হিন্দু ডিভোর্স আইন না থাকা, পিতৃতন্ত্রের কুটিল ষড়যন্ত্র

ফাহমি ইলা: লক্ষ্মী কাঁদছে, হেঁচকির চোটে কী বলতে চাইছে বোঝা দুষ্কর। একটু সময় দিলাম শান্ত হবার জন্য। মেয়েটাকে চিনি বছর দুয়েক হলো। অফিসের কাজে দু’বছর আগে খুলনা গিয়েছিলাম, তখনই পরিচয়। শান্ত সরল মেয়েটির চোখে-মুখে যে বিষাদ দেখেছিলাম, আজ সে মরিয়া- মরে যাবার জন্য, কিংবা বেঁচে থাকার জন্য।

একটু শান্ত হবার পর জিজ্ঞেস করলাম- ‘কী হয়েছে?’ বললো- ‘এভাবে আর বেঁচে থাকা সম্ভব না দিদি। আমাকে বাঁচাও!’ কিছুটা বুঝতে পারলেও তখনও আমার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার না। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হবার পর শুনতে পেলাম তার না বলা কথাগুলো। বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক। স্বামীটির দ্বারা মানসিক, শারীরিক এবং যৌন – তিনভাবেই নির্যাতিত হচ্ছে। পান থেকে চুন খসলেই তিলকে তাল বানিয়ে স্বামীর অত্যাচার শুরু হয়।

এখানে সেগুলোর বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি-না বুঝতে পারছি না! বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বামীর দ্বারা স্ত্রী নির্যাতিত হবার যে অভিজ্ঞতা তা কী নারীভেদে খুব হেরফের হয়? মেয়েটির চোখের নিচে কালি পড়েছে, বিষাদের ছায়া পাকাপাকি গেড়ে বসেছে ছোট্ট মুখখানিতে।

জিজ্ঞেস করলাম- ‘কী করতে চাস?’ বললো- ‘দিদি, আমি আর ওর সাথে সংসার করতে চাই না। এভাবে বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি ঢাকায় চলে আসতে চাই। একটা ছোটখাটো চাকরি খুঁজে নেব। তারপর নিজের মত বাকিটা জীবন বাঁচতে চাই।’ আমি বললাম- ‘পারিবারিকভাবে আলোচনা কর আগে, পরিবারের অন্যান্যদের সাথে কথা বল যেনো তাকে তার ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়। ডিভোর্স দিলে দিবি, তার আগে একটু পরিবারের সবাইকে তাঁর কাজকর্মগুলো জানিয়ে দিলে ভালো হতো না?’

সে বললো-‘জানিয়েছি। আমার বাবা-মাকে জানিয়েছিলাম। তারা উলটো আমাকে মারধর করেছে। আমি স্বামীর মন জুগিয়ে চলতে পারি না বলেই নাকি সে এরকম অত্যাচার করে। আর স্বামীরা এরকম অত্যাচার করলেও মেয়েদের নাকি মুখ বুঁজে সংসার করতে হয়। আর তার পরিবার তো সামনে থেকেই সব দেখছে। কিছুই বলে না, উলটো আমাকে কথা শুনতে হয়’।

দীর্ঘশ্বাস ফেলি, এইতো হবার কথা। পিতৃতন্ত্রের ছায়ায় বসে রোদ পোহায় নারীপুরুষ একসাথে। এবার বললাম- ‘তাহলে মামলা কর। ডিভোর্স নে।’ এরপর যা শুনতে হলো তার জন্য প্রস্তুৎ ছিলাম না। আমি জানতামই না ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এদেশে হিন্দু আইনে ‘ডিভোর্স’ শব্দটিই নেই। কী বলে এসব? তাহলে একজন নির্যাতিত বিবাহিত হিন্দু নারী কী করবে এক্ষেত্রে?

এর ওর সাথে কথা বলি। জানতে চাই আসলেই কী করা যায়, বা কী আছে আইনে। যা শুনি তাতে শিওরে উঠি! লক্ষ্মীকে সাহস দেই, সেইসাথে তাকে জানাই- আগে সে নিজে সিদ্ধান্ত নিক কী করতে চায় এবং সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সে নিজে শক্তভাবে এ সমাজ এ আইনের সামনে দাঁড়াতে পারবে কিনা এবং বাকি জীবনের যে যুদ্ধ, সেখানে লড়াই করতে পারবে কিনা, সে ব্যাপারে আগে তার নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারপর আমি বা আমরা তো আছিই তার পাশে।

এই যে মেয়েটি আলাদাভাবে বেঁচে থাকতে চাইছে, আদতে সে কিন্তু তাঁর পরিবার থেকেও সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাবে। এই মেয়েটির পরিবার তার পাশে থাকবে না, স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। এদিকে স্বামীটি টের পাবার পর থেকে তার সকল শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ লুকিয়ে রেখেছে, গহনাগাটি থাকে তালা মারা সিন্দুকে, এমনকি অত্যাচার বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

অকুল সাগরে এক টুকরো খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরে মেয়েটি বললো- ‘দিদি, সার্টিফিকেটগুলো না পেলে আমি তো চাকরিও করতে পারবো না। আর আমার একলা বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় নিজে স্বাবলম্বী হওয়া। সেই পথও সে বন্ধ করে দিচ্ছে। অথচ আমি প্রমাণ করবো কীভাবে যে সে আমার সার্টিফিকেট লুকিয়ে রেখেছে?’

উত্তর খুঁজে পাই না। দম বন্ধ লাগে, রাগে-আক্রোশে নিরুপায় হতাশ মনে হয় নিজেকে!

আসুন একপলকে একটু দেখে নিই এদেশে হিন্দু বিবাহ আইনের অবস্থা।

‘প্রচলন ও উৎসগত দৃষ্টকোণ বিচারে হিন্দু আইনকে মূলত দু’ভাগে ভাগ করা যায়-

১। মিতাক্ষরা আইন

২। দায়ভাগা আইন

একাদশ শতাব্দীতে বিজনেশ্বর নামে হিন্দু শাস্ত্রে জনৈক পণ্ডিত ব্যক্তি মিতাক্ষরা আইন রচনা করেন। এটি মূলত যাজ্ঞবল্ক্য প্রণীত স্মৃতিশাস্ত্রের ধারাবাহিক ব্যাখ্যা। অন্যদিকে হিন্দু শাস্ত্রের অপর পণ্ডিত ব্যক্তি জীমূতবাহন ত্রয়োদশ হতে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যে কোন এক সময়ে দায়ভাগা আইন রচনা করেন। দায়ভাগা আইন হলো মনু সংহিতা, যাজ্ঞাবল্ক্য সংহিতা এবং নারদ সংহিতা- এ তিনটি স্মৃতিশাস্ত্রের সামঞ্জস্যপূর্ণ সারাংশ।

মিতাক্ষরা ও দায়ভাগা আইনের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, উত্তরাধিকার, নারী অধিকার সংক্রান্ত বিষয় ছাড়াও আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়ভাগা আইন মিতাক্ষরা আইনের চেয়ে কিছুটা প্রগতিশীল। ভারত উপমহাদেশের যাবতীয় অঞ্চলে মিতাক্ষরা আইন প্রচলিত থাকলেও বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে অর্থাৎ শুধু বাঙ্গালী হিন্দুদের মাঝেই দায়ভাগা আইন প্রচলিত।

অতীতে হিন্দু আইন ছিলো স্থানীয় লোকাচার এবং ধর্মীয় রীতিনীতির সমষ্টি। ব্রিটিশ শাসনামলে দেশীয় সংস্কারকদের উদ্যোগে তৎকালীন আইনসভা কিছু উল্লেখযোগ্য আইন প্রবর্তন করেন-

সতীদাহ প্রথা নিবারণ আইন, ১৮২৯

ধর্মীয় স্বাধীনতা আইন, ১৮৫০

বর্ণগত অক্ষমতা দূরীকরণ আইন, ১৮৫০

হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন, ১৮৫৬

অভিভাবক ও পোষ্য আইন, ১৮৯০

হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, ১৯২৮

শিশু বিবাহ নিরধ আইন, ১৯২৯ (সংশোধিতঃ ১৯৩৮)

বিদ্যার সাহায্যে অর্জিত সম্পত্তি বিষয়ক আইন, ১৯৩০

সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর অধিকার সংক্রান্ত আইন, ১৯৩৭

বিবাহিত নারীর পৃথক বাসস্থান ও ভরণপোষণ আইন, ১৯৪৬

এখানে উল্লেখ করা জরুরী যে ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর ভারতে হিন্দু আইনের ক্ষেত্রে অনেক প্রগতিশীল সংস্কার সাধিত হয়েছে। যেমন: হিন্দু বিবাহ আইন ১৯৫৫, নাবালকের সম্পত্তি বিষয়ক আইন ১৯৫৬, হিন্দু দত্তক গ্রহণ ও ভরণপোষণ আইন ১৯৫৬, হিন্দু উত্তরাধিকার আইন ১৯৫৬ (সংশোধিত ২০০৫- এ আইনে পুত্র ও কন্যা সম্পত্তিতে সমানাধিকার প্রাপ্ত), বিশেষ বিবাহ আইন ১৯৬০ প্রভৃতি। কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৪৭ এর পর হিন্দু আইনের ক্ষেত্রে নতুন সংস্কার সাধিত হয়নি। ফলে বাংলাদেশে হিন্দু আইনে, বিশেষত নারী অধিকার প্রশ্নে আজও রক্ষণশীল প্রাচীন ধ্যান-ধারণা প্রতিষ্ঠিত।

এবার আসি হিন্দু বিয়ের আইনগত ফলাফল কি?

  •         স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সহবাস ও সন্তান জন্মদান আইনগতভাবে স্বীকৃত হয়;
  •         পিতা-মাতার মৃত্যুর পর সন্তান-সন্ততি সম্পত্তির উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত হয়;
  •         বিয়ের মাধ্যমে স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তিতে জীবনস্বত্বের অধিকারী হতে পারেন, কিন্তু উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত হন না।‘

এখন আসি হিন্দু আইনে বিবাহ-বিচ্ছেদ সম্ভব কি না এ প্রসঙ্গে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশে হিন্দু আইনে বিবাহ-বিচ্ছেদ সংক্রান্ত বিষয়াবলিতে এখনও সংস্কার আসেনি। ফলে এখানে বিবাহ-বিচ্ছেদ আইনত সম্ভব হচ্ছে না। বড়জোর ‘বিবাহিত নারীর পৃথক বাসস্থান ও ভরণপোষণ আইন ১৯৪৬’ এর অধীনে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে পৃথকভাবে বসবাস ও ভরণপোষণের জন্য মামলা করতে পারেন এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণসাপেক্ষে আদালত তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করতে পারেন। উল্লেখ্য, ভারতে ১৯৫৫ সালে হিন্দু বিবাহ আইন পাস হবার পর থেকে এর ১৩ ধারা অনুসারে স্বামী-স্ত্রী যে কোন পক্ষই সুনির্দিষ্ট ও যুক্তিসঙ্গত কারণ উপস্থাপনের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন।

বাংলাদেশে হিন্দু বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত কোন আইন নেই। ফলে একটি মেয়ে নিপীড়িত, নিষ্পেষিত হয়েও কোনধরনের বিচ্ছেদে যেতে পারে না। যদিও বা মামলা করার মাধ্যমে সে পৃথক বসবাসের অনুমতি পায়, কিন্তু নতুনভাবে জীবন শুরু করবার ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় জীবিত স্বামী। কারণ স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় পুনরায় বিয়ে করে নতুন করে জীবন শুরু করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না। একবার ভেবেছেন কি যে নারীটি অত্যাচার, অবিচার সহ্য করেও সংসার করতে বাধ্য হচ্ছে তাঁর কি অবস্থা? কিংবা সহ্য করতে না পেরেও যে নারীটি সাহস করে পৃথক থাকছে তাঁর নতুন করে স্বপ্ন দেখা সম্পূর্ণ বারণ! অথচ একজন হিন্দু পুরুষ ইচ্ছে করলে একাধিক বিয়ে করতে সক্ষম!

এ কেমন প্রহসন?

লক্ষ্মীকে কী পরামর্শ দিতে পারি আমরা? বিবাহিত নারীর পৃথক বাসস্থান ও ভরণপোষণ আইনে মামলা করার কথা বলবো? ঠিক আছে, না হয় সে তা-ই করলো। আদালতও তাঁর পক্ষে রায় দিলো। সে আলাদা থাকা শুরু করলো।

এটা কী আদৌ কোনো সমাধান হলো? একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য কি কেবল খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা-ই যথেষ্ট? প্রাপ্তবয়স্ক ওই নারীর যৌন অধিকার কীভাবে সংরক্ষিত হবে? যদি ধরেও নেই স্বনির্ভর হয়ে নারীটি স্বাধীনভাবে জীবন শুরু করতে ইচ্ছুক, তাও কী সম্ভব তাঁর পক্ষে? এ বদ্ধ সমাজ তাকে একটুও স্বস্তি কিংবা শান্তিতে থাকতে দেবে? এ সমাজ কি তার বানানো আইন, রীতিনীতি নিয়ে মেয়েটির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে না?

ফাহমি ইলা

তার চেয়ে বড় কথা স্বামী-সন্তান নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখার অধিকারই তার নেই। হাস্যকর শোনালেও বলতে হয়, ওই নারীকে তার বর্বর, পাষণ্ড স্বামীর মৃত্যু কামনা করা ছাড়া ভিন্ন কোনো গতি নেই। একমাত্র স্বামীর মৃত্যুর ভেতর দিয়ে সে বিধবা বিবাহ আইনে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে। না হলে হয় ওই হারামী স্বামীর ঘর করতে হবে, নইলে আদালতে মামলা করে পৃথক বসবাসের দুঃসহ একাকিত্বের ঘানি টানতে হবে আজীবন।

রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা নিবারণের যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন, কিন্তু এই একাবিংশ শতাব্দীতে নারীর প্রতি প্রচলিত পুরুষতন্ত্রের ধূর্তামির বিরুদ্ধে কে দাঁড়াবে? এটা তো স্পষ্ট এদেশের এলিট হিন্দু মোড়লেরা চায় না বিবাহ বিচ্ছেদ আইন হোক। দেশভাগের পর সেই ১৯৫৫ সালে ভারতে আইন পাশ হয়ে গেলেও এ অঞ্চলে, এই স্বাধীন বাংলাদেশে অদ্যাবধি হিন্দু প্রথাগত বিধান চলে আসছে। আমাদেরকে এখনই এসব বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীর মুক্তির জন্য ডিভোর্স আইন পাশে সরকারকে বাধ্য করতে হবে।

শেয়ার করুন: