বিয়ের পর মেয়েরা পাল্টে যায়, এই রকম কথাই এক ভাই বললেন তার বন্ধু সম্পর্কে। বিয়ের সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সেই বন্ধুর বউ তার হাতে বাজারের লিস্টি ধরিয়ে দেয়। বিয়ের আগে তাদের প্রেম ছিলো। মেয়েটি কী সুন্দর করে কথা বলতো, আর এখন বাজ়ারের লিস্টি।
দিনা ফেরদৌস
মেয়েদের নিয়ে এই জাতীয় বহু অভিযোগ আমরা প্রায়ই শুনি। আগে ছিলো এক রকম, এখন অন্য রকম। কথা হচ্ছে বিয়ের আগে যখন তারা প্রেম করতো, তখন প্রাত্যহিক কাজের বাইরে তাদের দুজনকেই সময় বের করে নিতে হতো। দেখাদেখি শেষে দুজনই যার যার ঘরে চলে যেতো। সেই ঘরে কেউ না কেউ বাজার করে, রান্না করে, আরও অনেক কিছু করে, সংসারে যা যা করতে হয়। বাইরে দেখা করতে আসা দু’জন মানুষ ক্ষিদে পেলে বড়জোর রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতে পারে। কিন্তু সংসার জীবনে ঢুকে কোনো মেয়ের পক্ষেই বলা সম্ভব না যে, আসো ‘স্বামী’ নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে সারাদিন দুজনে গল্প করি। ক্ষিদে লাগলে প্রতিদিন রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাই।
সব সংসারেই কিছু দায়িত্ব থাকে। শারীরিক সুখ-অসুখ থাকে। সর্দি-কাশি, বমি, ডায়রিয়ার মতো রোগ হয়। মানসিক দায় যন্ত্রণাও থাকে। যেই পুরুষটি আগে শার্ট ইন করে পারফিউম লাগিয়ে দেখা করতে আসতো, সে এখন খালি গায়ে লুঙ্গি পরে হাঁটে চোখের সামনে। যে মেয়েটি বাছাই করা জামা পরে, মেকাপ করে আসতো, সে এখন আউলা চুলে থাকে বাসার জামা পরে।
মোট কথা সম্পর্কের ধরন-ই যেখানে বদলে গেছে, সেখানে পাল্টে যাওয়াই তো স্বাভাবিক। এরপর যদি যৌথ পরিবার হয় তো কথাই নেই। যখন বলা হয়, আজ থেকে এইটা তোমার সংসার, তখন থেকেই পরিবর্তনের শুরু। শাশুড়ির ডায়াবেটিস আছে, রেগে গেলে সামলে চলতে হবে (ডায়বেটিস না থাকলেও কিছু না কিছু একটা থাকবে, যাতে বৌকে সব সময় দৌড়ের উপর রাখা যায়)। ননদটা একটু পাগলা টাইপের, বুঝে না কিছুই (ওইদিকে বয়স পঁচিশ/ছাব্বিস চলে), মাথায় তুলে রাখতে হবে।দেবরটা অস্থির টাইপের, টেবিলে সময় মতো খাবার না পেলে সারা ঘর মাথায় তোলে।
এইসব মানিয়ে চলার মানে বুঝতে হবে শিকল পরানো হচ্ছে। সব মেনে নিচ্ছেন তো ডিমান্ড বাড়তেই থাকলো। শুরু হলো বাচ্চা নিতে ইমোশনালি টর্চার। মেনে নিলে তো কথা নেই। মেনে না নিলে আত্মীয়-প্রতিবেশি সবাই জানবেন বউটি কী পরিমাণ খারাপ! বাচ্চা নিলেন, তো শারীরিক সৌন্দর্যও কিছুটা হারালেন। সেই প্রেমিক বা অপ্রেমিক স্বামী সাহেবও পাল্টাতে থাকলেন।
একই ঘরে একই বিছানায় প্রতিদিন যেহেতু নতুন কিছু পাবার নেই, তাই কিছু দেবার তাগিদও নেই ওখানে। রূপ যেখানে আর আকর্ষণ করে না, গুণ সেখানে আচল। বৌয়ের ভুলগুলিই শুধু চোখে পড়ে। বউ এটা বোঝে না, ওটা শোনে না। আজ কালকার মেয়েরা কতো এগিয়ে। চাইলেই সব করতে পারে (এসব বলবেন বউকে ছোট করার ধান্দায়, আর নিজে সাজবেন প্রগতিশীল স্বামী)। এগিয়ে যেতে হলে যে স্পেস দেয়া দরকার, তার এক চুলও ছাড় দেবেন না।
এই সমাজে থেকে যেইসব নারীরা এগিয়ে যান, আমি বিশ্বাস করি তারা পরিবার থেকে বহু সাপোর্ট পান। যারা সার্পোট ছাড়া এগোন, তারা বহু কিছুর সঙ্গে আপোস করেই এগোন। সাপোর্ট পেলে তারা হয়তো আরো বেশি এগুতে পারতেন।
যারা এইসব একসেপশন্যাল উদাহরণ দেন, তারা যখন মেয়েটির ঘাড়ে এইসব দায়িত্ব তুলে দেন তখন একবারও জানতে চান না মেয়েটি কী চায়।
পড়াশোনায় আগ্রহী প্রত্যেক মেয়েই নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে স্বপ্ন দেখে। বিয়ের পর নতুন সংসারে সব মেয়েই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ভালোবাসা কামনা করে। স্বামীকে নির্ভরযোগ্য বন্ধু ভাবতে চায়, সহযোগিতা চায়, প্রেম কামনা করে শারীরিক ও মানসিকভাবে। সময়ের সাথে সাথে যার উল্টোটাই ঘটে।
একসময় রূপ, গুণ, ধৈর্য্য, সাহস কমতে থাকে। মনে দুর্বলতা বাসা বাঁধে। তখন বুঝানো হয় মেয়েরা আসলে পুরুষদের থেকে দুর্বল।
কোনো পুরুষকে যেমন বাচ্চা পেটে রেখে জন্ম দিতে হয় না, তেমনি শাশুড়ি-ননদ সামলে চলতে হয় না, বা বাইরে গেলে ঘরের টানও করতে হয় না মেয়েদের মতো। সমাজে বদনামের ভয়ও নিতে হয় না। আর এইসব যে চলার পথে পুরুষকে কতটা শক্তি, সাহস জোগায়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অবশেষে বলবো, মেয়েরা বদলায় না, বদলাতে চায় না। তাদের বদলে যেতে বাধ্য করা হয়। বদলে যাওয়ার জন্য চারপাশে পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়।