সৃষ্টিশীলতার দৈন্য এবং একজন সাজু খাদেম

শিল্পী জলি: কিছুদিন আগে জান্নাতুন নাঈম প্রীতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাগিং নিয়ে প্রতিবাদ করায় তুমুল হৈ চৈ হলো–কেউ বললেন, তিনি কেন ফেসবুকে লিখলেন, কেউ বা বললেন ‘বেশী পাকা’, কেউ বললেন, বিখ্যাত হবার ফন্দি, কেউ বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এলে দেখে নেবে!

যেন পূর্ণ বছরের একটি মেয়ে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেও অন্যের পরামর্শ নিয়ে অন্যের ভাষায়ই করতে হবে।সম্প্রতি সাজু খাদেম টিভির একটি অনুষ্ঠান উপস্হাপন করতে গিয়ে চার তরুণীকে প্রশ্ন করেন, বরিশালে দুধের উপর যেটা পরে, ওটাকে কী বলে?

একটি মেয়ে স্তন সংক্রান্ত প্রশ্ন ভেবে চুপ থাকে, দু’টি মেয়ে কিছুটা থমকে গিয়ে গরুর দুধ ভেবে বলে, সর, একটি মেয়ে হেসে এড়িয়ে গিয়ে স্বাভাবিকতা আনার চেষ্টা করে। তারপরও মাথামোটা সাজু খাদেম বুঝতে পারেন না বিষয়টি তাঁরা এড়াতে চাইছেন, অস্বস্তি ফিল করছেন–আজকের আলোচনার টপিক ভিন্ন।

জনাব মেয়েগুলোকে বেকুব মনে করে নিজেই বলেন, ব্রা বলে। সেই সাথে আরও জুড়ে দেন, চারজনই আজ ব্রা (সর) পরে এসেছে, হে হে হে। অতঃপর নিজেই লজ্জায় রাঙা হয়ে হাত দিয়ে নিজের মুখটি ঢাকেন। হাসি অব্যাহত থাকে!

মানুষের সৃষ্টিশীলতার কতটা দৈন্যদশা হলে একজন উপস্হাপকের সামান্য পরিধেয় বস্তুর নামেই হেসে গড়িয়ে পরে কার্যক্রম চালাতে হয়, ভাবতেই আমার মাথা কয়েকবার শূন্য হয়ে গিয়েছে। ফজলে লোহানী, আনিসুল হক এরাও উপস্হাপক ছিলেন, আর এই সাজু মিঞাও– যার সামাজিকতা, জব এথিক্স, এবং টপিক্স সম্পর্কে মিনিমাম আইডিয়াটুকু নেই।

ওদিকে মেয়েগুলোকে বলা হচ্ছে–তারা কেন হাসলো, আরও কড়া হলো না, জুতা মারলো না!

ছোটবেলায় আমরা অনুশীলন করি, বোবার শত্রু নেই, বড়দের মুখে মুখে তর্ক করতে নেই, মেয়েদের বেশি কথা বলা ভালো না, আর সেইসাথে থাকে মেয়েদের ইজ্জত রক্ষা করার ভয়াবহ চাপ।

বলতে বাধা নেই, যতো ইজ্জত সবই ওই বুকে আর হিপে, বর্তমানে চুলেও। ইজ্জত রক্ষায় উক্ত বস্তু ঢাকতে ঢাকতে মেয়েদের মানুষের পরিচয়টিই বিলুপ্তির পথে। সেই বস্তু নিয়ে যদি হঠাৎ করে কেউ বিব্রত করতে রিজিক সংস্হায়ই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, তখন সাড়ে পঁচিশ চক্কর খায় মানুষের মাথা। ঐ অবস্হায় কোন মেয়ে কী আচরণ করলো না করলো সেটা নিয়ে কটাক্ষ চলে না, বরং যার বডি যেভাবে রিয়্যাক্ট করে, ওটাই তার প্রতিবাদ এবং আত্মরক্ষার পদ্ধতি।

বেশ কিছুদিন আগে আঁখি আলমগীরকে টিভি’র একটি লাইভ অনুষ্ঠানে জঘণ্য এবং ভয়াবহ ভাষায় রেপ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। দুঃখের বিষয় ভিডিওটি এখনও অনলাইনে রয়েছে। চাকরিক্ষেত্রে মেয়েদের যৌন হয়রানি হওয়া অতি ভয়াবহ একটি বিষয়, সংস্হার অযোগ্যতা। অথচ আমাদের দেশে এর গুরুত্ব হয়তো অনেকেই অনুধাবন করতে পারে না–এগুলো একটি জাতির জন্যে খুবই লজ্জার বিষয়। কেননা এগুলো প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং অকার্যকারিতার লক্ষণ।

দেশে মাঝে মাঝেই প্রতারকরা মেয়েদেরকে ব্ল্যাকমেইল বা সামাজিকভাবে হেয় করতে নগ্ন ভিডিও বা যৌন মিলনের ভিডিও বাজারে ছেড়ে দেয়। আর তাই দেখে জনগণ মেয়েটির বদনামে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। একবারও ভাবে না মেয়েটি হয়তো জানতোই না, হয়তো তার অনুমতি ছাড়াই ওগুলো পাবলিক হয়েছে, ঐ একটি ভিডিও একটি মানুষের পুরো জীবন নয়,

জীবনেরও হাজার দিক আছে।

জীবের যৌনতা একটি প্রাকৃতিক বিষয়। মানুষের ক্ষেত্রে ঐ একই কাজে সামাজিকতা এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে সভ্যতার কিছু মাপকাঠি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে ঐ নিয়মনীতি আরও বেশী, যেন তারা একজন পুরুষের বশ্যতা স্বীকার করে নেয় এবং কোন অন্যায়ে সহসা ফোঁস করে না উঠে!

