পুরুষকে নাকি ‘কাঁদতে নেই’!

নাসরীন মুস্তাফা: পুরুষ কাঁদে কি? কারোর যদি কান্না পায়, তারপরও যদি না কাঁদে, তবে তা এক ধরনের শাস্তি। কেঁদে মন উজাড় করে দিলে শান্তি পাওয়া যায়, এ হচ্ছে কান্নার পক্ষে যুক্তি। এবং বেশ ভাল যুক্তি। আবেগ অবদমন মনের অসুখ বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আর ভাল কোনো ফল আনে না।

এই অকাট্য যুক্তি বলে দিচ্ছে, পুরুষের কান্না পায়, কেননা পুরুষরাও মানুষ। এরপরও পুরুষকে কাঁদতে দেয় না যে সমাজ, সে সমাজ পুরুষের তৈরি হতে পারে, তবে তা পুরুষের পক্ষের নয়, একথা হলফ করে বলা যায়।

নাসরীন মুস্তাফা

নিত্যদিনকার জীবনে পুরুষের চোখে কান্না জমিয়ে তোলার উপসর্গ কি নেই একেবারেই? আছে। তবে নিত্যদিনকার জীবনযাপনে পুরুষকে ‘পুরুষ’ সেজে থাকতে বাধ্য করে যে সমাজ, সে সমাজ উপসর্গগুলোকে জীবাশ্মে পরিণত করবে ঠিকই, সমাধান দেবে না। ওদিকে পুরুষকে কাঁদতেও দেবে না। এ কী অন্যায়!

এর অর্থ, সামাজিক অন্যায়ের শিকার হচ্ছে পুরুষ। এরপরও পুরুষ যদি সেটা টের না পায়, তবে পুরুষের জন্য করুণা করতেই হবে। পুরুষ কেবল সে যে পুুরুষ, সেটা টের পাবে, সে মানুষ কি না টের পাওয়ার জন্য কাঁদতে পারবে না, এ হওয়া উচিত নয়।

আচ্ছা, প্রতিদিনের জীবনে পুরুষ কিভাবে টের পান যে তিনি একজন পুরুষ? সমাজের উদাহরণগুলো এরকম- পুরুষ মজুরি বেশি পাচ্ছেন, কোম্পানির সিইও হতে পুরুষ বলেই তাকে বেশি যোগ্য মনে করা হচ্ছে, সাফল্যের জন্য অন্য কোনো যোগ্যতা প্রদর্শন করতে হয় না, যেমন- বসের সাথে ডিনারে যাওয়া বা শরীর দেখানো, এমনকি পুরুষটি মডেল হলেও তাকে অহেতুক দৃষ্টিকটুভাবে শরীর দেখাতে হয় না। গৃহসন্ত্রাসের শিকার হতে হলেও তার সংখ্যা অনেক কম, গৃহকর্মে তার অংশগ্রহণ আবশ্যিক নয়।

কেবলমাত্র পুরুষ বলে তাকে যৌন নিগ্রহের শিকার হতে হয় না, হলেও খুব কম সংখ্যায়। মাঝ রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে চাঁদের আলোয় ঘুরে বেড়াতে তার কোনো সমস্যা নেই বলে জীবনকে উপভোগ করতে তিনি বেশি পারঙ্গম। কেবলমাত্র ‘ওয়াই’ ক্রোমোজোম থাকার ফলেই পুরুষের এতো ‘সুবিধা’ ঘটছে।

এরপরও পুরুষ অধিকার আন্দোলন গড়ে উঠছে দিকে দিকে। Men’s Rights Activists বা MRA থেকে আওয়াজ ওঠে, ‘আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস কেন নেই? এটা কি যৌনবাদী আচরণ নয়?’ কেউ বা বলেন, আমরা পুরুষবিদ্বেষী সমাজে বাস করছি। Ghost Bastards নামের একটি হলিউডি চলচ্চিত্র দেখলে পুরুষবিদ্বেষ কী জিনিষ, টের পাবেন। ১৯৮০ সালের দিকে নির্মিত এই কমেডি ছবিতে কোন পুরুষ অভিনেতা ছিল না।

সুখী নারী দিবস কি বিশ্বব্যাপী পুরুষের হতাশাকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করছে না? পুরুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করছে, যা সামাজিক সমস্যা, মানসিক সমস্যাও বটে, আর এর সাথে নারীবাদের সব সময় সম্পর্ক নেই। বেকারত্ব, অর্থনৈতিক ব্যর্থতায় পুরুষের আত্মহত্যার হার বেশি, যেকোনো যুদ্ধে নারীর চেয়ে পুরুষকে নিহত হতে হয় বেশি সংখ্যায়। পুরুষ নিজেই যতো পুরুষকে হত্যা করছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে পারেনি নারী এখনো। পুরুষের সমস্যার সাথে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়ার দরকার না পড়লেও আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের কি সত্যিই কোন দরকার নেই?

কন্যাশিশুর সাহায্যে সমাজ-রাষ্ট্র যতোটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তার পাশাপাশি ছেলেশিশুর বেলায় কোনো কার্যক্রম কি নেওয়া যেত না? যেন মানুষ হতে আগ্রহী কন্যারাই, পুত্ররা অমানুষ হলেও ক্ষতি নেই। নারী নির্যাতনের মামলায় নারীর পক্ষে শক্ত আইন থাকলেও মিথ্যে নারী নির্যাতনের মামলায় ফেঁসে যাওয়া পুরুষের পক্ষে কথা বলার কেন কেউ থাকবে না?  

আমার টুইটার বন্ধু এন্থনি গলি গি স্বীকারোক্তিমূলক টুইট করলেন, যা এরকম- পুরুষের সাথে সম্পর্ক করতে চায় না, এমন অনেক মেয়েদেরকে আমি দোষ দেই না, কেননা আমাদের অনেকেই আসলে ‘আবর্জনা’।

পুরুষকে ঘৃণা করার অধিকার আছে নারীর, এরকম কথাও শুনেছি, জেনেছি মিজান্ড্রি (Misandry) নামে একটি শব্দ আছে ইংরেজি ভাষায়, যার অর্থ বাংলায় হতে পারে ‘পুরুষবিদ্বেষী’, কেবল ভাবটা এরকম – পুুরষকে অপছন্দ, অবজ্ঞা অথবা পুরুষের (পুুরুষ লিঙ্গের) বিরুদ্ধে বদ্ধমূল কুসংস্কার আর এর ব্রান্ড একটাই, তা হচ্ছে নারীবাদ।

মিজান্ড্রি একটি সিনড্রোম, যাতে আক্রান্তজন নারীই হবে, এমন কথা নেই, পুরুষও হতে পারে। আবার ‘নারীবিদ্বেষী’ (Misogynist) হতে হলে পুরুষই হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। নারীও কখনো কখনো নারীবিদ্বেষী হয়ে ওঠে, যদি এই সিনড্রোম-এর ভূত তার ঘাড়ে চাপে।

নারীর অধিকার সচেতনতা নারীবাদের মূল বক্তব্য হলেও মিজান্ড্রি নারীবাদের তীরটাকে পুরুষের প্রতি ঘৃণা মিশিয়ে ছুঁড়ে মারতে আগ্রহী, মিসোগোনিস্ট নারীবাদকে মানবাধিকারের সমর্থক ভাবে না, বরং এক চোখা দৃষ্টিতে আগুন ঝরিয়ে নিজেকে অবচেতনভাবেই বানিয়ে ফেলে ‘নির্যাতক সমাজের সমর্থক’, কখনো কখনো ‘নির্যাতক’। এর ফলে নারীবাদ তথা মানবতাবাদ হারিয়ে যায়, নারী নিজেও নিজেকে নারীবাদের সমর্থক বলতে চায় না, কেননা মিজান্ড্রি আর নারীবাদকে গুলিয়ে ফেলে নারীবাদের পিঠে ছুঁড়ে মারা তীরটাকেই মিজান্ড্রি এর জয়ের পতাকা বানিয়ে ফেলে।

মানবতাবাদ কেবলি পুরুষবাদে পর্যবসিত হয়ে পুরুষকে আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ফেলে দেয়, যদি তা আক্রান্ত হয় নারীবিদ্বেষ সিনড্রোমে। দুই রোগের একই লক্ষণ, কেউ তখন স্পষ্টভাবে বলতে পারে না, পুরুষের প্রতি ঘৃণা নয়, অবজ্ঞা নয় নারীর প্রতিও, কেননা অধিকার সচেতনতায় নারী আর পুরুষ একই লড়াইয়ের সৈনিক।

এই লড়াইয়ের বিরুদ্ধ পক্ষ নারী আর পুরুষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে নিজেদের ফায়দা লোটে, সমর্থন জানায় ‘নির্যাতক’ সমাজকে, যে কিনা লিঙ্গের বিচারে পুরুষ হতে পারে, হতে পারে নারীও।  

হে নারী, কিছু পুরুষের কৃতকর্মের জন্য কেন সমগ্র পুরুষ জাতিকে দোষারোপ করতে হবে? এই চর্চা বন্ধ হতে হবে নারীবাদের স্বার্থে। জুতা যদি পায়ে ঠিকঠাক না লাগে, তাহলে এটা পরো না। চান্স যদি লেগে যায়, জুতা পায়ে এঁটে যেতেও পারে। চান্স নিতে চাইলে নাও, না নিতে চাইলে অন্য কাজে মন দাও। শুরু করো একদম শুরু থেকে।

একই কথা পুুরুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জুতা পায়ে পরতেই হবে বলে টানটানি করে ছিঁড়ে ফেলাটা কাজের কথা নয়। যে বীণায় সুর বাজছে না, তা সরিয়ে রাখাই ভালো, তাকে মেরে-কেটে বাজাতে হবে কেন?

যতো যাই বলুন না কেন, জীবনের হিসেবটা মধ্য বয়সে মেলে ধরলে সুন্দর একটি গোছানো সংসার, মধুর দাম্পত্য জীবন, সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্মানজনক পেশা, ভাবনাহীন ভবিষ্যত, সন্তানের সাফল্য ধরা পড়লে জীবনটাকে সার্থক মনে হয়। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের পরিকল্পনা আমরা করি না বলেই তরুণ বয়সে বুঝি না মধ্য বয়সে হিসেব মেলাতে পারার তৃপ্তি কতো বড়।

এই হিসেব একা পুুরুষ মেলাতে পারে না, নারীও না। পরিকল্পিত জীবনে আগ্রহী নারী-পুরুষ হাতে হাতে রেখেই পথ চলে। তখন পুরুষ কেবল এইটুকু আওড়ায় না- সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে। কেননা, এর পরের লাইনটা জানতে হবে তাকেও-গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে। কাজেই নারীও নিশ্চয়ই কেবল দ্বিতীয় লাইনের ভরসায় নিজেকে গুণবতী করার প্রসঙ্গটা এড়াতে পারবে না। সংসার সুখের করতে হলে যার যার ভূমিকা মানতেই হবে।  

এরপরও বিশ্বজুড়ে একই প্রথা, মাতৃতান্ত্রিক সমাজ যখন টিকে ছিল তখনও ‘নির্যাতনকামী’ সামাজিক চশমায় পুরুষের গুরুত্ব বেশি দেখা হয়েছে। এই প্রথা নারীর জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যদিও সে পুরুষের পাশে থাকছে, তবুও। কিছু বিষয় নারী পুরুষের চেয়ে ভাল পারে, কিছু বিষয়ে পুরুষ পারে ভাল। নারীর ব্রেন আর পুরুষের ব্রেন গঠনগত দিক দিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা বলেই এমনটি সত্য হয়েছে। আর তাই নারীর কাছ থেকে পুরুষ শিখুক, নারীও শিখুক পুরুষের কাছ থেকে।

‘নির্যাতক’ সম্প্রদায়কে হারিয়ে দিতে হলে নারী আর পুরুষকে সত্যিই পরস্পরের পরিপূরক হতে হবে, শিখতে হবে, শেখাতে হবে। মনে রাখতে হবে এই বিশ্বটা আমাদের, নারী আর পুরুষের, ‘নির্যাতক’ সম্প্রদায়ের নয়। পুরুষকে গুরুত্ব বেশি দিয়ে তাকে নির্যাতকে পরিণত করা বা বঞ্চিত নারীকে সুযোগ পেলে প্রতিশোধের ওসিলায় নির্যাতক হয়ে উঠতে দেওয়া কাজের কথা নয়।

একটু খেয়াল রাখা প্রয়োজন, কোথাও আবার নারীকে গুরুত্ব বেশি দিয়ে তাকেই নির্যাতক বানানো হচ্ছে না তো? মুখ বুঁজে থাকা পুরুষ ভেতরে আগ্নেয়গিরি পুষতে পুষতে কোন একদিন কি ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজছে? এই হিসাব থেকে বেরিয়ে আসার একটাই উপায়, নারী আর পুরুষ প্রতিপক্ষ না হয়ে পরস্পরের পরিপূরক হয়ে ওঠার শিক্ষা নিতে হবে।

নির্যাতক সমাজ পুরুষকে ‘শ্রেষ্ঠ’ ভাবতে শেখায়, তখন পুরুষ নারীকে নিজের অধীনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ কিছু একটা মনে করে ধর্ষণ করে এবং এর চেয়েও খারাপ কথা হচ্ছে, এই ধর্ষণকে সে মোটেও খারাপ কাজ বলে মনে করে না। নির্যাতক সমাজ নারীকে শেখায়, পুরুষ শরীরের তাড়নায় এরকম করে বসে। ধর্ষক পুরুষ বলেই শ্রেষ্ঠ আর তার শারীরিক তাড়নায় করা ধর্ষণ খারাপ কাজ হলেও নিজেকে আত্মাহুতি দিতে দড়ি খোঁজে ধর্ষিতাই।

আবার এই নির্যাতক সম্প্রদায় নারীকে সুযোগ পেলেই পুরুষের মতো ‘ছায়া শ্রেষ্ঠত্ব’ ধারণ করে নির্যাতনে উদ্বুদ্ধ করে। আর তাই বাসার বাচ্চা কাজের মেয়েটার উপর গৃহকর্ত্রী তার শ্রেষ্ঠত্ব ফলান, কখনো স্বামীর উপর ফলান, কখনো আর কারোর উপর। নারী ধর্ষনে অক্ষম হলেও পুরুষের ধর্ষণে সহায়তাকারী হয়ে ধর্ষিতাকে ফুসলিয়ে আনে, ধর্ষকের মা ধর্ষিতার পাশে না দাঁড়িয়ে নিজের ছেলেকেই বাঁচিয়ে দিতে তৎপর হয়।  

ধর্ষণের শিকার পাঁচ বছরের শিশু পূজাকে সমাজ নির্বিঘ্নে বড় হতে দেবে না, ক্রমাগত উত্যক্ত করতে থাকবে, যাতে সে কিছুতেই ভুলে না যায় ধর্ষণের কষ্ট, যাতে সে বড় হয়ে পুরুষ দেখলেই মনে করে সব পুরুষ সেই ধর্ষকের মতো। হায়, বড় হয়ে পূজা হয়তো নারী হবে, তবে কোনো পুরুষের হাতে হাত রাখতে ওর মন চাইবে না। হাত বাড়িয়ে ধরা যায়, এমন চমৎকার পুরুষ পূজার চোখ চিনবে না। ‘নির্যাতক’ পরিচয়ের আড়ালে পুরুষ হারিয়ে যাক্, নারী হারিয়ে যাক্, তা কাম্য হতে পারে না। কিছুতেই না।

বিষাক্ত পুরুষ আছে বৈকি। তেমনি আছে বিষাক্ত নারীও। পুরুষ কি যৌন হেনস্থার শিকার হয় না? শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয় না? মানসিকভাবে হয় না উপহাসের শিকার? ক্লাসের শান্তশিষ্ট ছেলেটিকে ‘মেয়েলি’ বলে তাচ্ছিল্য করে কী ছেলে বন্ধুরাই? মেয়েরাও করে। মারকুটে, মুখ খারাপ করা ছেলেদের বান্ধবীভাগ্য ভালো, এও তো শুনি।

আবার ডানপিটে মেয়েটাকে ‘ছেলেদের মতো’ বা ‘পুরুষালি’ বলে ঠেলে ফেলতে মেয়েদের সময় লাগে না। এরকম মেয়ের প্রেমে পড়ার জন্য ছেলেদের মন টানে না। এই যে সেরেনা উইলিয়ামস, বিশ্বের অন্যতম সেরা টেনিস খেলোয়াড়, তাকে শুনতে হয় ‘খুব বেশি পুরুষালি’ বিশেষণ। জন্মকালীন শিক্ষা এ নয়, কেননা নারী আর পুরুষ একইভাবে জন্ম নেয়। পৃথিবীতে এসে ‘ভ্যাঁ’ করে কেঁদে ফেলা শিশুর কান্না একই রকম, ছেলে শিশু আর মেয়ে শিশুর কান্নায় কোন ভিন্নতা নেই। বড় হতে হতে, সামাজিক সম্পর্কগুলো তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে কতগুলো কুখাদ্য-অখাদ্য শেখাতে থাকে আর সে মানুষ থেকে ক্রমশঃ পরিণত হতে থাকে খন্ডিত মানুষে। সে হয় নারী। সে হয় পুরুষ। সে হয় নির্যাতক। আর তাই নারী যখন ‘পুরুষ’ শব্দটি শোনে, তখন এর ইমেজ তার কাছে ভয়ংকর কিছু হয়ে দাঁড়ায়, যদি সে নিজে ভয়ংকরত্ব প্রকাশে বেশি পারঙ্গম না হয়। আবার পুরুষ যদি কম ভয়ংকরত্ব প্রকাশ করে বা অপার হয়, তবে ‘নারী’ শব্দটিও তার কাছে আতঙ্কের হয়ে উঠতে পারে।

‘সুযোগের অভাবে ভদ্রলোক’-সে পুুরুষ যেমন হয়, নারীও। তবে কিনা প্রকাশের অভিজ্ঞতা পুরুষের ক্ষেত্রে বেশি ঘটেছে তার পেশিশক্তির কূটনৈতিক বিজয় প্রতিষ্ঠার কারণে, তাই নারী এখনো অনেক বেশি ‘শিকার’।

আর পুরুষ নারীর সাথে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের সামাজিক ফাঁদে পা দিয়ে কিছুতেই নিজেকে ‘শিকারী’ থেকে ‘বন্ধু’ করতে পারছে না, কেউ করতে পারলে সামাজিক অস্ত্র তাক হচ্ছে তার দিকে। আর সে অস্ত্র সবসময় পুরুষের হাতে থাকছে, তা কিন্তু নয়। নারী নাকি রাগি স্বামী পছন্দ করে, এমন প্রচলিত মত নারীর আত্মসম্মানের গায়ে কাদা লাগিয়ে দেয় আর পুরুষের ইমেজকে করে ধুলিস্মাৎ।

এরপরও আশা টিকে আছে। ‘বেটার ম্যান’ বা ‘বেটার উইমেন’ হতে আগ্রহীদের সংখ্যা কম নয়। নিজেকে সাহায্যকারীর ভূমিকায় রেখে ‘বেটার হাফ’-কে ভালভাবে বুঝতে চাইলে, তার কথা মন দিয়ে শুনলে, সত্যিকার অর্থেই ‘বেটার’ হওয়া সম্ভব। তা না করে কোথাকার কোন্ ‘সামাজিক কুলাঙ্গাররূপী নারী বা পুরুষ’ কী অন্যায় করলো, তা নিজের কোলে টেনে নিয়ে তাতে একাত্মতা প্রকাশ করার মতো বোকামি কেন করতে হবে? বদরুল খাদিজাকে কুপিয়েছে বলে পুরুষকে কেন বদরুল বা বদরুল-সমর্থক হতে হবে? খাদিজাকে রক্ষা করতে ছুটে যাওয়া সাহসী যুবক ইমরানকে জয়ধ্বনি দিতে শুনলাম না কেন? বদরুল নারী বা পুরুষের কাছে যতো বেশি আলোচিত ছিল, ইমরান ততোটা নয়। এই সামাজিক ভুল প্রায়শ্চিত্ত দাবি করছে, সে আমরা কবে বুঝবো?

বদরুলের পাপের কারণে ‘সব পুরুষই বদরুল’ বাক্যবাণে নারী যদি উচ্চকিত হয়, তবে মিজান্ড্রি সিনড্রোম পুরুষের ভেতর জায়গা করে নিতে পারে। এরকম একটি কার্টুন এঁকেছিলেন আমেরিকার বিখ্যাত কার্টুনিস্ট ডেভ ভ্যান প্যাটেন। চারটা রঞ্জিত নখের অঙ্গুলি (নারীর হাত বোঝানোর জন্য) তাক করে আছে মাঝখানে কাঁদতে থাকা পুরুষকে, যার হাতে ধরা একটি বই। বইয়ের প্রচ্ছদে আছে এর শিরোনাম- ‘স্প্রিডিং মিজান্ড্রি’। অর্থাৎ, মিজান্ড্রি কিভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, কেন পড়ছে, তার জবাব এই চারটি হাত আর একাকি পুরুষের কান্না। পল নাথানসন এবং ক্যাথেরিন কে. ইয়ং নামের একজন পুরুষ লেখক আর একজন নারী লেখক এক সাথে মিলে বইটি লিখেছেন, যা ২০১৬ সালের বেস্ট বই হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে পুরুষকে কিভাবে চিত্রায়িত করা হয়, তার বিস্তারিত বিবরণ আছে বইটিতে।

‘আই ওয়াজ আ মেন’স রাইটস একটিভিস্ট’ শিরোনামে বৃটিশ কলম্বিয়ার ডাউনটাউন কেলোনার একটি বইয়ের দোকানে কর্মরত এডউইন হজ-এর একটি সাক্ষাৎকার-নিবন্ধ পড়েছিলাম ‘মেল’ নামের অনলাইন পত্রিকায়। সমাজে সাদা মানুষ হিসেবে নিজের অবস্থানকে ক্রমাগত বেকায়দায় পড়ে যেতে দেখছেন, অথচ নারীর দোষারোপের শিকারও হতে হচ্ছে দেখে হতাশ তরুণ এডউইন হজ পুরুষের অধিকার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন। মিজান্ড্রি ছড়িয়ে পড়লো এডউইনের ভেতর। এড্উইনের সহকর্মী নারীদের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল, বন্ধুদের বেশিরভাগই ছিল মেয়ে। এরপরও এডউইন ক্রমশঃ নিজের ভেতরকার পুরুষবাদ প্রকাশ করে ফেলায় চাকরিটা হারালেন, মানসিক ডাক্তারের কাছে যেতে হলো। কাউন্সেলিং তার ভেতরটা পাল্টে দিল, তিনি বুঝলেন তিনি নারীবাদ বা পুরুষবাদ ঝেড়ে ফেলে মানবতাবাদকে চিনতে শিখেছেন। আর তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের ক্লাসে প্রফেসর যখন প্রশ্ন করেন, ‘জেন্ডার বলতে তুমি কী বোঝো?’ তখন এডউইন বলতে পেরেছিলেন যে, পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে বলেই নারী অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। পুরুষ অধিকার আন্দোলনকর্মীদের প্রতিপক্ষ নারী নয়, পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, বুঝতে হবে এই সত্যটা।

নিজেকে সাদা পুরুষ হিসেবে দেখতে শেখা এডউইন হজ পরে বুঝতে পেরেছিলেন, পশ্চিমা দেশে এইসব আন্দোলনের নেতৃত্ব সাদা চামড়ার হাতেই থাকে, আর তখন ভিন্ন রঙের মানুষগুলো যে বঞ্চনার অভিজ্ঞতা লাভ করে, তার সাথে নারীবাদীদের বক্তব্য মিলে যায় খুব সহজে। ‘ক্ষমতা’ হচ্ছে আসল নাটের গুরু, ক্ষমতা হাতে পেলে যে কেউ ‘নির্যাতক’ হতে পারে, বাকিরা তখন ভিকটিম।

এডউইন হজ ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে পিএইচডি করছেন। তার গবেষণার বিষয় হচ্ছে, নারীবাদের তত্ত্বকে ভিত্তি ধরে পুরুষের ইস্যুগুলোকে সামনে তুলে আনা। তিনি এখন আর তথাকথিত পুরুষ অধিকারবাদী নন, পুরুষরা রাগ ঝেড়ে তাকে বরং ‘নারীবাদী’ বলে।

আর তিনি বলেন, ‘আমার চিন্তার কেন্দ্রে এখনও পুরুষ’। কিন্তু পুরুষের প্রতিবাদের বিষয়গুলোর সাথে নারীকে তিনি আলাদা করতে পারেন না। চোখের পানি যখন ঝরে, তা চোখ থেকেই ঝরে। নারীর চোখ আর পুরুষের চোখ আলাদা করে দেখার দরকার নেই। ভিকটিম সব সময়ই ভিকটিম। জেন্ডার পরিচয়ের কূটকৌশলে তার জন্য বিচারের বাণীকে নিভৃতে কাঁদানো যাবে না।

পুরুষের অধিকার আন্দোলনে পুরুষ সক্রিয় নয়, তা কিন্তু সত্য নয়। তবে তাতে যখন নারীবিদ্বেষী বিষাক্ততা ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন তা পুরুষের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পুুরুষ অধিকারবাদীদের অনেকে নারীবাদীদের ‘খুন’ করে সমস্যার সমাধান করতে চায়, আন্তর্জাতিক পুরুষ অধিকারবাদ ব্লগগুলোর দিকে চোখ রাখলেই সেটা বোঝা যায়।

ব্লগের কথাই বা কেন বলছি, অধিকার সচেতন নারীকে ‘বখে যাওয়া’ ভেবে ছুরি-চাপাতি ধার দিতে অনেক পুরুষই আগ্রহী, তা সমাজের কোণায় কোণায় তাকালেই টের পাওয়া যায়, প্রমাণ তো খবরের কাগজে ঢের আছে। পুরুষ অধিকার আন্দোলনের মূল সমস্যা এটাই। পুরুষের সমস্যা এই আন্দোলনের সেকেন্ড ইস্যু। ফার্স্ট ইস্যু নারীবাদের বিরোধিতা।

বিশ্বখ্যাত লেখক, হ্যারি পটারের স্রষ্টা জে কে রলিং টুইট করেছিলেন, পুরুষ নারীকে নিয়ে যা বলে, তা আসলে হুবহু বলছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নারীবিদ্বেষী ডোনাল্ড ট্রাম্প তার এই বিশেষ গুণকে প্রকাশ করেই জিতে নিলেন আমেরিকার ক্ষমতার মসনদ।

নারী অধিকারবাদীরা পুরুষকে ‘খুন’ করতে চায়, এটাও কিন্তু সত্য। এই প্রসঙ্গ নিয়ে লেখক লরেন পার্কার  লিখেছিলেন, ‘ইফ ‘বয়েজ উইল বি বয়েজ’ হোয়াই ডোন্ট উই জাস্ট কিল বয়েজ?’ যুক্তিটা এরকম- ‘বয়েজ’ যদি ধর্ষণকে গ্রহনযোগ্য মনে করে অথবা অন্যকে বুঝতে প্ররোচিত করে যে ‘বয়েজ’ ধর্ষক, তবে আমরা কেন স্রেফ ‘বয়েজ’-কিলিং করবো না?

বেল হুকস-এর লেখা বই দি উইল টু চেঞ্জ-এ বলা হয়েছে, ‘পৃথিবীর সব নারী আর শিশু পুরুষকে মরে যেতে দেখতে চায়, যাতে তারা বেঁচে থাকতে পারে’। লরেন পার্কারের লেখাটির নিচে পাঠকের মন্তব্য দেখতে গিয়ে পড়লাম ডেভেলপমেন্ট ডট জোশ নামের একজনের মন্তব্য- সাদা নারী আমাকে বলছে সব পুরুষকে খুন করতে–হ্যাঁ, আমি আধা-ফিলিস্তিনি, তোমরা তো তাদেরকে ইতোমধ্যে খুন করছোই। লরি এডোরবল নামের এক কৃষাঙ্গ নারীবাদী চাইছেন, ‘কেবলমাত্র সাদা পুরুষদের হত্যা করা হউক’।

১৯৬৭ সালে ভ্যালেরি সোলানাস কী করেছিলেন মনে পড়লো। এন্ডি ওয়ারহোলকে গুলি করেছিলেন ভ্যালেরি, যিনি বলতেন, ‘পুরুষ হচ্ছে অসম্পূর্ণ নারী’, ‘প্রকৃতিগতভাবে পুরুষ এক প্রকারের জোঁক, একটি মানসিক পরজীবী’।

মনে পড়ে যায় এরিস্টোটলের কথাও, যিনি ভ্যালেরি সোলানাসের প্রায় চব্বিশশ’ বছর আগে বলেছিলেন, ‘নারী হচ্ছে প্রকৃতিগতভাবে কিছু বৈশিষ্ট্যের অভাবে ভুগতে থাকা কেউ, আর তাই আমাদের উচিত নারীকে প্রকৃতিগত ‘খুঁত’ হিসেবে বিবেচনা করা। আহা, কী চমৎকার ব্যাখ্যা পুরুষ আর নারীর, ব্যাখ্যা এসেছে যথাক্রমে নারী আর পুরুষের কাছ থেকে।

সমস্যা হচ্ছে, সময়ের দিক থেকে এরিস্টোটলের ধারণা এগিয়ে থাকায় নারীকে ‘খুঁত’ হিসেবে বিবেচনা করতে সমাজ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমৃদ্ধ।

ভ্যালেরি-তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে আরও সময় লাগবে বৈকি। তখন ইতিহাসের চাকা উল্টো পথে ঘুরবে না কী ঘুরবে না, ভাবনার বিষয়, নয় কি?

শেয়ার করুন: