জিনিয়া চৌধুরী: গতরাতে মুভি অব দ্য উইকে ‘দাঙ্গাল’ ছবিটা দেখলাম। আমির খানের সাহসী পিতার ভূমিকাকে অভিবাদন জানাই। যদিও মুভিতে গ্রামবাসীর আচরণকে আসলে অনেক বেশী পজেটিভ মনে হয়েছে। বাস্তবে তা নয়।বরং বাস্তবতা আরও কঠিন। বাস্তবে গ্রামবাসীর আলোচনা, সমালোচনা, পিছে টেনে ধরার মতো অশ্লীল থাবা, এর থেকে অনেক গুণ বেশী প্রসারিত।
কোন শিশু জন্মের পরেই বুঝতে পারে না সে নারী না পুরুষ। পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাকে নারী বা পুরুষ হিসাবে গড়ে তোলা হয়। মেয়েদের গণ্ডিবাঁধা অচঞ্চল চোখমুখ, লজ্জা নির্ভরতা, ভীতু, স্বল্পভাষী ও নিচুকণ্ঠের শিক্ষা দেয়া হয়। আর পুরুষকে দেয়া হয় দুঃসাহস, দম্ভ, ক্রোধ এবং চাঞ্চল্যের।

যদি বা কখনো উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের কোন, কোনটি উল্টো হয়ে যায়, নীচু কণ্ঠ, অচঞ্চল, শান্ত ধীর পদক্ষেপ দেখা যায় কোন পুরুষ চরিত্রে তবে তাকে মেয়েলি বলে হাস্যরস করা হয়।শান্ত স্বভাবী পুরুষটাকে বলা হয় মেনী পুরুষ, বোকা ছেলে, গাধা পোলা, ব্লা, ব্লা,ব্লা।
অন্যদিকে আবার যদি কোনো মেয়ের মাঝে, চাঞ্চল্য, স্বয়ম্ভরতা, অকুন্ ঠচিত্ততাসম্পন্ন গুণাবলী থাকে তবে তাকে বলা হয় এর মাঝে পুরুষালী দোষ আছে। অথচ মেয়েলি বা পুরুষালী বৈশিষ্ট্য কারও শাররীক গঠন বা চরিত্রের ওপর নির্ভর করে না। যে মানুষ তার আগ্রহকে দমন করতে শেখে, যে তার দৃষ্টিকে নত করতে শেখে, যে তার পদক্ষেপকে, সীমাবদ্ধ করতে, বাহুকে সংকুচিত করতে শেখে, সে অবশ্যই তার শারীরিক গঠনের সাথে প্রতারণা করে। করে কারণ শরীর নয়, সমাজ দ্বারা নির্ধারিত মেয়েলি স্বভাব তার শরীরে আরোপিত না হলে তার সম্মান (?) যায়। সে জাত ছাড়া হয়ে পড়ার আশঙ্কায় ভোগে।
আজ খুব মনে পড়ছে নব্বই দশকের গোড়ার দিকের এক পিতাকে। যখন ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া মেয়েটা বড়দের কাতারে উঠে গেছে মনে করে তার ওপরে চাপানো হতো বর্ণিল এক চওড়া কাপড়ের আসকান, মাথায় কাপড় দিয়ে মাথা ঝুঁকে ঝুঁকে কোরআন পাঠ আর কয়বার কোরআন খতম দেয়া হলো আঙ্গুলের কড়া গুণে তার হিসেব রাখা হতো।
এ বয়সী মেয়েদের এক নুতন ঠিকানায় পাঠানোর প্রস্তুতি চলতো, প্রস্তুত করা হতো, সেলাই-কলাই প্রভৃতি বাড়তি অনুষঙ্গে। তখন একটা বাঁধভাঙ্গা মেয়ে বেরিয়ে পড়তো তার ছোট চাচার সাইকেল নিয়ে, ছেলেদের সাথে পাল্লা দিতো, ৫০০ মিটার দৌড়ে ইন্টার স্কুল প্রতিযোগিতায় ছেলেদের হারিয়ে দিয়ে এক চুটকিতে প্রথম হওয়ার ট্রফি হাতে ছুটে আসতো। যখন তখন বাবার পিঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আদর কাড়া মেয়েটি ,জলপাই, আম, আমলকি, পেয়ারা গাছে তরতর করে উঠে যেতো। সে পিতার সন্তানকে নিয়ে কতো কথা, আপনজনের বেশে এসে কতো মানুষের কত শলা-পরামর্শ, কতো সমালোচনা।
মা প্রায়শই ভেঙ্গে পড়তো, তার কপালে কুঞ্চন। বাবাকে বাসায় ঢুকলেই শুনতে হতো একরাশ কটু কথা, মেয়েকে কোথায় বিয়ে দেবে, মেয়ের সাইকেলে তালা দিতে হবে, মেয়ের পায়ে এবার শেকল দিতে হবে। মা বলতো, বাবা হাসতো। বাবা হাসতো,মেয়ে উৎসাহ পেতো। এখন বুঝি বিষয়টা এতো সহজ ছিলো না,মাঝে মাঝে চাচীরা, ফুপিরাও মুখ বাঁকাতো, ভাইজান তো বোনদের বেলায় কড়া শাসন চালাতো, মেয়ের বেলায় এসে কী হলো? মেয়ে তো আউট অফ কন্ট্রোল।
মন ভারী হতো, জলপাই গাছের দোলনায় বসে অলস বিকেল কাটতো, মুখে বিষন্নতা দেখে বাবা বলতো, “কইরে মুনিয়া পাখি, আজ খেলতে যাসনি?” খেলা মানে ধান কাটা ন্যাড়া ক্ষেতে সমবয়সী ছেলেদের সাথে সাত চাড়া। মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত। একছুটে মুনিয়া আঙ্গিনা পেরোয়। পেছন থেকে মায়ের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ।
মানুষ খারাপ বলে মুনিয়াকে, বুঝতাম না কেন? মুনিয়া কখনো কোনো ছেলের সাথে বর-বউ খেলেনি, মুনিয়া কখনো ছেলেদের হাসি, চোখের চাউনির তোয়াক্কা করেনি, বরং পাল্লা দিয়েছে, প্রতিবাদ করেছে। বাবা ছাড়া মুনিয়া তবু আর কাউকে পাশে পায়নি।
একবার মনে আছে, তখন একদম নুতন এসেছে চোস্ত পায়জামা, মুনিয়া আর তার এক বান্ধবী চোস্ত পরে স্কুলে গিয়েছে, সিনিয়ার এক ছেলে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলছে, “এমা তোমরা ন্যাংটো নাকী”? বান্ধবীটা মরমে মরে। মুনিয়া এগিয়ে এসে বলে, হ্যাঁ, ন্যাংটো, দেখবি? বিটকেলটা সাহস করে এগিয়ে এসে হাঁটু অব্দি মাথা নামানোর সাথে সাথে পা ঘুরিয়ে দিয়েছিলো এক লাথি। দাঁত দিয়ে ঐ ছেলের ঠোঁট কেটে অঝোরে রক্ত পড়েছিলো সেদিন।
জানতো বাসায় গেলে খবর আছে। মা পিঠের ছাল তুলে নেবে। বন্ধুর বাড়িতে লুকিয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করেছিলো সে।বাবা সন্ধ্যায় এসে সব শুনে খুঁজে বের করে বাসায় নিয়ে যায়। অপেক্ষাকৃত আমজনতার সামনে দাঁড়িয়ে বলে. “আমি জানি আমার মেয়ে কখনো কোন ভুল করবে না, দোষ ঐ ছেলের ছিলো, আমার মেয়ে যদি এলাকায় বুক ফুলিয়ে ঘুরতে না পারে, তাহলে কারও ছেলেকেও আমি সিনা টান করে হাঁটতে দেব না”।
বাবা দেনওনি। রাস্তায় ‘লাভ ইউ’ বলায় যখন মুনিয়ার মামা, চাচারা গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো এক ছেলের ওপর, দুটো এলাকায় যখন প্রায় এলাকাগত মারামারির সৃষ্টি হয়েছিলো, যখন বড় দাদার মনে হয়েছিলো মুনিয়ার বিয়ে দিতে হবে, যখন বড় জ্যেঠুর মনে হয়েছিলো মেয়ে হাতছাড়া হয়ে যাবে, তখনও সমান দৃঢ়তায় যে মানুষটি সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, সে মুনিয়ার ফ্রিডম ফাইটার বাবা।
আমি তাকে স্যালুট জানাই।
আজ যখন এলাকায় আমার সহপাঠীরা সাইকেল চালায়, বাইক চালায়, এনজিও করে, আমার বুকটা গর্বে ভরে ওঠে আমার বাবার জন্য আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন একটি গ্রামে একলা এক বালিকা সর্বপ্রথম সূর্যের আলোয় সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখেছিলো।
তাই বলি কী, নারী, তুমি জন্মেই নারী নও, তাই লাজ-লজ্জার সফল চর্চার ঘেরাটোপ পেরিয়ে তুমি মানুষ হয়ে ওঠো। লড়াইটা তোমার, আর বাবারা কেবল মেয়েদের ওপর আস্থা রাখুন। পাশে থাকুন।
মুনিয়ার সাথে আমার গল্পটা মিলেমিশে একাকার…।
শেয়ার করুন: