জেসমিনা:
কেমন যেন বিরক্তি আর রাগ নিয়ে প্রশ্নটা করলাম- -“কেন বিয়ে করেছো এই লোকটাকে?” কিন্তু প্রশ্নটা করে ওর মুখের দিকে তাকাতেই মেয়েটির নিরুত্তর, ছলছল দৃষ্টি দেখে অপরাধবোধে ভরে গেল মনটা।
মেয়েটির নাম শেফালী (ছদ্মনাম) , বয়স বড় জোর ২০\২১ বছর। স্বামীর চিকিৎসার খরচ কমাতে আমার দপ্তরে তার আসা । ওর স্বামীর বয়স ৩৭ বছর । ওদের বিয়ের বয়স ৫বছর, আর ৭ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মেয়েটির স্বামীর কোমরের ডিস্ক ভেঙ্গে যায়, আর কোমরের নার্ভের সমস্যায় লোকটির নিচের অংশ অবশ হয়ে গিয়েছে। সুতরাং বিবাহিত জীবনের অন্যতম প্রধান যে শর্ত শারীরিক মিলন, সেটিতে শেফালীর স্বামী অক্ষম। মোদ্দা কথা, কনজ্যুগাল লাইফ বলতে কিছু নেই মেয়েটির। বিয়ের দিন থেকেই পঙ্গু মানুষটার সেবা করছে। সহজ বাংলায়, পঙ্গু লোকটির সেবা করার জন্যেই স্ত্রী নামে মেয়েটিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

কেসটা দেখে সুস্থ স্বাভাবিক এসএসসি পাশ মেয়েটিকে প্রশ্নটা করে ফেলেছিলাম। মেয়েটি বললো, ওরা চারজন বোন, আর শেফালী সবার বড়। শেফালীর বাবা নিম্ন আয়ের কেরানি। দারিদ্রতার মাঝেই তাদের বড় হওয়া।
শেফালীর শ্বশুর এলাকায় মোটামুটি ধনী লোক। শেফালীকে তার ছেলের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য শেফালীর বাবাকে চার লক্ষ টাকা দিয়েছে। তাহলে কী দাঁড়ালো? চার লক্ষ টাকার বিনিময়ে শারীরিকভাবে অক্ষম লোকটির কাছে মেয়ে বিক্রি করে দিয়েছে বাবা!!
আর শারীরিকভাবে অক্ষম পুরুষের সাথে শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ কোনো মেয়ের বিয়ে কি ধর্মমতে সঠিক?
আর এই মেয়ে দিনের পর দিন নিজের শারীরিক চাহিদা চেপে রাখতে রাখতে যদি কখনো সমাজের ভাষায় অবৈধ, ধর্মের ভাষায় ব্যভিচার নামক সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, তাহলে তো শেফালীকেই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে আমাদের সমাজে, তাই না?
শেফালীর বাবার অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য কি শেফালী দায়ী!! নিম্নবিত্ত পরিবারে চার কন্যার আবির্ভাব যে ছেলের আশায়, তা বোঝাই যাচ্ছে। বড় পরিবারের খরচ চালানো, মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো, তাদের বিয়ে দেবার সামর্থ্য শেফালীর বাবার নাই, তাই মেয়ে বিক্রি করেছে।
শেফালীর শ্বশুর ছেলের দেখাশোনার জন্য টাকার বিনিময়ে পার্মানেন্ট লোকের ব্যবস্থা করেছে। শেফালীর স্বামীও খুশি। কারণ বউ নামক বস্তুটার সাথে যেমন আচরণ করা যায়, বাড়ির মাইনে দেয়া ঝিয়ের সাথেও কিছুটা সমঝে আচরণ করতে হয়। ঝি চাইলে চলে যেতে পারে, কিন্তু বউ পারে না। দরিদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হলে আরো না। সমাজের চাপ আর চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে এরা পারে না। যদি পারতো, তবে তো বিয়েটাই হতো না।
আমরা ধর্মের দোহাই দেই অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েদের শোচনীয় অবস্থার জন্য, কিন্তু ধর্মের সঠিক বিশ্লেষণে বিয়েটাই কি বৈধ হয়েছে?
আসলে আমাদের সমাজে শেফালীদের জন্মানোই তাদের পাপ। ছোটবেলা থেকেই ছাড় দিতে দিতে সংগ্রাম করতে করতে শেফালীরা এক সময় চরম ঔদ্ধত্য আর নৈতিকতাহীন হয়ে যায়। তখনও আমরা তাদের দিকেই আঙ্গুল তুলি, কিন্তু দায়ী কে?
যে সমস্ত নারী নিষ্পেশিত এই সমাজ ত্যাগ করতে পেরেছেন, তারা তুলনামূলক ভালো আছেন। কিন্তু শেফালীদের সেই উপায়ও নেই। অজস্র শেফালী আমাদের সমাজে আছে যাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই।