বরং বর্ণবাদীই হোন, বর্ণবিদ্বেষী নয়

আফরিন শরীফ বিথী: গায়ের রঙ কালো নিয়ে অনেক লেখাই প্রকাশিত হয়েছে এ পর্যন্ত। আমারও লিখতে ইচ্ছে হলো, তবে একটু ভিন্নভাবে। বলাবাহুল্য আমিও কালো রঙের মেয়ে। আমাকেও সমাজে কালোর প্রবঞ্চনার মধ্য দিয়েই আসতে হয়েছে, এবং এখনও হচ্ছে। অবশ্য কালো রঙে শুধু মেয়েদের বেলাতেই নয়, ছেলেদের বেলাতেও একটু টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়,তবে মেয়েদের তুলনায় কম। তাই আমার এই লেখার প্রসঙ্গ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শুধু রঙ নিয়ে।

আর গায়ের রঙের প্রসঙ্গটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ছেলেমেয়েদের বিয়ের সময়টাতে। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি।

একবার এক বিদেশ ফেরত ভাইয়ের জন্য এক বোন এসেছিল আমার বড় আপুর কাছে, আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। মফস্বলে যেটা হয় আর কী! সেই ছেলে কম শিক্ষিত ছিল। আপু বিনয়ের সাথেই বলেছিল, আমার বোন তো ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, এ হয় না আপা। সেই ছেলের বোন বলেছিল হয় না কেন, আপনার বোন তো কালো! মানে সে কালো আর কম শিক্ষিতে কাটাকাটি করতে চেয়েছিল। আপু রেগে গিয়ে বলেছিল, এতো বড় সাহস আপনার! যান তো!

এই ঘটনা শোনার পর খুব হেসেছিলাম। আপুকে বলেছিলাম, কালো বলেছে তো কী হয়েছে, আমি তো কালোই, বলবা আমার বোনকে বিয়ে দিব না, রেগে গেছো কেন! আপুর আহ্লাদি উত্তর ছিল, আমার বোনকে কালো বলতে পারবে না। হাহাহা…হায়রে ভালবাসা! যা হোক আসল কথায় আসি।

লক্ষ্য করুন তো নিচের বাক্যগুলোতে কী প্রাধান্য পাচ্ছে, কী বোঝানো হচ্ছে?

“নদীর পানি ঘোলা ভালো, জাতের মেয়ে কালো”- এখানে জাতের মেয়ে কালো হলেও ভালো বোঝানো হয়েছে। তার মানে কালোকে অবজ্ঞাই করা হয়েছে। জাতের মেয়ে ধলা হলে তো কথাই নাই!

“কালো কালো করিস না লো ও গোয়ালের ঝি, আমায় বিধাতা করেছে কালো, আমি করবো কী”, – কালো হওয়াতে তার কোনো হাত ছিল না, বিধাতা তাকে কালো করে বানিয়েছে, তার হাত থাকলে সে কালো রঙের রূপ নিতো না, এটা এখানে স্পষ্ট।

“কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবারই সমান রাঙা”,- ভিতরে যেহেতু সবারই রাঙা তাই কালো- ধলোতে শ্রেণীভুক্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন লেখক। বস্তুত কালোর প্রতি নেতিবাচক ধারণার কারণেই এমন উক্তি লেখকের করতে হয়েছে।

কালো নিয়ে ইত্যাদি বহু প্রবাদ, প্রবচন, কবিতা,গান আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে। অধিকাংশ লেখার প্রতিপাদ্যই মোটামুটি এক। কালোকে পক্ষান্তরে নেতিবাচকভাবেই প্রকাশ করা হয়েছে।

কালো সম্বোধনে কষ্ট পাওয়া, কালো মেয়ের যোগ্যতাকে শিরীষ কাগজের সাথে তুলনা করা, অর্থাৎ যোগ্যতা দিয়ে ঘষে মেজে কালো রঙের প্রলেপ ম্লান করা, মেয়ে কালো হলেও সুন্দরের মাথা খায় (আঞ্চলিক ভাষায়), কালো হলেও মেয়ে গুণবতী, ছেলে কালো, কিন্তু বড় চাকরি করে, এসবেই আমরা এখনও আটকে আছি। কিন্তু না, আমি আপনার চিন্তাকে একটু ভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবো। উপরোক্ত প্রবাদগুলোর প্রেক্ষিতেই আমি বলবো, “নদীর পানি সবই ভালো, জাতের মেয়ে হলেই হলো “(অর্থাৎ কালো-ধলো উল্লেখের কোন দরকারই নাই, বিচার হবে শুধু ভালো আর মন্দে।)

আমি বলবো- “কালো কালো করছিস ও গোয়ালের ঝি, আমিই বিধাতার কাছ থেকে কালো চেয়ে নিয়েছি” (অর্থাৎ আমি ইচ্ছে করেই কালো রঙ চেয়ে নিয়েছি, কারণ কালো আমার প্রিয় রঙ)। আমি বলবো-“কালো আর ধলো দুটোই বাহিরে ফেল, ভিতরে সবারই সমান খেল “(মানে একই জীবনী প্রক্রিয়ায় আমরা বেঁচে থাকি, কালো ধলো তাতে কোন প্রভাব ফেলে না)।

এসব সাহিত্য কপচানোর উদ্দেশ্যটা এখন বলি।

ঐ কালো মেয়েটা, ঐ কালো নারীটি, ঐ কালো মতো লোকটা, এমন সম্বোধনে আমরা কষ্ট পাই, ক্ষুব্ধ হই। কিন্তু কেন!কালো কি একটা রঙ নয়? কালোও তো একটা রঙ। কালো রঙের প্রতি আমার বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। অনেকেরই প্রিয় রঙ কালো। আমরা পছন্দ করেই কালো পোষাক, কালো গাড়ি, আরও কত কালো জিনিসই তো দাম দিয়ে কিনি। কালো তো একটা গর্জিয়াস রঙ।

আজকাল সৌন্দর্যকে নতুনভাবে প্রদর্শনের জন্য কালো মেকাপ করা হয়। যার কালো পছন্দ সে কালো মেকাপ, যার সাদা পছন্দ সে সাদা মেকাপ করেন। এটা সম্পূর্ণই রুচির ব্যাপার। কিন্তু খেয়াল রাখবেন যেন সে রুচি হয় একান্তই আপনার। কারো বা সমাজের বিকৃত রুচিকে তুষ্ট করতে যেন আপনি আটা-ময়দা-কালিতে সার্কাসের সঙ না সাজেন।

এবার আসি ডাকাডাকির প্রসঙ্গে। ধরেন আপনার ঘরে সব রঙের শোপিস আছে। কাউকে আপনি কালো রঙের শোপিসটাকে ইনডিকেট করে কিছু বলবেন। হয়তো বলবেন,ঐ কালো শোপিসটা আমার বন্ধু চায়না থেকে আমার জন্য নিয়ে এসেছে। এতে কি ঐ কালো শোপিসটাকে অবজ্ঞা করা হয়ে যাবে কালো উল্লেখ করার কারণেই? নিশ্চয়ই না। তো কালো সম্বোধনে ডাকলেই কেন আমরা কষ্ট পাবো! যে মেয়ে সাদা রঙের, তাকে মানুষ ঐ যে ফর্সা মেয়েটা বলে চিহ্নিত করে, যে মেয়ে আরও সাদা, তাকে ধবধবে ফর্সা, যে মেয়ে কমলা রঙের তাকে কমলা বর্ণের, যে মেয়ে হলুদ রঙের, তাকে কাঁচা-হলুদ রঙের মেয়েটা বলে চিহ্নিত করে। তারা তো মন খারাপ করে না। আমরা কেন করি!

তাহলে কি আমরাই কালো রঙটাকে অপছন্দ করি? অপছন্দ করি বলেই কি মন খারাপ করি? আমরা যারা সাদা- কালোর ভেদাভেদ ভাঙার কথা বলছি, আমাদের অবচেতন মনেই কি তাহলে কালোকে বিশেষভাবে নেতিবাচক ধরে রেখেছি? যদি তাই হয়, তাহলে আমরা কীভাবে প্রতিবাদ করতে পারি! তাই আগে আমাদের চেতনার জায়গাটা স্পষ্ট হতে হবে। কালো মেয়েটা বললে খুব স্বাভাবিকভাবেই সেটা নিতে হবে। কারণ সত্যিই আমার গায়ের রঙ কালো।

আমার বাবা আমাকে কালীমা, মা কালী,কালী তারা বলে ডাকে, বড় বোনরা কালনী বলে। এতে কখনোই আমার মন খারাপ হয় না। কারণ আমি জানি এই ডাকে বিন্দুমাত্র নেতিবাচকতা নেই, আছে অকৃত্রিম ভালবাসা। বরং বাইরের কেউ ওদের এমন ডাকে আপত্তি জানালে, আমি বলি ডাকলে কী হইছে! আমার এই ডাকেই ভাল লাগে, এই ডাকেই ভালবাসার ঘ্রাণ পাই। আমাকে কেউ কালো মেয়েটা বলে চিহ্নিত করলে সেটা দোষের কিছু নয়।

সে যদি নেতিবাচক অর্থে বলে সেটা তার অজ্ঞতা, তাতে আমার কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। ধলা মিয়া, লাল চাঁন যদি তাদের নামকরণে ব্যথিত না হয়, তাহলে কালু মিয়া, কালাচাঁন কেন ব্যথিত হবে! যদি মানুষের রঙ সাতরঙা হতো, তাহলে হয়তো আমাদের বলতে হতো, ঐ যে নীল রঙের ছেলেটা, ঐ যে সবুজ রঙের মেয়েটা, ঐ যে বেগুনী রঙের লোকটা, ঐ যে কলা পাতা রঙের মহিলাটা, তাই না! তো, তাতে কী হতো! বরং মানুষ চেনাতে সুবিধাই হতো।

কিন্তু বিষয় হচ্ছে এই চিহ্নিত করাটা শুধু চেনানোর জন্য হতে হবে। রঙ দিয়ে একটা মানুষের যাচাই-বাছাই হলে তো চলবে না! সমস্যা হচ্ছে, যে সমাজ রঙ দিয়ে মানুষকে বিশেষায়িত করে, সে সমাজ আসলে নেতিবাচকভাবেই কালো রঙটাকে বিশেষ বিশেষণে সঙ্গায়িত করে রেখেছে। এটা এই বোকা সমাজের দুর্বলতা, হীনমন্যতা। আমাদের কাজ হচ্ছে সেই অজ্ঞতা, দুর্বলতাকে ডোন্ট কেয়ার করা।

আমাদের ভাবতে হবে, আমি কালো বলেই আমি সুন্দর। আমি কালো বলেই আমি গর্বিত। আমি কালো বলেই অনেকে আমাকে পছন্দ করে। সৌন্দর্য কখনো নির্দ্দিষ্ট কোন রঙে আটকে থাকার বিষয় নয়। সৌন্দর্য আপেক্ষিক। একেক জনের কাছে সৌন্দর্য একেক রকম। শুধু দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। কেউ ধলোতে গদগদ, কেউ কালোতে সন্তুষ্ট।

আপনাকে ভাবতে হবে-কালো রঙেই আপনি ঠিক আছেন। সাদা বা হলুদ বা নীল বা বেগুনী বা লাল হলে আপনাকে ভাল লাগতো না।

আমরা সবকিছুতেই রঙের বৈচিত্র্য পছন্দ করি। মানুষের বেলায় এতো অসুবিধা কেন! এ্যাভাটার মুভির নীল মানুষগুলো কিন্তু দারুণ লেগেছিল। আর এনিমেশন মুভি তো ভালই লাগে একেকটা এনিমেশন একেক রঙের বলে।

সাম্যবাদ যদি সমতার কথা বলে, মানবতাবাদ যদি মানবতার কথা বলে, নারীবাদ মানে যদি নারীর পক্ষে কথা বলা হয়, তাহলে বর্ণবাদ মানেও বর্ণের পক্ষে কথা বলা নয় কেন! হ্যাঁ, প্রচলিত অর্থে বর্ণবাদ মানে বর্ণের পক্ষেই কথা বলা।

আফরিন শরীফ বিথী

তবে সেই পক্ষটা একটা নির্দ্দিষ্ট বর্ণের প্রতি, অর্থাৎ একপক্ষীয় হয়, বর্ণকে নিম্ন ক্রমানুসারে সাজানো হয়। এই নেতিবাচক বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আমি ইতিবাচক বর্ণবাদের কথা বলছি। এই বর্ণবাদ কোন নির্দিষ্ট বর্ণের পক্ষে না, এই বর্ণবাদ সকল বর্ণের পক্ষে, এই বর্ণবাদে উর্ধ্বক্রম-নিম্নক্রম নেই।

মানুষের বর্ণের বৈচিত্র্য যেহেতু অস্বীকার করা যাবে না, সেহেতু বর্ণবাদকেও অস্বীকার করা যাবে না। তাই বর্ণবাদকে বরং স্বাগত জানাই, আর বর্ণবাদের প্রচলিত ধারণাকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেই। সেই অর্থে আমি বর্ণবাদী, বর্ণবিদ্বেষী নই। অর্থাৎ আমি সব বর্ণের পক্ষে, সব বর্ণই আমার ভাল লাগে। সব রঙ-ই আমি ভালবাসি। কোন রঙের প্রতি আমার বিদ্বেষ নেই।

ব্যাখ্যাটা কেমন যেন উল্টাপাল্টা ঠেকছে, তাই না? কিন্তু চিন্তায় একটু ধাক্কা মারেন তো, দেখেন তো চলে কীনা! যদি চলে তবে আপনিও বর্ণবাদী হোন, বর্ণবিদ্বেষী নয়।

-তরুণ লেখক ও সাংবাদিক

শেয়ার করুন: