শান্তা মারিয়া: সখী আর অভিমান জানাবো না, বাসবো ভালো নীরবে। না, কোনোমতেই না। নীরবে সয়ে যাওয়ার, সরে যাওয়ার, মরে যাওয়ার, ঝরে যাওয়ার দিন শেষ। এখন অভিমান করে নিজেকে তিলে তিলে আর ক্ষয় করার কোনো দরকার নেই।
কথাগুলো বলছি, কারণ নজরুলের ভাষায় ‘দেখিয়া, শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি’। অভিমান করে অনেক প্রতিভাবান নারীকে দেখেছি আত্মহত্যা করতে, দেখেছি নিজেকে অবহেলা করে মরার পথ পরিষ্কার করতে। অভিমান পুরুষেরও হয়। তবে নারীরাই অভিমানী বেশি। অনেক মেয়েকে, মাকে, বোনকে দেখেছি অভিমান করে শরীরে রোগ পুষে রাখতে, দিনের পর দিন ডাক্তারের কাছে না যেতে।

‘আমার জন্য খরচ করার কী দরকার’, ‘আমার আর বাঁচার শখ নেই’ , ‘আমার কিছু দরকার নেই, তোমরা ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি’ এইসব কথা মেয়েদের মুখেই বেশি শোনা যায়। ফলাফল অকাল মৃত্যু, অকালে স্বাস্থ্যহানি, মানসিক রোগ, বিষন্নতা এবং আরও অনেক কিছু। নিজেকে কেবলই বঞ্চিত করে আমরা পথ হাঁটি। পছন্দের খাবারটা তুলে দেই পরিবারের অন্যদের পাতে। অফিস খেকে ছুটি পেলেও সেটা কাটাই ঘরে পরিশ্রম করে। নিজের অধিকারটা চেপে রেখে, নিজের চাহিদা, চাওয়া পাওয়াগুলোকে বিসর্জন দিয়ে একবুক অভিমান নিয়ে আমরা চলি, হাসি, গল্প করি।
কেবলই কম্প্রোমাইজ, কেবলই ছাড় দেওয়া। নিজের শখ, সাধ সবকিছু নিয়ে কম্প্রোমাইজ। আমার পরিচিত এক ভদ্রমহিলা দিনের পর দিন রোগ চেপে রেখে এখন ক্যান্সারে মৃত্যুপথযাত্রী। তার অভিমান ছিল, স্বামী কেন তার রোগযন্ত্রণা নিজের চোখে দেখেও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি।
আরেক ভদ্রমহিলা স্বামীর উপর অভিমান করে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ বিয়ের পর পরীক্ষার আগে বই নিয়ে বসায় স্বামী বলেছিলেন, ‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না? শুধু বই নিয়ে থাকো?’ স্বামী কেন তাকে নিজে থেকে পড়াশোনায় উৎসাহ দেয়নি, সেই অভিমানে তিনি লেখাপড়া ছেড়েছেন। অভিমান করে নাচ, গান ছবি আঁকা ছেড়ে দেওয়ার গল্প তো ভুরিভুরি। এমন গল্প অনেক আছে। নিজের পরিবারে মায়ের জীবনে, বোনের জীবনে একটু খুঁজলেই এমন অনেক গল্প পেয়ে যাবেন।
আগেই বলেছি পুরুষরাও অভিমান করেন। (এখানে পুরুষদেরও বলি, অভিমান করে দেবদাস হওয়ার দিন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।) তবে অভিমান করে নিজের ক্ষতি করার বিষযটি, ছাড় দেওয়ার বিষয়টি, নিজেকে অবহেলার বিষয়টি নারীর মধ্যেই বেশি থাকে।
অভিমানীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই প্লিজ, প্লিজ আর অভিমান করবেন না। নিজেকে ভালোবাসুন। নিজেকে সময় দিন। নিজের খুশিমতো বাঁচুন, নিজেকে নিয়ে বাঁচুন। আমরা অনেক অভিমান করেছি, অনেক ছাড় দিয়েছি। ওই যে যিনি ‘লুকানো ডায়েরি থেকে’ লিখছেন তিনিও মায়ের উপর অভিমান করে নিজের প্রচুর ক্ষতি করেছেন। এইসব ফালতু অভিমান এখন ত্যাগ করুন। কোন প্রেমিক কটূক্তি করেছে, কোন স্বামী সময় দেয়নি, কে বিয়েবার্ষিকী ভুলে গেছে, কে জন্মদিন ভুলে গেছে, ওইসব ফালতু অভিমান ছেড়ে দিন। হানিমুনে নিয়ে যায়নি বলে কে অভিমান করে জীবনে আর সমুদ্র দেখেননি, সেসব প্যাচাল একদম করবেন না। কার প্রেমিক তাকে ছেড়ে অন্য নারীর প্রতি মন দিয়েছেন বলে তিনি অভিমানে ঘুমের বড়ি খেয়েছেন, সেসব দিন ভুলে যান। তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিন সব অভিমান। এখন থেকে সব প্ল্যান-প্রোগ্রাম নিজেকে নিয়ে করুন। নিজের যত্ন নিন। ইয়োগা করুন। ভালো খাবার খান। ডায়েট মেনে চলুন। চাকরিটা মন দিয়ে করুন।
নিজের রোজগারের একটা অংশ অবশ্যই নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমিয়ে রাখুন। নিজেকে ভালো বাসুন। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন। নিজেকে সময় দিন। নিজের জন্য ভাবুন। নিজের যত্ন নিন। শুধু শরীরের নয়, মনেরও যত্ন নিন। বই পড়ে, বেড়িয়ে, হেসে-খেলে জীবনটা কাটানোর চেষ্টা করুন। নিজেকে নিঃশেষ করে সংসারের জন্য খাটবেন না। একদম না। যতোটুকু শরীরে সয় ততোটুকুই করুন। তার বেশি কিছু করতে যাবেন না।
একজন নারীর গল্প বলি, শুনুন। স্বামী, সন্তান, সংসারের জন্য টেনশন করতে করতে আজ তিনি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন।
যদি অবিবাহিত হয়ে থাকেন, আর আপনার একজন প্রেমিক থাকে, তাহলে তার উপর অভিমান করে নিজের ক্ষতি করার কথা স্বপ্নেও ভাববেন না। লেখাপড়া চালিয়ে যান, ক্যারিয়ারটা গড়ে নিন।
অভিমান করে নিজেকে আর নিঃশেষ করবেন না প্লিজ। নিজেকে ভালোবাসুন, ভালো থাকুন।