দুর্ঘটনা, খুন না মানুষ মারার লাইসেন্স?

শান্তা মারিয়া: লেখাটি পড়ার আগে একটু চোখটা বন্ধ করুন। আমার মনে পড়ছে একসারি মুখ। আলমগীর কবীর, আহীর আলম, জাহানারা কাঞ্চন, নাফিয়া গাজী, বাপী শাহরিয়ার, সাবিয়া, ইউসুফ পাশা, মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদ, জগলুল হায়দার চৌধুরী, আবদুল্লাহ ফারুক, ফারজাত, আরও অনেক অনেক নাম। অনেক প্রিয়জন। অনেক বন্ধু।  আপনার অনেক আপনজন, যার নাম আমি জানি না। আমার অনেক আপনজন, যাদের নাম আপনি জানেন না।

কিন্তু আমরা এক জায়গায় সমব্যথী। যেখানে আমরা হারিয়েছি প্রিয় মানুষদের। হারিয়েছি সড়ক দুর্ঘটনায়। দুর্ঘটনা? না খুন? বেপরোয়া যানবাহন চালিয়ে মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা কি খুন নয়?

আপনাদের কি মনে আছে হুমায়ূন আহমেদের কৃষ্ণপক্ষ উপন্যাসটির কথা? যেখানে মুহিবের মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায় শুধুমাত্র চালকের খামখেয়ালিতে? সদ্য বিবাহিত অরু স্বামী মুহিবের মৃত্যুশোক সারাজীবনেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মনে আছে শংকরের ‘একদিন হঠাৎ’ উপন্যাসের কথা? যেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত প্রিয় স্বামীর শবদেহ দেখে স্ত্রী শুধু বলছিলেন, ওর গায়ে একটু মলম মাখিয়ে দাও, ও অনেক ব্যথা পাচ্ছে।

আপনাদের কি মনে পড়ছে উপন্যাস নয়, বাস্তব কিছু ঘটনা? যেখানে শাহবাগের মোড়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে গাড়ি চাপা দেয় বাস ড্রাইভার। শুধু তাই নয়, তখন বাসটি না থামিয়ে (থামালে মেয়েটি বেঁচে যেত) সে ওর মাথার উপর দিয়ে চাকা উঠিয়ে তাকে দলে-পিষে বেরিয়ে যায়। হেল্পার তখন চালককে বলছিল, ‘টাইনা যান ওস্তাদ, থামায়েন না’।

আরও উদাহরণ দিচ্ছি। উত্তরায় একটি সিএনজি অটোরিকশা চালকের সঙ্গে এক বাসচালকের তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে বাসচালক বলে, তোকে পিষে মারবো। এবং সত্যিই সে সিএনজি চালককে পিষে মেরে ফেলে।

ফারজাতের কথা একটু ভাবুন। কাভার্ড ভ্যানের সাথে ধাক্কা লাগার পর যদি বাসটি থামতো তাহলে তরুণ ছেলেটি বেঁচে যেত। তার বন্ধুটিও একই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এখন পঙ্গু হওয়ার পথে, সে জানেও না ফারজাত নেই।

এমন শত শত ঘটনা ঘটছে, ঘটেছে, এবং ভবিষ্যতে ঘটতে থাকবে। কোনো প্রতিকার নেই।

যে মিরু ড্রাইভারের দণ্ডাদেশ নিয়ে এতো কাণ্ড সেও তো প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে ওই নারীর উপর ট্রাক উঠিয়ে দিয়েছে। তাকে পিষে মেরেছে। মামলার বিবরণেই এ তথ্য জানা গেছে। সেই খুনিকে বাঁচাতে যে কাণ্ডটা হলো, সেটা কী আন্দোলন না নৈরাজ্য? বাস, ট্রাকের মতো গণপরিবহন এবং প্রাইভেট কার যারা চালান, তাদের অনেকেরই যে লাইসেন্স নকল, সেকথা তো ওপেন সিক্রেট। যাদের আসল লাইসেন্স আছে তারা কতখানি যোগ্যতায় আর কতখানি ঘুষে সেই লাইসেন্স পেয়েছে, সেটাও কারও অজানা নয়।

প্রাইভেট জেট প্লেন আমাদের নেই। ঢাকা কক্সবাজার প্লেনে না গিয়ে যারা সড়ক পথে যান, তারা একটু চিন্তা করুন তো সেই যাত্রাপথের আতংক। মিরপুর থেকে মতিঝিল, রামপুরা থেকে গুলিস্তান, উত্তরা থেকে যাত্রাবাড়ি যারা যাতায়াত করেন তারাও একটু ভাবুন প্রতিদিনের মৃত্যুভয়ের কথা।

দুর্ঘটনা বিশ্বের সবদেশেই ঘটে। কিন্তু বেপরোয়া চালনার কারণে এমন বাছবিচারহীন মৃত্যু কি সবদেশে ঘটে?

আন্দোলন শব্দটি কলুষিত করে ফেলেছে এরা। ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন হয়। আর আবদার মেটানোর জন্য, অন্যায্য আবদারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যা করা হয়, সেটা হলো নৈরাজ্য। ভাবখানা হলো, ‘আমরা যেভাবে খুশি গাড়ি চালাবো, মানুষ মরলে মরবে, না মরলে না মরবে, আমাদের কিছু বলা যাবে না। বললেই সারাদেশ অচল করে দিব’। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে একি অন্যায় আচরণ? আর সেই নৈরাজ্যে যখন মদদ দেয় একজন জনপ্রতিনিধি, তখন কী বলার থাকে?

ধর্মঘট তারা উঠিয়েছে। কিন্তু আবার মানুষ মেরে আবার যে ধর্মঘট করবে না তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই। আসুন, এবার আমরা পথে নামি। আমরা পথে নেমে নিরাপদ চালনার দাবি জানাই। প্রতিদিন দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছেই। এই প্রাণহানি তো বন্ধ করতে হবে। আর কত মৃত্যু দেখবো?

শেয়ার করুন: