সকল বিভক্তি ঝেড়ে সুন্দর আগামী গড়ি

ফাতেমা জোহরা: ফেসবুকের কল্যাণে প্রতিদিন একটা করে নতুন টপিক আসে, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি সেই ইস্যুটার উপর।তারপর জাত গেল, জাত গেল বলে চিৎকার করি, চেঁচামেচি  করি, গুমরে মরি, কিন্তু সবই সার!  কেউ কী ভেবে দেখছেন একবার শিক্ষা, সমাজ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার এই যে পচন, গাজন বানানোর প্রক্রিয়াটা দীর্ঘমেয়াদী!

‘ওড়না’ ভাবনা  তো বাৎসরিক পরিকল্পনার অংশ নয়।

ফাতেমা জোহরা

আমি গ্রামের মেয়ে, ওড়না ব্যাপারটা যে আব্রু এই ভাবনাটা কখনো মনে স্থান পায়নি। অবস্থানগত কারণে বার বার স্কুল – কলেজ বদলাতে হয়েছে শহর গ্রামে, গ্রাম থেকে শহরে। ক্লাস টেনে সর্বশেষ যে স্কুলে ভর্তি হলাম তা ছিল কো-এডুকেশন। আমরা দুইবোন একসাথে পড়তাম। তখন ‘ মেডি’ নামে একটা পোশাক ছিল হাঁটুর একটু নিচ অবধি। আমি ‘মেডি’ আর বোন ‘স্কার্ট’ পরেই স্কুলে গিয়েছিলাম। ক্লাসের ছানাবড়া চোখগুলো বলে দিচ্ছিল আমরা এলিয়ান গোত্রের। ওড়না তো নাই-ই, পা সম্পূর্ণ ঢাকা ছিল না। ব্যাপারটা আজও উপভোগ করি আমরা। আসলে ক্লাস টেনের কোন মেয়ের সালোয়ার – কামিজ, ওড়না ছাড়া স্কুলে আসাটা অস্বাভাবিক ছিল।

যে বেলাটা কাটিয়ে এসেছি, জ্ঞানের উন্মুক্ততা ছিলো না হয়তো সবার জন্য, কিন্তু প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রবণতায় মানুষ উদারপন্থী  ছিল। গ্রামে বা শহুরে দু’ ধরনের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিলাম অবস্থানের কারণে। শহুরে সংস্কৃতিতে অনেক রাত অব্দি ব্যাডমিন্টন, এসো গান শিখি, মুগলি, নিনজা টার্টল, পিকনিক, ঘুরে বেড়ানোর মতো প্রাণময়তা আর গ্রামে চড়ুইভাতি, বউচি খেলা, ডাংগুলি, বাঘবন্দী খেলা, খোলা মাঠে ঘুড়ি ওড়ানো, ফানুস উড়ানোর দিনে পুঁই-লতা চুরি করা, শবে- বরাতের রাতে চাচীদের সাথে সামনের পুকুরে গোসল করতে যাওয়া। পাশে মসজিদ, নামাজ হচ্ছে  আর আমরা দাপাদাপি করছি পুকুরে। মাঝে মাঝে একটা উচ্চ গলা হাকারি শোনা যেত চুপচাপ করার জন্য, ঐটুকুই। কোন মৌলবাদী গন্ধ ছিলো না, বাধা- নিষেধের বেড়ি ছিল না।
প্রেমটাও সহজিয়া ছিল। ছোটবেলায় রাধা – কৃষ্ণের প্রেম জ্যান্ত একটা উদাহরণ। আমাদের সমবয়সীদের প্রচণ্ড কৌতূহলের বিষয় ছিল। রাধা- কৃষ্ণ দুজনেই আমাদের আশেপাশের মানুষ। সবাই জানে কিন্তু কেউ জানে না!  ছিঃ ছিঃ রব কি ছিল? না তো, অপাপবিদ্ধ সেই বয়সে সবকিছু সহজভাবে নেয়ার একটা মানসিকতা  ছিল, পাপ- পূণ্য শব্দের সাথে পরিচিতি ছিল না।
আস্তে আস্তে পট পরিবর্তন হলো। রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তে জং ধরালো সমাজের গায়ে,পাপ – পূণ্যের একটা হিসাব খাতা তুলে ধরা হলো সবার মাঝে নীরবে, নিঃশব্দে। সেই সুতলি সাপ ক্রমেই আজদাহা! শিক্ষা, সমাজ, রাষ্ট্র আজ পাপ – পূণ্য, ভাল- মন্দের সমাচারে মশগুল। মনুষ্যত্ব আজ মানুষের পরিচয় নয়, দল, গোত্র, জাত- পাত, ধার্মিক- ধর্ম নিরপেক্ষ, বিভিন্ন ‘বাদ’ এর ট্যাগ সম্বলিত পরিচয়ই এখন মানুষের পরিচয়।
আমরা সভ্য হচ্ছি, সভ্যতার ধারক – বাহক হয়ে সবাই বলে যাচ্ছি আমাদের নিজ নিজ কথা, শোনার মানুষ নেই। স্বাতন্ত্র্যবোধ আমাদের নিঃশেষ করে দিচ্ছে, পানিশূণ্যতা এনে দিচ্ছে। আমরা ভাবছি না আমাদের সন্তানের কথা। যে মাস্টারমাইন্ডের ধ্বংসের এই চূড়ান্ত পরিকল্পনা — সে তো অগোচরে ছিল না। আজ কান নিল, কান নিল বলে চিলের পিছনে দৌড়াচ্ছি, কানটা তো আমার সেই বোধ, সেই অধিকার কি কখনো দেখিয়েছি? এই রসাতলের প্রক্রিয়াটা দীর্ঘমেয়াদীর। আমরা কি তার জন্য দায়ী নই? যে মৌলবাদিতা আমাদের নিঃশ্বাস ক্রমশ গ্রাস করছে, তার জন্য তো আমরাই দায়ী।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমরা তিনভাগে ভাগ করেছি। এলিট হিসেবে কিছু মানুষ নিশিন্তে থাকলো — যাক বাবা, বাঁচা গেল। মধ্যবিত্তরা বরাবরই হা-পিত্যেশের দলে, জোয়াল বয়ে বেড়ানো জীবন, কষ্টে – সৃষ্টে যাচ্ছে যাদের দাঁত- চাপা জীবন।আর খেয়ে- না খেয়ে টেনে বয়ে বেড়ানো অকিঞ্চিৎকর জীবন। এই ভাগ – বিড়ম্বনার সুযোগ নিয়ে আজদাহা হয়ে উঠা সেই বিষবাস্প আজ এলিটকে টার্গেট করেছে, নিস্তার নেই আজ কারও।
আজ সবাইকে সব ‘বাদ’ বিতণ্ডা পরিহার করে এই আজদাহাকে শনাক্ত করতে হবে, তাকে চেপে ধরে ভূমিস্থ করার ব্যবস্থা করতে হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে আমাদের শিশুদের একটি সুন্দর, নির্মল সকাল দিতে, একটা সহজ, ওজনমুক্ত, সাম্যবাদী ব্যবস্থা গড়তে আর মানুষ হবার প্রক্রিয়া সফল করতে। আসুন আমরা ব্রতী হয় এই উদ্যোগে। ধন্যবাদ সবাইকে।
শেয়ার করুন: