উইমেন চ্যাপ্টার নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করুন

কাজল দাস: কয়দিন আগে নারীদের জঙ্গি হয়ে উঠা বিষয়ক এক ইস্যুকে কেন্দ্র করে অনলাইন পোর্টাল ‘উইমেন চ্যাপ্টার’ নিয়ে বেশ কিছু সমালোচনা চোখে পড়েছে, এর আগেও বহুবার এই পত্রিকাটিকে নানানভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে দেখেছি আমরা।

এমনকি যারা এখানে লিখে থাকেন, তাঁদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবেও নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে থাকেন। জঙ্গি নারী ইস্যুকে কেন্দ্র করে অনেক প্রতিক্রিয়াশীল ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেয়া হচ্ছে, উইমেন চ্যাপ্টারে কেন এটা নিয়ে লিখা হচ্ছে না, এটাই মূল অভিযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আমি মনে করি, এই সমালোচনাকে কর্তৃপক্ষের ক্ষোভ নয়, বরং শক্তি হিসেবেই ভাবা দরকার। এই যে চ্যাপ্টার কেন লিখলো না, অভিযোগকারীদের এই ভাবনাটা যতোই ক্রিটিক্যাল হোক, এতে বোঝা যায়, চ্যাপ্টার একটা প্রতিনিধিত্বকারী শক্তি বা প্ল্যাটফর্ম অফ ভয়েস। এটাই চ্যাপ্টারের অনবদ্য অর্জন।

যারা সমালোচনা করছেন তারা এবং তাদের ওয়ালে সমর্থনকারীরা বিভিন্ন ব্যক্তিগত ক্ষোভ যেমন উগড়ে দিচ্ছেন, তেমনি চ্যাপ্টারের প্রগতিশীল নারী চিন্তাবিষয়ক জায়গাকেও খাটো করে দেখছেন, অপমান করছেন, দু;খের বিষয় তাদের সাথে অসংখ্য নারীও সমর্থন যোগাচ্ছেন, এরা সবাই যারা কোনো বিষয় লেখা বা না লেখা নিয়ে পত্রিকাটিকে অপমান করছেন, লেখকদের বিরুদ্ধে কটাক্ষ করছেন, একই সাথে পক্ষান্তরে পুরুষতান্ত্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার পালেই মূলত হাওয়া লাগাচ্ছেন।

কাজল দাস

উইমেন চ্যাপ্টার পত্রিকাটি বাংলাদেশের প্রথম নারীদের লেখার জন্য উন্মুক্ত অনলাইন পোর্টাল। সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সুপ্রীতি ধর, যিনি নিজেও বাংলাদেশের নারী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে একটি সাহসী নাম, দীর্ঘদিন কাজ করেছেন দৈনিক প্রথম আলো, বিবিসি বাংলা রেডিও, বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম, যমুনা ও মাছরাঙা টেলিভিশনে। এছাড়াও পত্রিকাটি পরিচালনার জন্য তাঁদের একটি প্যানেল রয়েছে।

জানা মতে, এখানে যারা কাজ করেন সবাই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেন, যারা লিখেন তাঁরাও বিনা পারিশ্রমিকে লিখে থাকেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই পত্রিকাটির সাথে অনলাইনেই পরিচিত, এই পত্রিকার অনেক লেখকের সাথেও চিন্তার বিনিময় হয় এবং আমি নিজেও মাঝমধ্যে লিখে থাকি।

আমার কাছে এই পত্রিকাটির গুরুত্ব নানান কারণে অর্থবহ। আমাদের দেশে নারী প্রগতির জন্য সাংস্কৃতিক ও অধিকারমূলক আন্দোলনের কাজের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামালসহ দেশের অগণিত নারী অধিকার কর্মীর জীবন সংগ্রাম এই দেশে নারীর সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য কালাধিকাল ধরে কাজ করে যাচ্ছে। একাধিক নারী অধিকার সংগঠন ক্রিয়াশীল রয়েছে, যারা আজো বিভিন্ন উপায়ে নারী-পুরুষের সমতার জন্য কাজ যাচ্ছেন। উইমেন চ্যাপ্টারের এই প্রচেষ্টাকে আমি এইসব কাজের ধারাবাহিক একটি ফলাফল ও অর্জন বলে মনে করি। আজ থেকে কয়েকযুগ পরে যখন এই দেশের নারী প্রগতির সামাজিক ইতিহাস লেখা হবে, ‘উইমেন চ্যাপ্টার’ সেখানে গৌরবের অংশীদার হবে বলেই আমি মনে করি।

গত শতক থেকে গোটা ইন্টেলেকচুয়াল বিশ্বে যে কয়টি প্রত্যয় চিন্তা জগতের কাঠামোতে মানুষকে আলোড়নের ঝড় তুলেছে তাঁর মধ্যে ‘ নারীবাদ’ এই বিষয়টি বহুল আলোচিত। নানান জ্ঞানতাত্বিক আলোচনা, রাজনৈতিক ডিসকোর্স ও কালচারাল ফেনোমেনা পেরিয়ে এই ধারাণাটি এখন প্রতিষ্ঠিত একটি ধারণা। নারীবাদ নারীর অধিকার রক্ষার একটি বয়ান। এটি কোন ইউটোপিয়া নয়। কোন অমানবিক মতবাদ নয়। কোন ব্যাক্তি বা গোষ্ঠী বা মানবজাতির বিরুদ্ধ মতবাদ নয়। এটি প্রতিটি সমাজের প্রেক্ষাপটে নারীর স্বাধীনতা অর্জনের জন্য একটি ওয়ে অফ থিঙ্কিং, এটি নারীর জন্য তাঁর অধিকার আদায়ের একটি শক্তি। এটি পুরুষতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র ও তাঁর সকল নারী অবদমনের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি মেসেজ।

নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অগণিত নারী অধকার কর্মীরা কাজ করে গেছেন। তাঁদের কর্মের মধ্যে দিয়ে নানান ধরনের চিন্তাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নারীর অস্তিত্ব, সুরক্ষা ও তাঁর স্বাধীনতার প্রশ্নে বহুবিধ মতবাদিক বিতর্কের মধ্য দিয়ে এই চিন্তা ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ, সাম্যবাদী নারীবাদ, লিবারেল নারীবাদ, র‌্যাডিক্যাল নারীবাদ, পোস্টমডার্নিস্ট নারীবাদ, ইকো-ফেমিনিজম, থার্ড ওয়ার্ল্ড ফেমিনিজ নানান মতবাদ তৈরি হচ্ছে এই প্রত্যয়কে ঘিরে। এখানে বিশ্বের তাবৎ চিন্তকরাও কাজ করছেন। কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, রোজা লুক্সেমবার্গ, স্টুয়ার্ট মিল, মেরি ওলস্টোণক্রাফট, সিমোন ড্য বোভায়ার, সার্ত্রে, হেলেন সিকসু, কেইট মিলেট, জুলিয়া ক্রিস্টিভা, লুইস ইরিগারে, গায়ত্রী স্পিভাক, জুডিত বাটলার, ভ্রেটি ফ্রাইডেন সহ অসংখ্য নারীবাদী চিন্তকরা কাজ করছেন।

একইভাবে শিল্প, সাহিত্য, সিনেমা, কবিতা, গানে অসংখ্য নারীবাদী কাজ করে যাচ্ছেন, ভার্জিনিয়া ওলফ, জেইন অস্টিনের মত লেখকরা এখানে অনবদ্য সাহিত্য রচনা করেছেন। এখানে রয়েছেন- ক্লারা জেটকিন, অলিম্পে দ্য গোজ, এ্যান্থনি বি সুশান, এ্যালিজাবেথ লেডি ক্যান্ডন, সরোজিনী নাইডুর মত অসংখ্য আন্দোলনমুখী কর্মী, যারা নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজের লক্ষ্যে।

এই নারীবাদ প্রত্যয়টি সেজন্য খুব ব্যাপৃত, ক্রিটিক্যাল ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সাথে খুবই দ্বন্দ্বপূর্ণ। নারীর যৌনতা, তাঁর ইচ্ছা, তাঁর অধিকার, তাঁর সুরক্ষা, তাঁর স্বাধীনতা, তাঁর সন্তান জন্ম দেয়া প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীবাদ বিষয়ক চিন্তা হস্তক্ষেপ করে। এই হস্তক্ষেপে তাই বারবার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মজ্জাগত চিন্তা, তাঁর উত্তরাধিকার প্রশ্ন, নারীর উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ নেয়া, তাঁর ধর্ম, সমাজ এমনকি রাষ্ট্র পর্যন্ত কেঁপে উঠছে বারে বারে। এই কেঁপে উঠার যে ভিত সেটা খুব মজবুত, এই ভিত গত দুই থেকে আড়াই হাজার বছরে নির্মিত হয়েছে। এই ভিত্তির মূলস্তম্ভই হলো পুরুষতন্ত্র ও পিতৃতন্ত্র। এটি মানব সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ একটি অভিশাপ।

এটা থেকে মুক্ত হবার জন্য সারাবিশ্বে স্থানীয়ভাবে, আঞ্চলিকভাবে, বৈশ্বিকভাবে যত ধরনের প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ বিদ্যমান আছে, উইমেন চ্যাপ্টারের ক্ষুদ্র উদ্যোগও তাঁর একটি অংশ। এটি একবিংশ শতাব্দীর বাঙালী সমাজের অল্প সংখ্যক লেখক ও পাঠকের জন্য হলেও চিন্তা বিনিময়ের একটি সূতিকাগার। এটি অভিনব ও প্রশংসনীয়।

পোর্টালটির লেখকরা নানান বিষয় নিয়েই লিখেন। নারীর উপরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যা কিছু চাপিয়ে দিয়েছে তাঁর সকল ধরনের অবদমনের যন্ত্রণা, অবজ্ঞার ক্ষোভ, বঞ্চিত হবার যাতনা, অধিকারহীনতার বৈষম্য, ব্যক্তি নারীর আন্তঃবেদনা, বৈবাহিক জীবন, ডিভোর্স লাইফ, সিঙ্গেল মাদার, যৌতুকপ্রথা, তাঁদের রজঃচক্র সম্পর্কিত ট্যাবু, তাঁদের প্রেম, পরকীয়া, নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার বোধ, ব্যক্তিত্ব ও সাহসের বলিষ্ঠ স্পষ্ট উচ্চারণ, নিজের যৌনতা ও শরীর নিয়ে ভাবনা, সবকিছু এই পত্রিকায় প্রতিফলিত হয়। তাঁদের অনেক ভাবনা লিবারেল মনে হয়, অনেক ভাবনা র‌্যাডিকেলও মনে হয়, আবার অনেক ভাবনা বিচ্ছিন্নও মনে হয়।

কিন্তু মূলগতভাবে এটি একটি লেখার প্ল্যাটফর্ম, যেখানে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নারীরা সাহস করে লিখে থাকেন। এসব নানাবিধ আলোচনা খুবই সমালোচনার যোগ্য, তবুও এটা একটা আশাবাদের ব্যাপার যে –নারীরা এখানে নিজেদের কথা বলতে পারছেন। প্রথাগত ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতির বাইরে গিয়ে নিজেকে দেখা ও প্রথাকে ভেঙ্গে নারী-পুরুষের স্বাধীন সমাজের আকাঙ্ক্ষার সমাজ নির্মাণ করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই দিকটি ইতিবাচক।

যেহেতু এটি একটি পত্রিকা বা লেখার প্ল্যাটফর্ম, সেজন্য এখানে লেখার কাজটিই বেশি করা হচ্ছে, লেখার পাশাপাশি কাজ করার ভাবনাটাও নারীবাদ বিষয়ক চিন্তার সাথে মৌলিকভাবে জড়িত। যদিও প্রায় ষোল কোটি মানুষের এই দেশে নারী সচেতনতা বিষয়ক লেখা সবার পৌঁছে দেয়াও একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। উইমেন চ্যাপ্টার এই কাজটি আরো সাহসের সাথে খুব নৈর্ব্যক্তিকভাবে করতে সম্মত হলে আখেরে আমাদের সমাজের জন্য এটিও একটি কাজ হবে বৈকি।

যারা এই পত্রিকাটির বিপক্ষে কথা বলেন তাঁরা পিতৃতন্ত্র ও পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক, তাঁদের বিরুদ্ধে নারীবাদ সব সময়ই আঘাত হানবে, আর যারা এই পত্রিকাটির সত্যিই সমালোচক তাঁদের এই সমালোচনা যেন পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে শক্তি না যোগায় এটি বিবেচনায় নিয়ে আপনাদের উদার ও প্রজ্ঞাবান সমালোচনা দিয়ে এই পত্রিকাটিকে আর এগিয়ে নিতে এগিয়ে আসেন।

শেয়ার করুন: