রোকসানা ইয়াসমিন রেশনা: ভাবনাটা আগেও কাজ করতো। কিন্তু সেই যে ছেলেটা ‘জিপিএ–৫ কী গাছে ধরে (?)’ লিখে মরে গেল, তারপর থেকে খুব বেশি করে চেপে ধরেছিল। তারপর ১৭ নভেম্বর মেয়ের জেএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই কয়েকজন যখন জানতে চাইলো, পরীক্ষা শেষ হলে মেয়েকে কী কী কোর্স করাবেন, তখন অন্য ধরনের ভাবনায় পড়লাম। ভাবলাম, আমি মনে হয় এই যুগের মায়েদের মতো কেয়ারিং ও লাভলী মা হতে পারলাম না।
দুই ধরনের ভাবনার দোলাচলে দুলতে দুলতে, সকল প্রকার কোর্সকে পিছনে ফেলে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে ১৫ দিনের ট্যুরে রওনা হয়ে গেলাম মা এর বাড়িতে। আসার পর মেয়ে বললো, নিচের বাসার আপুর কাছ থেকে ক্লাস নাইনের বইগুলো এনে দেখবো কী কী আছে?
বললাম, না। এখন গল্প ও কমিক্সের বই-ই পড়ো। রেজাল্টের পর স্কুল থেকে বই দিয়ে ক্লাস শুরু করলে তারপর ক্লাসের পড়া পড়তে পারবা। কিন্তু এর মাঝে শুনলাম অনেকেই তার ছেলেমেয়েদের বিভিন্ন কোর্স শেষ করিয়ে ফেলেছে। অনেকে আবার পরবর্তী ক্লাসের বই সংগ্রহ করে টিচারের কাছে পড়াতেও শুরু করে দিয়েছে। আরেকটা ধাক্কা খেলাম।
আমি কি আমার মেয়েকে পিছনে ফেলে দিচ্ছি?
যাই হোক। আমার সকল প্রকার বন্ধু-বান্ধবী, পরিচিত, কলিগদের কার কার বাচ্চা পিএসসি ও জেএসসি দিচ্ছে, আমি চেষ্টা করেছি খেয়াল রাখতে। মাঝে মাঝে বাচ্চাগুলোর মাদের ছেলেমেয়েদের প্রতি ডেডিকেশন দেখে সত্যি খুব হীনমন্যতায় ভুগতাম, আহারে! আমি তো আমার মেয়ের জন্য কিছুই করছি না।ওর কী হবে?
তবে কয়েকজন গার্জিয়ানকে আমি খুব খেয়াল করেছি। তার মাঝে একজন জেএসসি দেয়া মেয়ের প্রতি খুব বেশী খেয়াল করতে গিয়ে পিএসসি দেয়া ছেলেকে একটুখানি স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমি খুব অবাক হয়ে দেখেছি, ছেলেটা তাকে দেয়া স্বাধীনতার পূর্ণ ব্যবহার করেছে, তার যেটুকু প্রয়োজন সেইটুকুই নিয়মিত পড়ে। নিজের মতো করে খাওয়া দাওয়া, খেলাধুলাও করে।
মজার বিষয় হচ্ছে ২৯ ডিসেম্বর রেজাল্ট হওয়ার পর দেখা গেল, ছেলেটা সব সাবজেক্টে এ+, মেয়েটার দুটো সাবজেক্টে এ+ ছুটে গিয়ে এ্যাভারেজ জিপিএ-৫পেয়েছে। একই ঘটনা আরো কয়েকজনের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। এর ফলে পরের যে কান্নাকাটির দৃশ্য, সেদিকে না হয় নাই গেলাম। একই ধরনের ঘটনা আরও আছে।
দেখা গেছে, ক্লাস টাইমের বাইরেও একজন তিন-চার ঘন্টা শিক্ষকের কাছে পড়েও যে রেজাল্ট করছে, আর একজন নিজের মতো করে পড়ে তার থেকেও ভালো রেজাল্ট করছে।
আমি কোন বিশারদ না। এই লেখার জন্য সচেতন ও সংবেদনশীল মায়েদের কাছ থেকে কী পরিমাণ গালি খেতে হতে পারে, তাও অনুমান করতে পারছি। তারপরও বলি, আমাদের একটা ভাবনাই ভুল যে, জীবনে আমি যা করতে পারিনি, তা আমার ছেলেমেয়েদের দিয়ে করিয়ে ছাড়বো। এখনকার ছেলেমেয়েরা এমনিতেই অনেক ম্যাচিউরড। ওদেরকে ওদের মতো করে বেড়ে উঠতে দিলে খুব বেশি ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না। বরং স্বাধীনতা যে ওদেরকে অনেক বেশি রেসপন্সিবল করে তুলবে তার শত ভাগ প্রমাণ ওরা দিতে পারবে।
লেখাপরা নামক খাঁচায় পোরা শৈশব, কৈশোরের যাতনায় আর্তনাদ করে বলবে না,
“Give me some sunshine
Give me some rain
Give me another chance
To grow up once again.”
আমরা মা। সন্তানের ভালোমন্দ আমাদের থেকে আর কেউই ভালো বুঝবে না। আমরা তাদের বিষয়ে সচেতন থাকবো, সংবেদনশীল হবো, এটাই স্বাভাবিক। তারপরও দেই না একটু ওদেরকে ওদের মতো করে বেড়ে উঠতে! আমরা শুধু খেয়াল করি, গন্তব্যে পৌঁছতে ভুল বা আঁকাবাঁকা কোনো পথে পা বাড়াচ্ছে কীনা। যদি বাড়ায়, তখন না হয় শুধু ধরিয়ে দেবো, প্রয়োজনে শুধরে দেবো।