অতি চাপে থেকেও যুগ যুগ ধরে ঐ নিয়ম মেয়েরা চুপচাপ মেনে এসেছে বলেই তাদের আজ এই অবস্হা– নিজের শরীরটিও যেনো একটি লজ্জার বস্তু, পাপ। যেনো সে কোন মানুষই নয়, শুধু বুক, হিপ, আর ভার্জিনিটির হিসেব-নিকেষ। তাইতো পূজার মত বাচ্চা মেয়েরও রেপ হলে তার স্বপ্ন হারিয়ে যায়– মানুষটি যেন আর মানুষ থাকে না।

পড়েছিলাম পাঁচ বছরের পূজা চিকিৎসার পর সুস্হ হয়ে উঠছে, হাসছে, লিপস্টিক দিয়ে সাজছে,…। বেশ ভালো লেগেছিল। ভাবছিলাম, সে এখনও বাচ্চা, ভালোই হয়েছে–এখনও সমাজের ভাষা শেখেনি। তাই সামাজিক চাপাকল বা কুসংস্কারে সংকুচিত হয়ে তাকে অন্যের পাপে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগতে হবে না। অথচ কিছুদিন আগেই পড়লাম, পূজাকে দেশের বাইরে দত্তক দিতে তার বাবা-মায়ের আপত্তি নেই।

কেমন দেশ আমাদের যেখানে বাবা-মাও ভাবতে বাধ্য হন যে, একটি শিশু ধর্ষিত হলে দেশে তার কোন ভবিষ্যত নেই? একটি সুস্হ, স্বাভাবিক, এবং সুন্দর জীবনের সম্ভাবনা নেই? অথচ অন্য একটি দেশে‍ ঐ মেয়েটি ভালো থাকবে, এমনকি অতি আপন বাবা-মাকে ছেড়েও! মেয়েদের জীবন কি শুধুই স্তন, যোনি, এবং তার সুরক্ষিত স্ট্যাটাস দ্বারা নির্ধারিত?

দেশে দিন দিন মেয়েদের উপর বস্ত্রের প্যাঁচ যেভাবে চড়ানো হচ্ছে, তাতে মনে হয় কিছুদিন পর তাদেরকে বস্তায় বেঁধে একদল পুরুষজাতি হাঁটবে, আর সাজু খাদেমের মতো আরেক দল মেয়েদের কোনটিকে পেটিকোট, ব্লাউজ, বা ব্রা বলে তার নাম মুখস্ত করবে। আর ঐ চাপে চাপা পড়ে একদিন মেয়েরা হয়তো আবার আলোর মুখ দেখারই সুযোগ পাবে না।

নারী-পুরুষের ভালোবাসায় নারীর গর্ভে জন্ম নেয় মানব সন্তান। তাদের কেউ নিকৃষ্ট নয়, এটা কোন অপকর্ম নয়–প্রাকৃতিক নিয়ম। এখানে দেশীয় আইন সমতা রক্ষায় নিয়োজিত। সম্পর্কের সঠিক এবং একমাত্র বিধিনিষেধ হলো, যেন তুমি-আমি-আমরা ভালো থাকি, যদিও আইনে নানাবিধ ফাঁকফোকর রেখে পুরুষজাতি আজও বাড়তি সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে।

তাই সাজু খাদেম এবং সাজুর মতো কোটি সাজু বাড়িতে তার মা-বোনকে মানুষ হিসেবে যোগ্য মর্যাদা পেতে দেখেনি। দেশের স্কুলও তাদেরকে শেখায়নি একটি মেয়েকে কী করে সম্মান প্রদর্শন করতে হয়?

পুরুষের যৌন উদ্দীপনা এবং আকাঙ্ক্ষা অহরহ হলেও সেখানে কী করে সভ্যতার প্রলেপ দিতে হয়?

কেন মেয়েদের শরীর ছোঁবার আগে তাদের মন ছোঁয়া জরুরি?

আমাদের ছোটবেলাতে একটি বানান ভুল হলে দশবার লেখানো হতো, যেনো ইহজন্মেও আর ভুল না হয়। সাজু সাহেবকে উপস্হাপকের কাজ থেকে হটিয়ে ব্রা বিক্রেতার কাজে নিয়োগ দেয়া হোক, যেন সে বুঝিতে পারে উহা পরিধেয় বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়।

এক সাজুর সাধারণ একটি বস্ত্রের প্রশ্নেই চার মেয়ে দিশেহারা। তাহলে রেপের মুখে একাকি একটি মেয়ের কী হাল হতে পারে?

মেয়েদেরকে তার শরীর সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী হতে শেখানো জরুরি–শরীরে হাড্ডি, মাংস, খুঁত,… যা কিছু বিদ্যমান তা নিয়ে গর্বিত হওয়া, এবং নিয়মিত নিজের মতামতের স্বাধীন চর্চা করা। তাহলেই তারা প্রয়োজনে রুখে দাঁড়াতে শিখবে, বিপদে দিশেহারা হবে না, নিজেকে সুরক্ষা করতে পারবে।

অন্যের তালে তালে তাল রেখে যারা বড় হয়, তারা বেতালে পথ হারায়। জীবন কোনো সরল রেখা নয় যে অন্য কেউ সেই পথ দেখিয়ে দেবে।

শেয়ার করুন: