে। হ্যাঁ, এখানে সমাধান টাও দেখানো যেত। তবে সমস্যাটাতে যে ফোকাস করেছে, ভিক্টিম এর সেলফ ব্লেমিং সাইকোলোজি “চুল ধরে মেরেছে-তাই চুলই কেটে ফেলতে হবে”, শেষে নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান-এইসব দেখিয়েছে। এটাও তো পুঁজিবাদী এবং পুরুষতান্ত্রিক বিজ্ঞাপন এর পৃথিবীতে অন্যরকম কিছু। প্রতিদিন প্রতিটি ক্ষণে একজন ডমেস্টিক ভায়োলেন্স এর ভিক্টিম নারীকে তার হাজবেন্ড/ সঙ্গী বলে, “সব তোমার দোষ! আমি তো এমনিতে তোমাকে মারি না! কিন্তু তুমি মাঝে মাঝে এমন সব কাজ করো!”

ভিক্টিম নারীকে ইনএফিসিয়েন্ট বলে বলে- তাকে ওয়ার্থলেস বলে বলে- তার কুৎসিত সমালোচনা করে করে- সেই নারীর মোরাল ভেঙ্গে দেয় এবিউজার। তখন সেই ভিক্টিম নারীটি আর সেই মানুষটি থাকে না, যাকে সবাই আগে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন একজন নারী হিসেবে চিনতো। সেই নারীটি রূপান্তরিত হয় মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পরা এক জোম্বিতে। তাই জুঁই এর এই বিজ্ঞাপন দেখে আমার রাগ হয় না। কষ্ট হয় ভিক্টিমের জন্য।

এবিউজাররা বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করে ভিক্টিমদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। যেমন, প্রথমেই ভিক্টিমকে তার পরিবার আর বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে। বলে, “আমি তোমাকে এতো ভালোবাসি যে, সবসময় তোমার সাথেই থাকতে চাই”। বা ক্রমাগত ভিক্টিম এর পরিবার আর বন্ধুদের নিয়ে আজেবাজে কথা বলতে থাকে। বা ভয় দেখিয়ে- জোর জবরদস্তি করে তার পরিবার ও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে দেয় না।

এবিউজারের উদ্দেশ্য থাকে, ভিক্টিম এর সাপোর্ট সিস্টেম ধ্বংস করা। একটা পর্যায়ে গিয়ে এবিউজার যা বলে, ভিক্টিম তাই বিশ্বাস করা শুরু করে। কেননা, কোনো পরিচিত মানুষের সাথে তার আর যোগাযোগ থাকে না।

দ্বিতীয়ত, অনেক এবিউজার নিজের সন্তানদেরকে ব্যবহার করে ভিক্টিমকে নিয়ন্ত্রণের জন্য। তারপরে, অনেক এবিউজার মারধর করে ক্ষমা চায়। বলে, “আর কখনো এরকমটা হবে না। আমি সরি”। তারপরে আবারো একই কাজ করে। তাই ভিক্টিম-এবিউজার এর রিলেশনের ডাইনামিক্সস অনেক কমপ্লেক্স।

শুধু ভিক্টিম কেন প্রতিবাদ করে না বললে, আসলে ভিক্টিম এর ব্যাপারে জাজমেন্টাল হওয়া হবে। আগে থেকেই দুঃখী মেয়েটিকে আবারো নতুন করে কষ্ট দেয়া হবে। তাকে লজ্জিত হতে হবে তার “দুর্বল ব্যক্তিত্বের” জন্য। তাই ভিক্টিমের অবস্থা, তার অসহায়ত্ব বোঝার চেষ্টা করা উচিত। তার পরিবার এবং বন্ধুদের  কাউন্সেলিং করতে হবে যেন, বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে সে বের হয়ে আসে। যেন সে আইনি সহায়তা নেয়।

শেষ করছি “The Victim Center” এর ট্রেনিং ম্যানুয়াল এর “Understanding the Dynamics of Domestic Violence” থেকে একটা কোটেশন দিয়ে-

“People who have never experienced abuse often find it difficult to imagine why women do not leave and how the abuse can continue for years. Relationships almost never start out abusive. It is important to remember that love and intimacy precede the abuse, which can make it difficult to break away. Abusive relationships are not violent all the time. There are periods when a woman is reminded why she fell in love with her partner. Abusers effectively weave together intimacy and abuse to control their partners. Women who have been battered sometimes express confusion about the recurring nature of the violence they experience in their relationship. It seems to them to be unpredictable and impulsive. Domestic violence, however, is neither random nor haphazard. It is a complex pattern of increasingly frequent and harmful physical, sexual, psychological and other abusive behaviors used to control the victim. The abuser’s tactics are devised and carried out precisely to control her”.

 

শেয়ার করুন: