দেশ কী বিদেশ, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন নেই  

রাবেয়া জাহান আভা: আপনি একা কেনো, ভাই কোথায়? এই লোকটা কেন যে বউকে রাতে একা ছেড়ে দেয়? আপনার পোশাকটা বাংলাদেশীদের সাথে যায় না, একটু শালীনতা থাকা দরকার। ওই মেয়েটা তো ওই ছেলেটার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাতদিন, নিশ্চয়ই ওদের প্রেম হয়েছে। তুমি বাবা-মায়ের টাকায় পড়তে আসছো, তোমার বাবাকে বলো আমাকে ঘরজামাই করে নাকি? আপনি এক্সারসাইজ ক্লাসে (ডান্স ক্লাস!) যান, যখন যান বাচ্চা কে রাখে? ভাইয়া আপনাকে ইন্সপায়ার করে? ওই মেয়েটার এরকম পোশাক পরা ‍উচিত না, দেখতে ভালো লাগে না। ওই মেয়েটা একা কয়েকটা ছেলের সাথে রাতবিরাতে ঘুরে বেড়ায়, এটা ঠিক না। উনি একটা বা দুইটা বাচ্চা নিয়ে একা এখানে পড়ছেন, কি দরকার এত কষ্টের? ভাইয়া দেশে গেছে দুই বাচ্চাসহ একা আপনাকে রেখে? আপনি সারা ক্যাম্পাস একা ঘুরে বেড়ান বাচ্চা নিয়ে, ভাইয়া সময় দেয় না, না?

রাবেয়া জাহান আভা

উপরোক্ত প্রতিটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে বা দেশ থেকে পড়তে আসা আমারই মতো কোন মেয়েকে। আর এই প্রশ্নকর্তারা হলেন আমাদেরই দেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কিছু পুরুষ ভাই যারা কিনা এখানে পড়তে এসেছেন এবং খুব দুশ্চিন্তিত তারা আপা বা ভাবীদের নিয়ে। উল্লেখ্য, এখানে যারা পড়তে আসে ছেলে বা মেয়ে যেই হোক না কেন, মেয়ে হলে আপা এবং তুমি (নাম ধরে,ছোট হলে) আর ছেলেরা পড়তে আসলে তার বউ মানে ভাবী।

এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলে রাখি, আমি যতটুকু জেনেছি বা দেখেছি এখানে অর্থাৎ থাইল্যান্ডে ছেলেমেয়ে বলে আলাদা কোন বিভাজন নেই। বরং মেয়েরা অনেক বেশি স্বাধীন। মেয়েরা রাতদিন সবসময়ই নিরাপদ চলাফেরায়। পোশাকআশাকে এরা অনেকটা স্বাধীনচেতা। খোলামেলা হলেও অনেক স্বচ্ছন্দ তারা বিষয়টিতে। এটা নিয়ে কটাক্ষ করার কোন সুযোগ নেই। যে কোন বয়সের নারীই যে কোন কিছু করতে পারে তা গান, নাচ, সাজগোজ বা ঘুরতে যাওয়া যাই হোকনা কেন, একা কিংবা সঙ্গীসহ। বাচ্চা নিয়ে একা পড়া বা জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত তারা। বাচ্চা লালনপালন ও দেখাশোনায় বেশিরভাগ মেয়েরই মা সাথে থাকে।

এখানে আসার পর গত এক বছরে আমি বা আমার মতো অনেকেরই এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে কেউ কিছু বলতে চাননা পাছে নিজের দেশের সম্মানহানি হয়। আমি নিরাপদ, সবখানে সবসময়, আমার শরীর নিয়ে কোন ভয় নেই-এই আস্থা থেকেই যখন আমি মাঝরাতে রাস্তায় হাঁটি তখন আমাকে একা হাঁটার কৈফিয়ত দিয়ে কথাগুলো শুনতে হয় আমারই দেশী ভাইয়ের কাছ থেকে যা শুধু আমাকে বিব্রতবোধই করেছে।

আমি অনেককে দেখেছি নিজেরা যখন অন্য দেশের স্বল্পবসনা বান্ধবীদের নিয়ে ঘোরেন তাতে কোন আপত্তি থাকে না কারোরই বরং তাদের কাছে এটা অনেকটা গর্বের বিষয় কারণ তারা পুরুষ। তারা তাদের যোগ্যতা বলে বিদেশী বান্ধবী জোটাতে পেরেছেন। কিন্তু একই দেশের কোন মেয়ে যখন অন্য দেশের ছেলেবন্ধুর সাথে ঘোরে তখন হয় সে নিজের দেশের মানুষের সাথে মিশতে পারে না অথবা তাদের মধ্যে প্রেম চলছে। আবার নিজের দেশের কোন একটা ছেলের সাথে ঘুরলে তাদের মধ্যে যে সম্পর্কই থাকুক কেন সেটা প্রেম বলে ধরে নেয়া হয় সহজেই। একই ক্লাসে বিভিন্ন দেশের মেয়েবন্ধুর স্বল্প পোশাক দেখে অভ্যস্ত হলেও নিজের দেশের মেয়েটি যখন ওড়না ছাড়া সালোয়ার কামিজ বা শুধু টপস আর জিন্স পরছেন, তাতে তাদের প্রবল আপত্তি।

দেশীয় সংস্কৃতি আর ধর্মীয় দিক থেকে সে বেমানান, বাংলাদেশী হিসেবে। নিজের দলের কয়েকজনের মধ্যে কোন একটা মেয়েকে নিয়ে হাটছেন তাতে কোন আপত্তি নেই কিন্তু অন্যের বউ (দেশীয় ভাইয়ের) রাতে একা হাটছে তাতে তাদের খুব দুশ্চিন্তা। অথচ এসব পুরুষরাই আবার খুব প্রশংসা করেন এই দেশের যখন রাত তিনটার সময় কোন মেয়ে একা হেটে কোথাও যায় তা দেখে। নিজের বৌকে সংসারের কাজে (এখানে এসে না করে উপায় নেই) সাহায্য করছেন কোন ক্ষতি নেই কিন্তু ভাইয়া আপনাকে অনেক হেল্প করে, না? বা আপনি আসার পর তো ভাইয়াকে আর দেখাই যায় না-বলে টিপ্পনী কাটতে বিন্দুমাত্র দেরি করেন না। তারা আবার পড়তে আসা বোন আর ভাইয়ের বউদের মধ্যেও বিভাজন তৈরী করে ফেলেন।

বউ মানে সে বাংলাদেশ আর থাইল্যান্ড কেন সবখানেই বউ। সে তো আর ছাত্রী না তাহলে সে কেন ছাত্রীর মতো সবখানে ঘুরে বেড়াবে বা যেখানে সুযোগ আছে সেখানে অংশ নেবে? কোন ছাত্রীর স্বামী এসে তার সাথে থাকছেন কয়েকমাস বা সাহায্য করছেন সংসারের কাজ ও বাচ্চার ব্যাপারে এর অর্থ যত যোগ্যতাসম্পন্ন পুরুষই হোক না কেন তিনি আসলে বউকে ভয় পান বা অকাজের লোক তাই কাজ ফেলে এসেছেন।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের সাথে এসব আলোচনায় যুক্ত হন আমাদেরই কিছু বোন, ভাবী । অথচ তারা জানেন না, যাদের সঙ্গে তারা এসব বিষয় আলোচনা করেন এই তারাই পেছনে তাদেরই গাত্রোদ্ধার করেন।

এই হচ্ছে আমাদের দেশের ভাই তথা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষদের মানসিকতা। তবে আমি এটাও বলে রাখি সব ভাই এমন নন। কেউ কেউ আছেন যারা একটু আলাদা। তবে বেশিরভাগেরই মানসিকতা এমনটিই। এদের দেখলে আমার সত্যিই মনে হয় এরা সেই বাংলাদেশী পুরুষ যারা পৃথিবীর যে প্রান্তেই যান না কেন, কোনদিনই তাদের এই মানসিকতার পরিবর্তন হবে না।

কোনদিনই তারা একটা মেয়েকে সেই অর্থে মানুষ বলে ভাবতে পারবে না যারা তাদেরই সাথে তাল মিলিয়ে মেধায়, জ্ঞানে এগিয়ে আছে। চেষ্টা করছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের। আমি বা আমরা জানিনা আর কতদূর গেলে তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে? তবে কি একমাত্র নিজের বোন বা কন্যাসন্তানের প্রশ্নেই তারা পরিবর্তন করবেন তাদের এ পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার?? এ প্রশ্নের উত্তর সত্যিই জানা নেই………

শেয়ার করুন: