কাম্রুন নাহার (রুমা):
শেষ কবে আমি কোনো সিনেমা দেখে উথালিপাথালি কেঁদেছিলাম মনে পড়ে না। তবে সেদিন আমি টিন এজারদের মতো কেঁদেছিলাম, ভারতীয় ফিচার ফিল্ম ‘সানাম তেরি কসম’ দেখে। বলা বাহুল্য সবাই খুব ভালো অভিনয় করেছেন। অনেকেই নাকি কেঁদেছেন এই সিনেমা দেখে। সেই অনেকের সবাই ১৩ থেকে ২২ এর মধ্যে। তাদের সাথে বয়সের তুলনায় আমার কান্নাটা একটু অস্বাভাবিক বৈকি! আসলে কান্নাকাটির গল্প করার জন্য আমি বসিনি। এই সিনেমায় বদলে যাওয়া সরস্বতী পার্থ সারথীর মতো বদলে যায় এবং বদলে যেতে পারে সরস্বতীদের কথাই আমি বলতে বসেছি।

শুদ্ধ ব্রাহ্মণ, দুধে আলতা গায়ের রঙ, মেধাবী (ছবির একটি জায়গায় তাকে এনসাইক্লোপিডিয়া বলে উল্লেখ করা হয়) এবং সর্বোপরি চাকুরিজীবী হওয়া সত্ত্বেও সরস্বতীর বিয়ে হয় না শুধুমাত্র সে তথাকথিত আধুনিকা নয় বলে। আধুনিকতার মাপকাঠিটা ছবিতে খুব সংকীর্ণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এখানে আধুনিকতাটা ছিল শুধুই নায়িকার ফুলহাতা সালোয়ার কামিজ থেকে প্যান্ট শার্ট এবং কোঁকড়া থেকে স্ট্রেইট করা চুল পর্যন্ত। আর তাতেই অল্পদিনের মধ্যে তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে। আত্মসম্মানের ধার না ধেরে মেয়েটিও বিয়েতে রাজি হয়ে যায় (আগে থেকেই ছেলেটির প্রেমে পড়েছিল তাই হয়তো)।
এটা মূলত প্রেমের ছবি, কিন্তু প্রেমটাকে একপাশে রেখে একটু অন্যভাবে ভাবলে নিজ সংস্কৃতিকে ‘ডিনাই’ করার ম্যাসেজটিও উঠে আসে, যেটাকে আসলে এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই। এবার সিনেমা থেকে একটু বাস্তবে আসি।
আমি রোজ পোশাক বদলে, চুল কেটে আধুনিকা হয়ে যাওয়া মেয়েদের দেখি। আমার ক্যাম্পাসে দেখি , পাশের বাড়িতে দেখি, পাশের ফ্ল্যাটে দেখি, শপিং মলে দেখি, ফেসবুকের বন্ধু তালিকায় দেখি। গ্রাম বা মফঃস্বল থেকে পড়তে আসা মেয়েটিকে দেখি এক সেমিস্টারের ব্যবধানে সালোয়ার – কামিজ ছেড়ে জিন্সের প্যান্ট – ফতুয়াতে ঢুকে যাচ্ছে, লম্বা চুল কেটে ঘাড়ে তুলে আনছে, ভারী মেকআপে মুখ ঢেকে ফেলছে, হিজাব এবং বোরকা খুলে আঁটসাঁট পোশাক পরে ঘুরছে এবং ঘুরছে একজন বন্ধুর হাত ধরে। সালোয়ার-কামিজে ঢেকে থাকার কারণে প্রথম সেমিস্টারে যে মেয়েটির কোনো ছেলে বন্ধু ছিল না, দ্বিতীয় সেমিস্টারে সেই মেয়েটিই ‘সো-কলড’ বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে ঘুরছে এবং অনেকের ভাষায়, জাতে উঠে যাচ্ছে!
আমি পোশাকে তথাকথিত সেকেলে। ফুল হাতা সালোয়ার-কামিজ পরি, শাড়ি পরি। আমার লম্বা চুল, সেগুলোকে টেনে একটা হাত খোঁপা করে রাখি, ববি ক্লিপ লাগিয়ে একটা বেণী করে রাখি, মাঝে মাঝে চুলে তেল দিয়েও বাইরে বেরিয়ে যাই। আবার সেকেলে ফ্রেমের একটি চশমাও আমি পরি। আমার গায়ের রঙ কালো এবং সেটিকে ঢেকে রাখার জন্য আমি কোনো মেক আপও ব্যবহার করি না। মজার ব্যাপার হলো, এতে আমি একফোঁটাও হীনমন্যতায় ভুগি না। আমাকে সালোয়ার-কামিজ পরা অবস্থায় দেখে বেশ কবছর আগে এক টেলিভিশন সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন, আমি জিন্সের প্যান্ট-শার্ট পরি কীনা; উনি আমাকে তার চ্যানেলে ক্রীড়া প্রতিবেদক হিসেবে নিয়োগ দেবার কথা ভাবছিলেন। শেষে নিয়োগ দেননি । ওনাকে ধন্যবাদ। উনি আমাকে নিয়োগ না দিয়ে সেদিন আমার অনেক বড় উপকার করেছিলেন।
আমি ক্রীড়া প্রতিবেদক থাকা অবস্থায় খুব আধুনিকা ছিলাম! কারণ আমি তখন জিন্সের প্যান্ট-শার্ট আর ফতুয়া পরতাম! এখন তাহলে ক্ষেত কেন? মানুষের কাজের ধরনের উপর অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার পোশাকের ধরন নির্ভর করে। একজন মেয়ে আলোকচিত্রীর জন্য শাড়ির তুলনায় জিন্সের প্যান্ট – ফতুয়া অনেক বেশি ওয়ার্ক ফ্রেন্ডলি পোশাক। একজন শিক্ষিকার জন্য শাড়ি (আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে) আমার মতে সবচেয়ে আদর্শ পোশাক, সালোয়ার-কামিজেও কোনো সমস্যা নেই। যারা এক্সট্রিম লেভেলের কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করেন, তারা দেখা যায় ফরমাল প্যান্ট আর ব্লেজারও পরছেন।
হ্যাঁ, অনেকে বলবেন, এগুলো তো অনেকটা ইউনিফর্মের মতো, হ্যাঁ, আমিও তাই বলছি। কিন্তু তাই বলে শাড়ি পরে ছবি তোলা যাবে না, সালোয়ার-কামিজ পরে অফিসে যাওয়া যাবে না বা জিন্সের প্যান্ট –ফতুয়া পরে একজন শিক্ষিকা ক্যাম্পাসে যেতে পারবেন না, সেটা কোথাও লেখা নেই। কিন্তু তারপরও আমরা অনেকেই এমনটা করি না। সংস্কৃতি, জলবায়ু একটা দেশের মানুষের পোশাক ঠিক করে দেয়। আর তাই তাতেই সবাই অভ্যস্ত হয়। তার মানে এই নয়, আমি ঠিক করে দেয়া পোশাকের বাইরে যেতে পারবো না।
কিন্তু আমার পোশাক যদি হয় আমার আধুনিক হবার মাপকাঠি, তাহলে আমার আপত্তি আছে। যে মন মনন আর মেধায় স্মার্ট, সে সব পোশাকেই আধুনিক এবং স্মার্ট। আমি পেশাগত কারণেই প্যান্ট-শার্ট পরতাম, এখন একই কারণে শাড়ি পরি; শাড়ি আমার প্রিয় পোশাকও বটে। কিন্তু সবসময় পরার জন্য ফুলহাতা সালোয়ার-কামিজই আমার প্রধান পোশাক। এতে যদি কেউ আমাকে ক্ষেত ভাবে তবে সেটা তার সমস্যা, আমার নয়।
আধুনিক হতে হবে মন, মনন আর মেধায়, পোশাকে নয়। যে ছেলে একটি মেয়েকে শুধু তার পোশাক দেখে তার সাথে খাতির করতে আসে, তার থেকে নিযূত হাত দূরে থাকতে হবে। একজন সত্যিকারের মেধাবী, স্মার্ট, ভাল ছেলে বিয়ের বা প্রেমের জন্য কক্ষণও পোশাক বদলানো স্মার্ট মেয়ের সন্ধান করে না। সে ভাবনা চিন্তায় স্মার্ট, আধুনিক এবং সত্যিকারের মেধাবী একজনকেই বেছে নেয়; কারণ সে জানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই মেয়েটি নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে।
ফুলহাতা জামা মানেই অনাধুনিক নয়, জিন্সের প্যান্ট ফতুয়া মানেই আধুনিক নয় – আধুনিকতা সেই মেধায়, যে মেধা জানে ফুলহাতা সালোয়ার কামিজকে কীভাবে ‘কেরি’ করতে হয়। আর সবচাইতে বড় আধুনিকতা হচ্ছে, নিজের সংস্কৃতিকে লালন করতে পারার মানসিকতা, মৌলিকতাকে ধারণ করতে পারার মানসিকতা।
সানাম তেরি কসমের ইন্দ্রর (ইন্দার) মতো সব ছেলে নয়। ইন্দ্র একজন তথাকথিত আধুনিকাকে ছেড়ে সালোয়ার কামিজে ঢাকা সরস্বতীর প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ ছেলেই তথাকথিত আধুনিক গার্লফ্রেন্ড খোঁজে – যে আধুনিকতা শুধুই পোশাক সর্বস্ব। শুধুই পোশাককে মূল্য দেয় এমন ছেলের জন্য বদলে যাওয়া কতোটা যৌক্তিক?
(সানাম তেরি কসম ছবিটিকে উদাহরণ হিসেবে না টানলেও হতো, কিন্তু যাদের জন্য এই লেখাটি তারাই এই ছবিটির মূল দর্শক)।