কাজল দাস: আমার খুব কাছের একজন বন্ধু ওড়নাকে ব্যাঙ্গার্থে ‘সোসাইটি’, বলেন। আমি তাকে হাসতে হাসতে বলেছিলাম, আপনি ওড়নাকে ‘সোসাইটি’ বলছেন কেন? তিনি আমাকে বললেন, নারীকে বুক ঢেকে না রাখলে এই সমাজে তাঁর ইজ্জত চলে যায়। বুকে ওড়না ঝুলিয়ে, ইজ্জত ঢেকে মেয়েদেরকে সমাজ রক্ষা করতে হয়, তাই আমি এটাকে ‘সোসাইটিই’ বলি। তাঁর ভাষায় ‘গলায় সোসাইটি ঝুলিয়েছি।‘
কথাটি আয়রনি শোনালেও, আমাদের সমাজের জন্য একেবারেই সত্যি। এই সমাজের ইজ্জত নারীর বুকে কাপড় থাকা বা না থাকার উপরেই বিদ্যমান।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অতিমাত্রায় ধর্মের প্রাধান্য দেয়া, সাম্প্রদায়িকতার চর্চা করা, নারীকে স্টেরিওটাইপিং করে দেখানোর বিষয়টি অনেক বেশি পরিমাণে বিদ্যমান। এমনিতেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মাদ্রাসা, ইংরেজি আর সাধারণে বিভক্ত। এ রকম একটি শিক্ষা ব্যবস্থায় এখন ছাত্রছাত্রীদের পরিচিত করা হচ্ছে জেন্ডারভিত্তিক শব্দ দিয়ে।
চলতি বর্ষে প্রথম শ্রেণীর বাঙলা পাঠ্যবইয়ের ১২ নাম্বার পৃষ্ঠায় কোমলমতি শিশুদেরকে বর্ণ পরিচয় অধ্যায়ে ‘ও’ বর্ণ দিয়ে ‘ওড়না চাই’ শব্দটি পড়তে দেয়া হচ্ছে।
সর্বজন মহল থেকে এই শব্দটি নিয়ে এখন আপত্তি তোলা হয়েছে, এটা বাদ দিতে বলা হচ্ছে। আমিও মনে করি এই ধরনের শব্দ অবশ্যই বাদ দেয়া উচিত। শুধু তাই নয়, নারীকে খুব স্থূল ও ‘আদার’ হিসেবে বর্ণনা বা চিত্রিত করে এই ধরনের সকল পাঠ্যক্রম থেকেই আমাদের বের হয়ে আসা উচিত।
একটি শিক্ষা ব্যবস্থায় কোমলমতি শিশুদের জন্য এই ধরনের শব্দ দিয়ে পরিচিতি কখনোই কাম্য নয়। বাচ্চাদের সব সময় শিক্ষা দিতে হবে কমন বিষয় দিয়ে, দুইটা ছেল-মেয়ে যখন পড়বে, তখন তারা যেন, নারী-পুরুষের লিঙ্গের পরিচয় শিখে সেটা খেয়াল রাখতে হবে, কখনো তাদেরকে জেন্ডার বৈষম্য প্রকাশ পায় এমন শব্দের সাথে পরিচয় করানো ঠিক না, এই যে শব্দ ‘ও’ তে ওড়না চাই, এখন এই বাক্য দিয়ে তারা কী শিখবে?
একটি মেয়ে শিখবে, এই কাপড়টি মেয়েদেরকে পরতে হবে, আর ছেলেটা শিখবে এই কাপড়টি মেয়েদের জন্য বরাদ্দ। এই বিষয় থেকে শুধুমাত্র জেন্ডারভিত্তিক শারীরিক পরিচয় দিয়ে তারা নারী বা পুরুষ বিষয়ে ধারণা লাভ করবে। একইভাবে তারা যদি তাদের শিক্ষককে বলে- ‘স্যার , ওড়না কী, তখন এই শিক্ষকও তাদেরকে যে বিষয় বুঝাবেন, আদতে ঐ মেয়ের ওড়না পরার প্রয়োজনীয়তাটাই তুলে ধরবেন, এটা যে মেয়েদেরকেই কেবল পরতে হবে, সে বিষয়ই তুলে ধরবেন।
একটি শব্দ কেবল শুধুই শব্দ নয়। এটি কিছু অর্থকে সিগনিফায়িং করে। এই যে ওড়না, এটি নিছক শব্দ অর্থে ভাবা যায় না। তার সাথে একটি মেয়েকে সামাজিকভাবে কীভাবে দেখা হচ্ছে, সেটিও খুব ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আমাদের সমাজে মেয়েরা ওড়না ব্যবহার করে নিজের বুক ঢেকে রাখার জন্য। এই বুক ঢাকা না ঢাকার সাথে একজন নারীকে সম্মান বা অসম্মান করার বিষয়টি নিহিত।
একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে একটি গোটা অর্থে যৌন প্রাণী মনে করা হয়। তার শরীরের উপর সমাজের অনেক বিধি-নিষেধ চাপিয়ে দেয়া হয়। এইগুলো দিয়ে আসলে তাকে একক পুরুষের যৌনবস্তু হিসেবে গড়ে তোলা ও উত্তরাধিকারের জন্য ধারাবাহিক পরিচয় বলবৎ রাখার কাজটি করা হয়। সেজন্য নারীকে সতী বা পবিত্র রাখার প্রয়োজনে তার উপর নানান ধরনের বিধান চাপিয়ে দেয়া হয়।
‘স্তন’ নারীর শরীরের একটি অঙ্গ। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এটাকে নারীর লজ্জাংগ হিসেবে দেখা হয়। এই লজ্জা আবার কেবল একার নারীরই, লজ্জা তাকেই পেতে হয়, তাকেই অসম্মানিত হতে হয়। আমাদের সমাজে কোনো অবিবাহিত বা বিবাহিত নারীকে এই ওড়না না দেয়ার জন্য অসম্মানের চোখেই দেখা হয়। এই যে লজ্জা বা সম্ভ্রমের চিন্তা এর কোন দায়ই নারীর নেই, সেটা পুরুষ, পুরুষতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া বিষয়।
এই যে ওড়না, এটা একটা প্রতীক। এইসব প্রতীক উদ্ভূত হয়েছে নারীকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ভেতর দিয়েই। একইভাবে নারীর জন্য হিজাব, বোরকা, তার হাতে শাঁখা, কপালে সিঁদুর, পায়ের ঘুঙ্গুর এইগুলোই সমাজে এসেছে তাকে অবদমিত করার জন্য। দিন দিন সমাজের মধ্যে নারীকে যে বৈষম্যমূলকভাবে দেখার একটি মানসিক কাঠামো গড়ে উঠেছে, তার ভিত রচিত হয়েছে এইসব সিম্বলিক বিষয়ের মধ্য দিয়েই।
দুইজন নারী-পুরুষ বিয়ে করেন, অথচ স্ত্রীকেই বিয়ের স্মারক হিসেবে ‘সিঁদুর’ পরতে হবে, কিন্তু স্বামীকে কোন পরিচয় বহন করতে হয় না। এই যে নারীকে ‘বিবাহিত’ বলে পরিচিতকরণের একটি আইডেনটিটি, সেটা নারীকে অধঃস্তন করে রাখার জন্যই হয়েছে।
একইভাবে ওড়না নামক পোশাকটি দিয়ে নারীর স্তনের প্রতি পুরুষতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি তথা নারীর শরীরকে পুরুষের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে দেখার প্রাধান্যই নিহিত। এটি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় একটি পরিধান হওয়া সত্ত্বেও কেবল পুরুষ নারীর ‘স্তনকে’ তার সম্ভ্রম বলে বিবেচনা করে বলেই তাকে পরতে হচ্ছে।
সমাজে নারীকে আদারিং করার বিষয়টি মূলত ঘটে সেক্স রোল সোশালাইজেশন বা সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে। এটা জেন্ডারভিত্তিক। ছেলে বড় হয়ে কী করবে, আর মেয়ে বড় কী করবে, এই রোল স্পেসিফিকিকরণ হয় মূলত সেক্স রোল সোশালাইজেশন দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের ধারণা তৈরি হয়েছে, নারীকে যৌন অবজেক্ট হিসেবে দেখতে হবে। তাঁকে পুরুষের চেয়ে অধঃস্তন হিসেবে দেখতে হবে।
আর এই সোশালাইজেশন যতভাবে সমাজে প্রমোটেড হয় তাঁর একটি অন্যতম মাধ্যম হলো শিক্ষা ব্যবস্থা। সেজন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি নারীকে স্টেরিওটাইপিং করে শিশুদের কিছু শেখানো হয়, তাহলে সেটা তারা পরবর্তীতেও সত্যি ও বিবেচ্য বলে মনে করে। আমাদের উচিত শিশুদেরকে এইসব যৌনতাবাচক স্টেরিওটাইপিং থেকে বিরত রাখা।