তানিয়া কামরুন নাহার
ক্ষণিকা বাসের কায়েস মামা হঠাৎ পোস্টারিং করা শুরু করলো, “মামা ডাকবেন না“। পোস্টার দেখে আমরা মুখ টিপে হাসলাম। মামা, ডাক তবুও থামেনি। কেউ মামা ডেকে ফেললেই কায়েস মামা উত্তেজিত হয়ে কথা শুনিয়ে দিতো, “মামা ডাকবেন না। ‘ভাই’ ডাকেন, নাহয় শুধু ড্রাইভার ডাকেন।”
মামার কথা শুনে আমাদের আরো হাসি পেতো। কেউ কেউ আরো বেশি করে মামা ডাক শুরু করলো, কেউ কেউ কিছুই ডাকতো না এরপর। ক্যাম্পাসের যত কর্মচারী, রিক্সাওয়ালা, ঝালমুড়ি, ভেলপুরি, আচার মামাদের বরাবর মামা–ই ডেকে এসেছি। হঠাৎ কায়েস মামার এতো আপত্তি কেন হলো, এটা জানা যায়নি।
বন্ধুদেরকেও “মামা“, বেশি উচ্ছ্বাসে “মাম্মাআয়ায়া” ডাকার চল ছিল। বন্ধুদের কেন মামা ডাকতাম, এটাও জানি না। মেয়েদেরকে ছেলেরা “মামী” ডাকার চেষ্টা করতো এই যুক্তিতে, “আমরা যদি মামা হই, তাহলে তোরা কী?” যদিও এই মামী ডাক হালে পানি পায়নি, মামা টিকে গিয়েছে। হাল আমলে এই “মামা” হয়ে গিয়েছে ‘ড্যুড‘ আর ‘ব্রো‘!

ছোট্টবেলায় মায়ের হাত ধরে যখন মার্কেটে যেতাম, ডাক শুনতাম ‘বাবু‘। একটু বড় হবার পর দোকানিরা আমার মাকে ডাকতো ‘আন্টি‘ আর আমাকে “আপু“। এই আপু ডাক শুনে খুব ভালো লাগতো, নিজেকে বড় বড় মনে হতো। আরও কিছুদিন পর লক্ষ্য করলাম দোকানিরা আমার মাকে ‘বড় আপু‘ আর আমাকে ‘ছোট আপু‘ বলে ডাকছে। দিন আরো গড়ালো। দোকানিরা আমাকে খালাম্মা আর আমার মাকে আপু ডাকা শুরু করলো। পথেঘাটে বের হলে আমার অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা প্রায় ‘আন্টি‘ বলে সম্বোধন করে।
বয়স বাড়ছে, কিছুদিন পর নানী দাদী ডাক শোনার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছি। ফেবুতে কে জানি আমাকে খুব “আন্টিপু” বলে কয়দিন ডাকলো।
ছেলেদেরকে “ভাইয়া” বলে ডাকলে তাদের যে বুক ভেঙ্গে চৌচির হয়ে যায়, সে কথা ফেবুর ট্রল দেখেই প্রথম জানতে পেরেছি। আমাদের সময়ে “ভাইয়া” ডাক নিয়ে এমন ক্লাইম্যাক্স ছিল না। অবশ্য কোনো কোনো অতি বুদ্ধিমান “ভাইয়া” ডাক এড়ানোর জন্য জুনিয়র সেজে বসে থাকতো। মেজাজ খারাপের চূড়ান্ত হতো, যখন দেখতাম সেই ‘জুনিয়র‘ আপু ডাক না ডেকে বেয়াদবের মতো নাম ধরে ডাকছে।

বাচ্চাদের মায়েরা একে অপরকে ‘ভাবি‘ বলে সম্বোধন করে। কিন্তু কখনোই বাচ্চাদের বাবারা একে অপরকে “দুলাভাই” বলে সম্বোধন করে না। সম্ভবত কেউ কারো শ্যালক হতে চায় না। কিন্তু বাচ্চাদের মায়েরা অতি সহজেই একে অপরের ভাবি ও একই সাথে ননদ হয়ে যেতে পারে। বাচ্চাদের মায়েদের শুধু নারীরাই নয়, অন্য পুরুষেরাও অনেক সময় “আপা“র বদলে “ভাবি” বলে সম্বোধন করে থাকে। কিন্তু ব্যাপারটা খুব বিরক্তিকর হয়ে যায় কোন অবিবাহিত নারীর বেলায়।
ইদানিং একটা বাজে সমস্যায় মেয়েরা প্রায় পড়ে। বাসের ভাড়া চাইতে এসে কন্ডাকটর তাদেরকে “চাচী” বা “ভাবি” বলে সম্বোধন করে। আপা বা খালা সম্বোধন না করেই গণহারে এরকম চাচী/ভাবি ডাকের সংস্কৃতি হঠাৎ কোথা থেকে এলো? নাকি ঈভ টিজিং এর ধরন পাল্টাচ্ছে? এসব ক্ষেত্রে কন্ডাকটরকে প্রশ্ন করি, আপনার কোন চাচা/ভাইকে আমি বিয়ে করেছি?
এক কন্ডাকটর মামার যুক্তি ছিল, যারেই বিয়া করবেন, সে আমার চাচা হইবো।
এই পর্যায়ে এসে আমার কায়েস মামার কথা মনে পড়ে যায়।