বন্ধু-বন্ধুতা, দুঃখ জাগানিয়া গান

সঙ্গীতা ইয়াসমিন: কবিগুরু বলেছেন-“গোলাপ যেমন একটি বিশেষ জাতের ফুল-বন্ধু তেমন একটি বিশেষ জাতের মানুষ, যে এই বিশেষ জাতের মানুষের ভালোবাসা পায় না তার মত হতভাগা সংসারে আর একটিও নেই।” সম্ভবতঃ পৃথিবীর সকল সম্পর্কের চেয়ে মধুর, আনন্দের, প্রতিশ্রুতির, ভালোবাসার সম্পর্কের নাম বন্ধুত্ব।

ভালোলাগার এক সুতীব্র গভীর বন্ধন এই বন্ধুত্ব। এই বন্ধনে আছে ক্ষমা-মোহ,  আছে প্রেম-বেদনা, আছে অধিকার-শাসন, আছে সহমর্মিতা-সমানুভূতি। এক কথায় কী নেই এই সম্পর্কে যা জাগতিক সকল বন্ধনের আড়াল ভেঙ্গে দিয়ে একে অন্যকে হৃদয়ের গোপন আস্তানায় জায়গা করে দিতে দ্বিধা করেনা এতটুকুও? বন্ধুত্ব মানে দুজন মানুষ, দুটি মন, দুটি হৃদয়, দুটি আত্মা; যারা একে অপরের চোখ দেখেই মনের কথা বলে দিতে পারে। যারা মুখ দেখেই পড়ে ফেলতে পারে না বলা কথার কষ্ট কাহন! এমনকি হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও টেলিফোনে কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারে প্রাণপ্রিয় বন্ধুটি ভাল নেই হয়তো; কিংবা উৎকণ্ঠায় হতে পারে শঙ্কিত কেমন আছে না জানি তার বন্ধুটি! শর্তহীন ভালোবাসা তো কেবল অমল বন্ধুত্বই দিতে পারে! আর তাইতো বাংলার গীতিকবি গেয়েছেন- “একটাই কথা আছে বাংলাতে, বুক আর মুখ বলে একসাথে, সে হলো বন্ধু…বন্ধু আমার!”

সঙ্গীতা ইয়াসমিন

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই বন্ধুত্ব কি কেবল ছেলে-ছেলেতে কিংবা মেয়ে-মেয়েতেই হবে? দুই বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুত্ব কি এমন মধুর হতে পারে না? হয়তো অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না। বলবেন ছেলেতে-মেয়েতে কস্মিনকালেও বন্ধুত্ব হয় না। যদিওবা হয় সেটা কিছুদিন পরে প্রেমের দিকে মোড় নেবেই। নইলে সেই সম্পর্ক আদতে আর বেশিদিন টিকবেই না। এই দুই ধারণার কোনটির সাথেই একমত নই তবে এর কোনোটিকে পুরোপুরি অস্বীকারও করছি না আমি।কারণ, এই ধারণাগুলি একেবারে ভিত্তিহীন নয়। এগুলো আমাদের যাপিত জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতারই ফসল। তথাপিও এর পেছনের কারণগুলো খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, কেন ছেলেতে-মেয়েতে বন্ধুত্ব হতে পারে না বা হলেও সেটি অবিকৃত থাকেনা।

প্রথমতঃ প্রেম বিষয়টি সবার জীবনে একটি বিশেষ বয়সে, বিশেষ সময়ে আসে, যাকে উপেক্ষা করার কি ছু নেই। কিন্তু বান্ধবী আর প্রেমিকা দু’জন আলাদা মানুষ একই সাথে এক পুরুষের জীবনে থাকতে পারে তো? এর দৃষ্টান্তও আমাদের সমাজে বিরল নয়।একটি ছেলে কিংবা একটি মেয়ে তাদের সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ জীবনে বিপরীত লিঙ্গের কারো প্রতি আকর্ষিত হবে সেটি অতি স্বাভাবিক একটি শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়ার ফল; তখন তাদের পরিমণ্ডলে যাকে তারা সহজে কাছাকাছি পাবে, বিশেষ কোনো কারণ ছাড়াই তাকে পছন্দ হতে পারে, কিংবা ভালো লাগতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে সেটি কতখানি প্রেম, কতোটা মোহ, কতোটা সত্যিকারের ভালোবাসা সেটা বলা মুশকিল। তাই সেটি কেবল বন্ধুত্ব না হয়ে যদি প্রেমও হয় তা বেশিদিন টিকে থাকেনা।

দ্বিতীয়তঃ দুজন ছেলে আর মেয়ে বন্ধু হতে গেলে তাদের সহজভাবে মেলামেশা করা দরকার; যেকোনো সম্পর্ক তৈরি কিংবা উন্নয়নের জন্য ‘সময়’ একটা গুরুত্বপুর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। সাধারণতঃ দুজন বন্ধু হতে হলে যেভাবে খোলামেলা মেশামিশি প্রয়োজন তা শুরুতেই হবার সুযোগ আমাদের সমাজে খুব একটা নেই বললেই চলে। তাই শুরুতে দুজন ছেলে-মেয়ে ভাল বন্ধু ছিল বলে মনে হয়,  কিছুদিন পরে হঠাৎই ছেলেটি কিংবা মেয়েটির কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব এলে বিপরীত দিক থেকে সেটির সাড়া না মিললেই সেই সম্পর্ক আর এগোতে পারে না। সেখানেই ঘটে বন্ধুত্বের সলিল সমাধি।

এখানেও সেই একই প্রশ্ন? সম্পর্কটি আদতে কতখানি প্রতিশ্রুতির জায়গায় ছিল? কতটা নির্ভরতার সম্মন্ধ ছিল? কতটা সাবলীল-সহজ ছিল? যদি তাদের মধ্যে প্রেম প্রতিষ্ঠিত না হয় তবে সবকিছু ছাপিয়ে বন্ধুত্ব নামক অমল সম্পর্কটি প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। আর সম্পর্কের দৃঢ়তার ওপর ভিত্তি করে কেবলই বন্ধুত্ব টিকে থাকতে পারে বলে অন্ততঃ আমি মনে করি।

উপরে উল্লিখিত এই দুটি ক্ষেত্রেই বন্ধুত্বের ভিত্তি বেশ দুর্বল। সম্পর্কের রূপরেখা আদৌ সহজ সমীকরণের নিয়মে এগোয়নি। অর্থাৎ, সম্পর্কের সঠিক সংজ্ঞায় ছেলেটি আর মেয়েটি নিজেদেরকে চালিত করতে পারেনি। সেটা সঙ্গত কারণেই তারা পারে না। আমাদের সমাজে ছেলেতে মেয়েতে স্বাধীনভাবে মেলামেশা খুব বেশিদিন হল শুরু হয়নি; যখন থেকে এই আধুনিকতার চল শুরু হয়েছে, তখন থেকেই সেটা আধো-আলো ছায়ায় লুকিয়ে চুরিয়ে শুরু হয়েছে।

খুব কমই আধুনিক-প্রগতিশীল বড় ভাই-বোন কিংবা বাবা-মা আছেন, যারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়ের ছেলেদের সাথে বন্ধুত্বকে খুব সহজভাবে নিয়েছেন। আর এই অসহজতার আড়ালে সামাজিক যেসব বিধিনিষেধ দেয়াল তুলে শক্ত পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার নিষ্ঠুর বেড়িতে মনোদৈহিক বৃদ্ধিকে আটকে রাখতে পারেনি কখনো। সে নিয়মের সব শেকল ভেঙে দুধের পাতিল থেকে ননীটি ঠিকই তুলে নিয়েছে।এ তার দোষ নয়, এ দোষ তার বয়সের কিংবা চরিত্রেরও নয়। এর দায় আমাদের সমাজ মনোস্তত্ত্বের! হাজার বছরের চর্চিত এই সমাজ মনোস্তত্ত্ব জন্ম দিয়েছে আমাদের মনোবৈকল্যের!যার ফলে আমরা ছেলে-মেয়ের স্বাভাবিক-সহজ মেলামেশাকে বক্রদৃষ্টিতেই দেখেছি চিরকাল।

একটি সুন্দর ও মিষ্টি সম্পর্ককে আগুন-পানি, আগুন-ঘি, ফুল-ভোমরা, মধু-মৌমাছি; এ জাতীয় নানবিধ বিশেষণে বিশেষায়িত করার যে চর্চা সেটা যে মনোবৈকল্যেরই ফসল এবং রুচিহীনতার ভাগাড় একথা বললে  অত্যুক্তি করা হবে না। এ জাতীয় বিশেষণে খাদ্য-খাদক কিংবা দাতা-গ্রহীতার উপমা প্রকারান্তরে সম্পর্কের আবডালে দেহতত্ব এবং বস্তুগত উপাদানকেই অধিক প্রতিষ্ঠিত করে। সম্পর্কগুলিকে এইসব নোংরা নামে অভিহিত করতে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, আনন্দ পাই। যার আড়ালে লুকিয়ে থাকে সুস্পষ্ট নোংরা ইঙ্গিত! আমরা যেন সহজ সরল সম্পর্কটিকে আকারে ইঙ্গিতে একটি নির্দিষ্ট দিকেই ধাবিত করতে চাই। আর সেকারণেই, খুব সাদা চোখে সমবয়সী দুটি ছেলে-মেয়েকে কখনোই বন্ধু ভাবতে পারি না কিংবা চাই না।

কিন্তু কেন সমাজের এই বিশেষ রূপ? বিশেষ নিয়ম ছেলেতে-মেয়েতে বন্ধুত্বের বেলায়? এর পেছনে কি কেবলই ফ্রয়ডীয় মতবাদ শক্তিশালী যুক্তি হিসেবে কাজ করেছে? সমাজে থেকেও ছেলে-মেয়ে কেবলই যৌন সম্পর্ক দ্বারা আচ্ছাদিত? একে অন্যের প্রতি যৌনতা দ্বারা আসক্ত হবে, এটাই হবে এদের মধ্যে বন্ধনের একমাত্র উদ্দেশ্য, লক্ষ্য আর সম্পর্কের স্থায়ীত্বের মাধ্যম? হাজার হাজার বছরের বিবর্তনের ফলে যে সভ্যতা আমরা অর্জন করেছি সেই সভ্যতা তবে আমাদের কী শেখালো?

আমরা কি তবে প্রাণী থেকে মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা অর্জন করতে পারিনি এই সভ্যতা থেকে? আমরা, মানুষেরা তবে বড় বেশি অসহায় প্রাণী প্রাণীকূলের মধ্যে; যে আমরা সমাজের অনেক অবাঞ্ছিত নিয়মের বেড়িরুদ্ধ হয়ে ভালকে ভাল, কালোকে কালো বলতে পারি না। যা বিশ্বাস করি, কিংবা করি না, তা প্রকাশ করতে পারি না। যে সম্পর্ক মানি না মন থেকে, তাকেই সত্য বলে জীবন পার করি, যেটি আদতেই আমার তাকে পর বলে দূরে ঠেলি অবলীলায়!

একটি শিশু জন্ম থেকেই দেখে অভ্যস্ত তার মা-বাবার সম্পর্ক; সেটি যে একটি সামাজিক যৌন সম্পর্ক দ্বারা তাড়িত তা সে খুব ছোট বয়সেই বুঝতে শেখে। আবার সেই একই পরিবারে সে দেখে তার ভাই-বোনকে, এটিও মধুর সম্পর্ক, এদের মধ্যেও অনেক বড় বন্ধুত্ব তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে তো যৌনতা কাজ করে না! আবার সমবয়সী ফুফু-ভাতিজা,খালা-ভাগ্নে, মামা-ভাগ্নি,চাচা-ভাতিঝি এরাও একই পারিবারিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠে, সেখানেও কিন্তু বেশ সুস্থ সুন্দর বন্ধুত্ব তৈরি হয়। যা আমাদের সমাজেই ভুড়িভুড়ি প্রমাণ আছে। কারণ, সমাজে সেই চর্চা আছে।

পরিবার থেকেই আমরা শিখি কোন কোন সম্পর্কগুলিতে আমরা কী কী আচরণ করবো, কোনটি শোভন আর কোনটি অশোভন। ফ্রয়েড সাহেব সেখানে চোখ মেলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখেন সব কীর্তিকলাপ; আর মুখ টিপে হাসেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে পারিবারিক পরিবেশের বাইরে দুজন সমবয়সী কিশোর-কিশোরী কিংবা তরুণ-তরুণীর বেলায় অতি সহজে তেমনটি হচ্ছে না কেন? সেখানে কি খুব সহজেই ফ্রয়েডীয় মতবাদ মাথাচাঁড়া দিয়ে ওঠে?  

এর খুব সরল জবাব হলো,  না। আসল সমস্যাটা হলো আমাদের চর্চার; আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর, আমাদের জীবন বোধের। যা আমরা বলি, তা করি না, যা করি তা বিশ্বাস থেকে করি না। আর যা বিশ্বাস করি তা কোনদিনই প্রকাশ করি না সজ্ঞানে। একে ভণ্ডামী বলে কিনা জানি না। তবে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে  এটি খুবই প্রচলিত বিষয়। যদিও এটি আমাদের জাতীয় চরিত্রেরই অংশ!

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ; চিন্তা-চেতনায় যাদের অনেক মিল, বেড়ে ওঠায়, দৃষ্টিভঙ্গীতে, জীবনবোধে, সমাজ-দর্শনের অনেক মিল, শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান গরিমায়ও খুব একটা বৈপরীত্য নেই; এই দুজন মানুষ কি বন্ধু হতে পারে তাদের বিবাহিত জীবনের গণ্ডির বাইরে? বিয়ের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য আর কর্মপদ্ধতি বন্ধুত্বের থেকে আলাদা বলেই বিয়েতে এই সম্পর্ক গড়ে ওঠে না অতি সহজে। তাই বিচিত্র এই মনুষ্য হৃদয়ে বন্ধুত্বের তিয়াসা থাকতেই পারে; খুব সুখী দম্পতিরাও ভাল বন্ধু হয়ে উঠতে নাও পারেন। আর তাই মনের কোণে একটা অভাববোধ, একটা ঘাটতি থাকতেই পারে। আর সেই শূন্যতা পূরণে মানুষ হয়তো জড়িয়ে পড়ে এই বন্ধুত্ব নামক একটি জটিল সম্পর্কে। আর এখানেও আছে সমাজের জটিল নিয়ম! কঠিন অনুশাসন! সমাজের নতুন নামকরণ! সমাজের প্রচলিত নিয়মে বিবাহবহির্ভূত দুজন নর-নারীর এই সম্পর্কের নাম হয়ে যাবে তখনই পরকীয়া। আর এই নামকরণকে যথার্থ করতে এই সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ মানুষ দুজন কেবল মনব-মানবী থাকেন না! রাতারাতি একে অন্যের কাছে হয়ে যান নর-নারী! আবার সেই ফ্রয়েড! তিনি এবার জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন, আরে নারীই তো! ওতো ব্যবহারের বস্তু কেবল, যখন যে অবস্থায় আছে তার সঠিক ব্যবহারই উত্তম!

আর তাই কিছুদিন পর একে অন্যের ঘর ভাঙার কারণ হয়ে যান।পুরুষ ব্যক্তিটির বোধোদয় ঘটে অতি আচম্বিতে। নিজেকে এই রাহুবন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিতে তড়িঘড়ি করেন।এই সম্পর্কের কোনো কানাকড়ি দাম থাকে না তার কাছে। যেকোনো মূল্যে নিজের ডেরায় ফেরাই লক্ষ্য তার। সেক্ষেত্রে, সম্পর্কের অন্য প্রান্তে থাকা নারীকেই দিতে হয় তার খেসারত। একদিন বিশ্বাস করে নিজের মনের কোণে লুকিয়ে থাকা কষ্টের কথা যাকে অবলীলায় বললেন যাকে, ভাবলেন  তিনিই আপনার না বলা কথাগুলোও কীভাবে যেন বুঝে ফেলেন, তাই উজার করে দিলেন আপনার না পাওয়া কষ্টগুলি। পরক্ষণেই সেই মানুষটি হয়ে গেল চির অচেনা! একদিন যার সান্নিধ্য আপনাকে আনন্দে ভরিয়ে রাখত অনুক্ষণ, আজ সেই হল ভয়াবহ দুঃখের কণ্টককাহন!

একদিন যাকে ভালবেসে যক্ষের ধন মনে হইলো, সেই হলো আজ গণিমাতের মাল! হায়রে মনুষ্য হৃদয়! কোন পাত্রে কী ধারণ করিতে হয়, আর কোনটি গলাধঃকরণ নয়, হৃদয়ঙ্গম করিতে হয়, এই পুরুষ শ্রেষ্ঠত্বের সমাজ না জানিল তাহার রীতি-নীতি! তাই নারীর বন্ধু-বন্ধুতা, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানিয়া ভালোবাসা!!

টরন্টো, কানাডা।

শেয়ার করুন: