এ কেমন মূল্যবোধ!!!

সাফী নেওয়াজ শিপু: ধর্ম যার যার উৎসব সবার-এই কথাটির সাথে আমরা এখনোও মনে হয় পরিচিত হতে পারি নি। আমরা শুধু মুখেই বলি আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ এবং প্রত্যেক ধর্মের উৎসবগুলো আমরা আনন্দের সাথে উপভোগ করি।

যদি তাই হয়, তাহলে কেন এতো মাতামাতি ধর্ম নিয়ে, কেন এত রেষারেষি? যখন দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ চলেছিল দেশ স্বাধীনের লক্ষ্যে, তখন তো কেউ ধর্মের নিরিখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েনি! নানা ধর্ম, বর্ণ, বয়স আর পেশার মানুষ নিজের জীবন বাজী রেখে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল শত্রুর মুখ থেকে। তখন কে মুসলিম, কে হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এগুলো উহ্য রেখে সবাই তার দেশপ্রেম ও মানবতাবোধ জয় করে এনেছিল।

আজকে ধর্ম নিয়ে লেখার একমাত্র কারণ হলো, সম্প্রতি কলকাতার জনপ্রিয় রেডিও জকি ও কমেডিয়ান মীর আফসার আলী ফেসবুকে বড়দিনের শুভেচ্ছা প্রকাশ করে তীব্র রোষের মুখে পড়েছেন ভক্তদের। তাও আবার বাংলাদেশি প্রতিক্রিয়াশীলদের।

যেখানে তিনি তার স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে নিজের একটি ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে বড়দিনে  লিখেছিলেন সবার উদ্দেশ্যে, – ‘এরা দুজনেই আমার জীবনের সান্তা, সব ফ্যান ও বন্ধুদের মেরি ক্রিসমাস’  

নিজের অফিসিয়াল পেজে যখন তিনি এই শুভেচ্ছা ও ছবি শেয়ার করেন তখনই ১২ ঘণ্টার মধ্যে ২৮ হাজার লাইক পড়ে এবং কমেন্ট করেন চার শতাধিকের বেশি মানুষ। তবে এখানেই তো শেষ নয় বরং বিপত্তি শুরু এরপর থেকেই। ছবি এবং একটি শুভেচ্ছাকে উদেশ্য করে তার ফলোয়ারদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে  আক্রমণ করে পোস্ট করতে থাকে কুরুচিপূর্ন মন্তব্য, যাদের মধ্যে অধিকাংশই হচ্ছেন বাংলাদেশী। যেখানে তাকে বলা হয়েছে যে, তিনি একজন মুসলিম হয়ে  খ্রিস্টানদের উৎসব পালন করতে পারেন না এবং সেই তিনি নাকি পাপের কাজ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। এটি কেমন ধরনের কথা যেখানে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের উৎসবে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন বা অংশ নিতে পারবে না? প্রত্যেকটি ধর্মেই একে অন্যের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথা লেখা আছে। এরপরও আমাদের মাঝে এতো হিংসা আর সহিংসতা বিরাজমান। আমরা কি বুঝে নাকি না বুঝে আমাদের মানবতা নষ্ট করছি ঠিক বোধগম্য নয়।

সাফী নেওয়াজ শিপু

কেউ যদি অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করে সেই ধর্মের অনুসারীদের উৎসবের শুভেচ্ছা জানায় তবে তার মানে এই নয় যে, সে ঐ ধর্মের অনুসারী হয়ে গেলো বা নিজের ধর্মকে অশ্রদ্ধা করলো। মীরকে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছেন, তিনি যাতে তওবা করে সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ চান। পাল্টা জবাবে মীর জানিয়েছেন, বড়দিনের উৎসব সবার। তিনি আরও বলেন যে, “বড়দিনের উৎসব যতটা আমার, ততটাই তোমার”তিনি ইচ্ছে করলে পাল্টাভাবে বাজে উত্তর দিতে পারতেন সেই ফলোয়ারদের উদ্দেশ্যে, কিন্তু তিনি তা না করে বরঞ্চ আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, ধর্মের কারণে মানবতাকে নষ্ট করা উচিত না, এবং প্রত্যেকটি মানুষেরই মৌলিক অধিকার আছে যার মাধ্যমে আমরা আমাদের মতামতকে স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারি।  

মীরের এ শুভেচ্ছার মাধ্যমে তিনি তার দেশকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা এক কথায় অতুলনীয়। তিনি জানিয়েছেন, ভারতে প্রত্যেকটি ধর্মীয় উৎসবকে সমানভাবে তারা উপভোগ করেন এবং সেই সাথে শ্রদ্ধাও করেন। আর আমার দেশের কিছু উগ্র ও নিম্ন মন-মানসিকতার মানুষ সেটাকে বাজে ভাবে উপস্থাপন করলো মৌলবাদী মন্তব্যের মাধ্যমে।

এসব মানুষের জন্য পুরো দেশকে বদনামের ভাগীদার হতে হয়। উগ্রবাদী ঐসব মানুষ দেশকে বাজে ভাবে উপস্থাপনে ব্যস্ত সবসময়। আসলে আমরা ভুলে যাই যে, এই ধর্মের কারণে আমরা আমাদের মানবতাবোধ এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব খুয়ে দিচ্ছি দিনকে দিন। আজকে আমরা সারা বিশ্বে নিজেদের ইমেজ নষ্ট করছি উগ্রপন্থি চিন্তার কারণে এবং সেই সাথে নিজেদের সংস্কৃতি, চিন্তাধারা ও মূল্যবোধকেও করছি প্রশ্নবিদ্ধ।

শেয়ার করুন: