চেনা অপরিচিতা: আমার সেই প্রাক্তন সহকর্মীর সাথে একদিন যোগাযোগ হলো। তার জন্মদিনে গেলাম কেক নিয়ে দেখা করতে। পথে পথে ঘোরাই সার হলো। রাগে আমার কেক নিলেন না। আমিও অসহ্য অপমানে রিকশাওয়ালাকে সেই কেক দিয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম, আমি তো আর যোগাযোগ করবোই না, সেও যাতে কোনভাবেই আমার সাথে যোগাযোগ করতে না পারে তার জন্য সেলফোনের সিম খুলে ফেললাম। বাসায় বলে দিলাম কেউ ল্যান্ডফোনে খুঁজলে আমাকে যাতে না দেয়। বাবা-মা খুশি। তারা যার সাথে আমার প্রেম সন্দেহ করে তার কাছ থেকে বেরিয়ে এসেছি এটা ভেবে আমাকে প্রটেকশনের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করলো।
কিন্তু এরপরই বাসায় ব্ল্যাংক কল, রং নাম্বার ইত্যাদি আসা বেড়ে গেল। পরিচিত এক আপুও তার হয়ে কল করতে পারে জানতাম বলে তিনিও যখন আমাকে ফোনে খুঁজতে লাগলেন আমি তার কলও এভয়েড করতে লাগলাম।
এভাবে এক সপ্তাহ পার হওয়ার পর ই-মেইল পেতে লাগলাম, তাতে ভদ্রলোক আমাকে হীনা কতোটা অসহায়ভাবে দিনাতিপাত করছেন তার আবেগি বর্ণনা। সেখানে তার ব্যবহারের জন্য দুঃখ প্রকাশ, জনসমক্ষে কেঁদে ফেলা, না খেতে পারা, ইত্যাদি পড়ে আমার কোন ভাবান্তর হয় না। কারণ এক বর্ণ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।
কেউ কেন এরকম করবে? তাও আমার জন্য? আমি পড়ি আর হাসি। তারপর একদিন কি মনে করে বন্ধ সিমটি খুলতেই তার ফোন আসে, আমি ধরি না। তারপর সেই আপুর ফোন। আপু বলেন, ভদ্রলোক নাকি হাউমাউ করে কেঁদেছেন। আমার তাও কেমন হাসি পায়। বিশ্বাস হয় না। তবু যখন তার ফোন আসে আমি ধরি এবং পরদিন দেখা করতে যাই। তাকে দেখে সত্যি আমার মুখের হাসি মুছে যায়। না খেয়ে যে ছিল তা তার ঝুলে যাওয়া শুকনো গাল, বসে যাওয়া চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। আমাকে দেখে হিস্ট্রিয়া আক্রান্ত রোগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে কেঁদে ফেলে। আমি তাকে মানবিকতার খাতিরেই জড়িয়ে ধরি। সে ভয় পাচ্ছিল, আমি আবার তাকে ছেড়ে চলে যাবো ভেবে। কিন্তু, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলাম।
ভাই কাছের, অন্য সবার থেকে। কিন্তু বড় ভাইকে নিজের পছন্দের কথা, বিয়ের কথা কিভাবে বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তারপর একদিন এমএসএন ম্যাসেঞ্জারে
ভাইকে সব বললাম। ভাই বলল সে সব করবে। প্রথমে বাসায় বলবে, যদি রাজী না হয় সে বিয়ে দেবে।
আমার ভাই যেদিন বাড়িতে বলা স্থির করলো, সেদিন আমি ভয়ে বাঁচি না। ভাইয়া আমার বাবাকে বললো। বাবা শুনে নেতিবাচক কথা বলতেই আমার ভাই বললো, ও যেই হোক। ও যাকে পছন্দ করেছে তার সাথেই ওর বিয়ে দিব। তোমরা থাকলে ভাল হয়, না থাকলে কম ভাল হয়।
ভাইয়ার এই অমোঘ ঘোষণার ফল হলো ভয়াবহ। আমার মা চিৎকার করে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। তারপর শুরু হলো ধমকাধমকি যেখানে কোন যৌক্তিক কিছু ছিল না। আমি খুব নরম গলায় ঠাণ্ডা মাথায় তাদের আপত্তির কারণ জানতে চাইলাম।
কিন্তু আমার মা বললো, “সেটা বলতে পারবো না, ঐ ছেলের সাথে বিয়ে হলে আমাদের সাথে সম্পর্ক থাকবে না। তুমি আমাদের তিন মাস সময় দাও। এর মধ্যে ওর থেকে ভাল পাত্র খুঁজে না আনতে পারলে তুমি চলে যেও”। আমি চুপচাপ মেনে নিলাম। এটা মানা সম্ভব ছিল না। তবু যাদের সাথে ৩০ বছর থাকলাম তাদের চাওয়া উড়িয়ে দিতে পারলাম না।
আমি চাইনি, আমার মনে কোনো ধরনের অপরাধ বোধ কাজ করুক, যে আমি আমার বাবা মায়ের চাওয়া অশ্রদ্ধা করেছি। যেদিন এই ঘটনা ঘটলো সেদিন আমার এক বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠান। আমরা একই বাড়িতে বাস করতাম। সে সুত্রে অনুষ্ঠানে না যাওয়া খুবই অস্বাভাবিক। আমাদের সেদিন ওর বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়নি।
আমার মা মনে প্রাণে বিশ্বাস করত আমার বন্ধুটির বিয়ে সেই হিন্দু সাধুর দেওয়া তাবিজের ফল। বন্ধুটির বিয়ের পাঁচ মাসে মা হওয়ার পরও সেই বিশ্বাস থেকে মা কে বের করে আনতে পারিনি। তখন অন্য যুক্তি দিয়ে তার বিশ্বাস কে অক্ষুণ্ণ রেখেছিল সে।
যাই হোক, তিন মাসে হুজুর, রকমারি পাত্র, ঘটক, মানসিক নির্যাতন নানা কিছুর মুখোমুখি হয়ে শেষে যে পাত্র তারা দেখালেন, তিনি দেখতে যেমনই হোক, আমার সাথে দাঁড়ালে জুটি হিসেবে হাস্যকর হবে। তার পড়াশোনা এবং চাকরির ইতিহাস আমার পছন্দের মানুষটির কাছাকাছিও নয়। কিন্তু তার বাবা ডাক্তার। আমার পছন্দের মানুষটির বাবা প্রয়াত। কিন্তু তার লোকাল গার্জিয়ান তার মামা, তিনি ডাক্তার। পছন্দের বাইরে, দু’জনের বাস্তবতার তুলনা আমি অস্বীকার করতে পারি না। বরং এই হিসেবগুলো আমাকে আমার সিদ্ধান্ত নিতে আরও সাহায্য করেছে।
তো সেই পাত্রের বাবা ডাক্তার সাহেব আমার শারীরিক অবয়ব হজম করেছেন এই সান্ত্বনায় যে, বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবো। আমার থেকে আমার পারিবারিক অবস্থান হয়তো তার আগ্রহের মূল ছিল। কারণ পাত্রের সাথে যেদিন এক খাবারের দোকানে আমার বাবা-মা দেখা করাতে নিয়ে গেলেন, সেদিন আমি ইচ্ছে করে তার বড় ভাইয়ের প্রশংসা করাতে তার ঠিকই গায়ে লেগেছিল, আমি চেয়েছিলাম লাগুক। আর কতো সহ্য করবো! বিয়েটা ভেঙে যাক। ওরা অনেক খাবার অফার করছিল। এক বিন্দু খাইনি আমি। আমি একজনকে ভালোবাসি, বিয়ে করতে চাই। সেও জানতো আমার বাবা-মা পাত্র দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। এগুলো কী ভীষণ কষ্টদায়ক, তা কাউকে বোঝানো যাবে না।
কিন্তু ঐদিন পাত্র দেখাদেখির পর বুঝলাম আর পারবো না। মাকে আগেই বলেছিলাম, কিছুদিন খালার বাসায় থাকবো। এর আগের সপ্তাহে যেতে দেয়নি, সাধুর তদবিরে সিঁদুরের উপর দাঁড়িয়ে গোসল ছিল তাই। আজ আর আটকাতে পারলো না। আমার মন বলছিল, এই বাড়িতে আর ফেরা হবে না। তাই পছন্দের মানুষটিকে বললাম, “আমি বেরিয়ে যাচ্ছি বাড়ি থেকে। জানি না আর ফিরবো কীনা, আমার হাতে কোনো টাকা নেই। আপত্তি থাকলে জানিয়ে দাও”। ভালবাসা থাকলে কি টাকা-পয়সা কোনো ব্যাপার হয়! ওর নিশ্চিন্ত একটা জবাব জেনে নির্দ্বিধায় বেরিয়ে এলাম।
খালার বাসায় দিন পনেরো ছিলাম। একদিন খালাকে সব বললাম। খালা, খালাতো বোন সব শুনে থ। এই ক’দিনে আমার মা একবারও ফোন করে আমার সাথে কথা বলেনি। আমি অপেক্ষা করতাম। ভাবতাম, একবার যদি আমার মা আমাকে ফোন করে বলে, মা তুই চলে আয়। আমি সাথে সাথে চলে যেতাম। ৩০ বছর এক খাটে শুয়ে অভ্যাস। একটা শিশুর মতো মায়ের সাথে কতো কতো আদর-আহ্লাদ!
না, শুধু একদিন খালার বাসার ফোনে ফোন করে আমাকে চেয়ে অনেক আজেবাজে কথা শোনালো। আমার মা আর আমার মা ছিল না। আসলে আমার কেউই ছিল না।
একদিন আমার খালাকে ফোন করে বললো, সেই শেষ দেখা পাত্রের সাথে আমার বিয়ে, আমাকে বুঝিয়ে হোক না বুঝিয়ে হোক পাঠাতে। আমি আতঙ্কে কেঁপে উঠলাম। কী করবো আমি? যেসব মেয়েদের জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়, তাদের অনুভূতিটা টের পেলাম হারে হারে।
পরদিন খুব ভোরে একটা চিঠি রেখে চলে গেলাম ভাইয়ার বাসায়, অনেকগুলো কষ্ট নিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে, সবার অগোচরে। (চলবে…)