সবকিছুরই একটা লিমিট থাকা দরকার

দিনা ফেরদৌস:

কোন ভালো বিষয় নিয়েও যদি অতি বাড়াবাড়ি করলে তার গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। আর মন্দ বিষয় নিয়ে করলে তা পঁচে যায়। তাই সবকিছুরই একটা লিমিট থাকা দরকার আছে।
কাউকে অপছন্দ করলে, উঠতে বসতে তার সব কিছুতে দোষ খুঁজে বের করা যেমন ঠিক না, তেমনি কাউকে ভালোবাসলেও উঠতে বসতে সবকিছুতে প্রমাণ দেবার দরকার হয় না। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, নিজে যা ভাবি, যা বুঝি, তা নিয়ে অন্য সবাইকে ভাবিয়ে তুলি বা জোর করে বুঝিয়ে দিতে চাই। একবার চিন্তাও করি না, আরেকজন ব্যাপারটাকে কীভাবে গ্রহণ করছে। তোমার সবকিছু যখন অন্যকে দেখানোর জন্যে করছো (যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করছো), তখন এইকথা বলার জায়গা নেই যে, কে কী ভাবলো বা না ভাবলো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। অন্যদের ভাবিয়ে তোলার জন্যেই তো এই প্রকাশ, যাবে আসবে না বললেই হলো? তাহলে নিজের কাছেই রাখতে পারতে!

এই সত্যিটা আমরা সকলেই বুঝি, যার যেটা আছে সে সেইটা নিয়েই হাজিরা দিতে চায় সমাজে। তা প্রেম হোক বা প্রতিভা, রূপ বা যৌবন, টাকা, নামডাক বা ক্ষমতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা বা ভালো জব ক্যারিয়ার। আমরা যা দেখি, দেখি না, তার চেয়েও বহু কিছু; যা কিছু মানুষ প্রকাশ করে না। কিছু কিছু জিনিস আড়ালে থাকে বলেই, আমরা মানুষের বাইরের সৌন্দর্যটা দেখেই তাকে বিচার করি যে সে’তো ভালোই আছে। ভালো থাকলে তো ভালোই, কিন্তু সেই ভালো প্রতিদিন রঙে ঢংয়ে প্রকাশ করে লাইক কমেন্টের বোঝা মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে না দিলেই কি নয়? খাইয়ে দিচ্ছেন, ঘুমিয়ে আছেন বুকে মাথা রেখে, জলকেলি খেলছেন, তো কার কী তাতে যায় আসে? আপনাদের জন্যে শুভ কামনা রইলো। কিন্তু অন্যে হয়তো ভালো মুডে নাও থাকতে পারে। ভাবছেন যে তার আপনার মতো প্রেম নেই তাই হিংসায় আপনার পুতুপুতু ছবিতে লাইক/কমেন্ট করেনি সে। আপনার আছে তো ওই একটাই , তাই কার কার এইটা নেই তা নিয়ে আপনার ঘুম হারাম। চোখ আর একটু প্রসারিত করুন। তাকিয়ে দেখুন তার এমন কিছু আছে, যা আপনার নেই। সে যা করছে, যা করতে চায়, তার সেই জায়গায় হতাশা থাকতেই পারে, তার রঙিন ছবি তোলার স্বপ্ন নাও থাকতে পারে। সে যা ফোকাস করতে চায়, তা হয়তো আপনার মগজের পক্ষে বুঝতে পারা অসম্ভব, আর বুঝে থাকলে তো কারা কারা আপনার ছবিতে লাইক কমেন্ট করে না, তা নিয়ে মাথাব্যথা থাকার কথা নয়।
এছাড়াও দৈনন্দিন জীবনে আমাদের বহু কিছু নিয়ে ফাইট করতে হয় প্রতিদিন। ঘটনা দুর্ঘটনা তো আছেই; পরিবারে, বন্ধু মহলে কিছু ঘটলে মানুষের মন খারাপ করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। তখন ভালো জিনিসও ভালো নাও লাগতে পারে।

কথায় আছে, “ভালোবাসা ভালো বটে অতিশয় নয়, অধিক বাসিলে ভালো চিরদিন নাহি রয়”। কার ভালোবাসা থাকবে বা বিচ্ছেদ ঘটবে তাতে কারো কিছু যায় আসে না, মানুষ সাময়িক বলে বিনোদন নেয়, আড্ডা জমায়, আবার ভুলেও যায় একি প্রসঙ্গ বার বার সামনে না আসলে। তবে কথা হচ্ছে, আমাদের কিছু মুহূর্ত অন্তত, একান্ত নিজেদের জন্যে থাকা উচিৎ উইদাউট পাবলিসিটি।

একবার চেষ্টা করেই দেখুন আজকের দিন শুধুই নিজেরা উপভোগ করবো, কাউকে না জানিয়ে, দেখবেন অসম্ভব সরল আর সৌন্দর্যে ভরে উঠবে সেই দিন। কোন চাপ কাজ করবে না, আপনাদের দেখতে আজকে কেমন লাগছে (অতিরিক্ত মেকাপের ঝামেলা থেকে মুক্ত, অন্যদিকে জামা বাছাই করতেও সমস্যা হবে না), না হলে মনের মধ্যে কাজ করবে আগে এই জামা দিয়ে একবার ছবি দেয়া আছে, এখন অন্য জামা পরে যেতে হবে, যা অতিরিক্ত সময় নষ্ট করে। আবার ধরেন রেস্টুরেন্টে খেতে গেছেন, খাবার আসতেই, চোখের সামনে খাবার রেখে আগে খাবারের ছবি তুলে রাখার এক ঝামেলা। মাঝে-মধ্যে সরল জীবন যাপন করারও দরকার আছে। সারাক্ষণ প্রতিযোগিতা আর দেখানোর মধ্যে কেউ যদি শান্তি খুঁজে পায়, তো বলার কিছু নেই।

এই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি কিন্তু হতাশারও কারণ বটে। ফলে এক প্রেম আর সুখের সংসারে হাবুডুবু করতে করতে যখন চোখের সামনে দেখলেন কেউ এইসব ছাড়াই অন্য কোনো যোগ্যতা নিয়ে সকলের সামনে চলে আসছে, যা আপনার নেই বা চেষ্টা করলে হতে পারতো, তা দেখেই আপনার জ্বলা শুরু হয়ে গেলো। লেগে পড়লেন তার পিছনে, সব থাকলে কী হবে, আমার মতো ওর তো সংসার নেই, সংসার থাকলে বাচ্চা নেই, বাচ্চা নাই বলেই ঝাড়া হাত-পা, যা ইচ্ছে তাই করতে পেরেছে ও। তো সংসার করলেই যে সকলে সুখী হয়ে যাবে তার নিশ্চয়তা আপনাকে কে দিয়েছে? আপনার নিজেই তো সারাক্ষণ সুখ দেখানোর জন্যে ব্যস্ত, কোনদিন উপভোগ করেছেন? দেখেন সুখের সংসারের ওজন কেমন। সারাক্ষণ সুখের প্রমাণ দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়, বহু পরিশ্রমের কাজ । যাই হোক “পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি”। চালিয়ে যান…

তবে হিংসা করা বাদ দেন, যদি সত্যিকারের ভালো থেকে থাকেন। আমি আজ পর্যন্ত যতো জনের সুখের সংসারে ছবি দেখেছি, তাদেরকেই দেখেছি, অন্যদের যেকোন সাফল্য নিয়ে সমালোচনা করতে। যেমন ধরেন কেউ হোট করে ভালো কিছু করে ফেললো (সুন্দর বর/সুন্দরী বউ বিয়ে করে ফেললো। স্কলারশিপ পেয়ে বা না পেয়ে, বিদেশ চলে গেলো হঠাৎ করে, এখন কীভাবে গেলো, কেন গেলো, সঠিক রাস্তায় না বেঠিক রাস্তায় ব্লা ব্লা ব্লা… বহু বছর পর বাচ্চা হওয়ার খবর শুনে, টেস্টটিউব বেবি না সারোগেট মাদার, নাকি বাচ্চা পালক নেয়া হয়েছে? ভালো চাকরি পেয়ে গেলো, ঘুষের টাকায় না মামা চাচা ধরে?)। কথা হচ্ছে, তোমার খেয়ে তার কিছু হয়েছে নাকি? সবকিছু করতেই যোগ্যতা লাগে বাপু। কী কারণে বা কোন হতাশায় সঠিকটা জানার আগেই তাকে নিয়ে সন্দেহজনক মন্তব্য করেই ফেললে তা তুমি যেমন বোঝো, অন্যরাও বোঝে, শুধু তোমাকে বলে না আর কী। যদি কেউ অন্যায় কিছু করে থাকে আর তোমার হাতে প্রমাণ থাকে তবেই বলতে পারো, পারলে আইনি পদক্ষেপও নিতে পারো। কিন্তু শুধু শুধু তোমার তার মতো যোগ্যতা নেই, আর তোমার পোস্টে লাইক/ কমেন্ট করে না বলে, হুট করে না জেনে মন্তব্য করা ঠিক না। ফলে তোমার ব্যর্থতা আর হতাশার চিত্রই ফুটে উঠে।

আমরা আবেগপ্রবণ জাতি, আবেগ আমাদের দিয়ে ভালো মন্দ দুই-ই করায়। তবে আমাদের সব সময় শুধু আবেগ দিয়ে নয়, নিজের বিচার বুদ্ধি খাটিয়েও কিছু ভাবা বা করা উচিৎ। কে কীভাবে তার জীবন যাপন করবে তা নিয়ে বলার কিছু নেই। ভালো থাকলেই ভালো। তবে সারাক্ষণ যদি প্রমাণ আর পরীক্ষা দিয়ে ভালো থাকতে হয়, তবে জেনেশুনে যারা ভালো নেই, তারা আমার কাছে মনে হয়, এরচেয়ে বেশি ভালো আছেন। কারণ তাদের বিষয়ে কমবেশি সকলের একটা ধারণা থাকার কারণে বাড়তি টেনশন নিতে হচ্ছে না। আর এতো ভালো থেকেও তুমি আরামে ঘুমাতে পারো না, কার বিয়ে হয়নি, কার বাচ্চা হচ্ছে না, কে কার সাথে প্রেম করে, কার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে, বিচ্ছেদের পর কে আবার সঙ্গী খুঁজে পেয়েছে, কার চলন বাঁকা, কার বলন বাঁকা, এই সবকিছু চব্বিশ ঘন্টা তোমাকে ভাবিয়ে রাখে, তো লাভটা হলো কী? আসলে তুমি ভালো নেই। দুনিয়ার মানুষের মন্দ দিক খুঁজে বের করে, সেইখানে নিজেকে প্রতিযোগী বানিয়ে, নিজের মনে জিতে গিয়ে, সবাইকে দেখিয়ে দেবো বলে, এই মুহূর্তে সুখে থাকার যেই ছবি প্রকাশ করছো, জেনে রেখো তা নিয়েও তোমার মতো অন্যরাও কথা বলে, হাসে পিছনে।

প্রত্যাশা রাখি সকলেই ভালো থাকুন। যেটা ভালো, সুন্দর সেটাই প্রকাশ করুন। তবে সব কিছুর একটা লিমিট রাখুন। প্রত্যেকেই কোন না কোনদিকে সমৃদ্ধ আছে, যা তারা প্রকাশ করেন না বলে আমরা জানি না। তবে সত্যিকারের প্রতিভা চাপা দিয়েও রাখা যায় না, তার প্রকাশ ঘটেই। আপনাদের যাদের অন্যান্য প্রতিভা বা যোগ্যতা আছে, যারা প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক, তাদের বলবো প্রকাশ করুন। অন্যদের সাথে কোন প্রতিযোগিতায় না গিয়ে। এতে ভেতরের জীবনীশক্তি ক্ষয় হয়ে যায়। আপনার যা নেই, তা নেই বলেই, অন্যকিছু আছে, যা অন্য সকলের মধ্যে হয়তো নেই। নিজেরটাই ফোকাস করুন, তবে তা যেন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে না যায়, আমি হেন, আমি তেন, আমার এই আছে, ওই আছে, আর দুনিয়ার কারো নেই, এইসবে মানুষ বিরক্ত হয়। মানুষকে অযথা বিরক্ত করবেন না। ফলে যারা আপনার প্রশংসা করার কথা, তারাও পিছনে গালি দেবে আপনাকে। ভালো থাকুন।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.