অ্যাঞ্জেল সাঁকো: মেয়েদের এতো কৌতূহল কেন আরেকটা মেয়ের জীবন নিয়ে? কারও সাথে পরিচয় হলে প্রথম প্রশ্ন, ভাইয়া কী করে? যদি বলি ভাইয়া নেই, ব্যস, এইবার শুরু হলো লক্ষ্মীর পাঁচালী! নেই মানে? যদি বলি ডিভোর্স, তাইলে তো আর রক্ষে নেই! বাড়ি ভাড়া থেকে শুরু করে আমাদের স্যানিটারি ন্যাপকিনের হিসেবটা নিতেও ভুল করেন না।
একজন স্বাবলম্বী মেয়েকে যখন দেখছো, তখন ভাইয়ার প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে কি কথা বলা যায় না! একজন মেয়ের জীবনে স্বামী চরিত্রের একজন পুরুষ মানুষ থাকাটা কি খুব জরুরি?
কিছু মেয়েকে দেখি স্বামী বন্দনা করতে করতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলে, তখন তাদের ফ্যানা তোলা মুখটার দিকে তাকিয়ে আমার করুণা হয়। স্বামী বন্দনায় মুখে ফ্যানা তোলা বউ চরিত্রে অভিনয় করা মেয়েটা হয়তো জানতেও পারে না তার পতিদেবতার মন মন্দির জুড়ে আরেক দেবীর আনাগোনা। হয়তো অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, অন্যের মন-মন্দিরের খবর আমি কীভাবে জানি!
ব্যবসার সুবাদে অনেক নারী-পুরুষের সাথেই কমবেশি জানাশোনা থাকে বা আছে। তার মধ্যে বেশির ভাগ স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সাথেই আন্তরিকতা আছে। এদের কয়েকজনকে আমি জানি, বা দেখেছি, স্ত্রী বেচারাটি ২৪ ঘণ্টা স্বামীর গুনগান গেয়ে গেয়ে দিন পার করে। ওদিকে স্বামীটি তার অগোচরে অন্য মেয়েদের সাথে ইটিশ-পিটিশ করে দিনশেষে সতী-পতি রুপে সরলমতি বউয়ের আঁচলে মুখ গুঁজে দুইটা ভালোবাসার ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসীর গান শুনিয়েই দিনের পর দিন ঘুম পাড়িয়ে রাখে।
এরকম কিছু দম্পতিকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি! মেয়েটির মুখে তার স্বামীর গুণকীর্তন শুনে শুনে ভেবেই নিয়েছিলাম, তার স্বামী হয়তো অন্য পুরুষদের থেকে আলাদা বা স্বামী হিসেবে অন্যরকম! আমার সেই ধারণাকে প্রবলভাবে ভুল প্রমাণিত করে সেই মেয়ের স্বামীটি একদিন আমারই দ্বারস্থ হলো তার পরকিয়া প্রেম সফল করার জন্য সহযোগিতা চেয়ে!
সেদিন বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়েছিলো আমার উপরে। তখন তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তার কেন মনে হলো এই কাজে আমি তাকে সহযোগিতা করবো! তার উত্তরে সেই লোক জানিয়েছিলো, আমি তাকে এই কাজে সাহায্য না করলেও তার বউকে তার গোপন প্রেমের কথা আমি জানাবো না, এই বিশ্বাস থেকেই আমার কাছে আসা! তারপর ওনাকে বলেছিলাম, আপনার স্ত্রী তো আপনাকে অনেক ভালোবাসে, তার সমস্ত ভাবনা জুড়ে শুধু আপনি, এইরকম একজন মানুষকে আপনি ঠকাচ্ছেন, আপনার ভিতরে অপরাধবোধ কাজ করে না?? উত্তরে সেই স্বামী পুরুষটি বলেছিলো, সে তার স্ত্রীকে ঠকাচ্ছে না! কারণ তার স্ত্রীর যা কিছু প্রয়োজন, তার সবকিছুই সে পরিপূর্ণ করে। কাজেই একজন ‘বাহারওয়ালি’র সাথে পরকিয়া করে বেড়ানোর মধ্যে আবার অপরাধ কীসের!! তিনি সাথে এটাও বলেছিলেন, তার ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধু আছে, তারাও এরকম দুয়েকজন বান্ধবী মেইন্টেইন করে, তার তো শুধু একজন!
সেদিন ওনার কথায় মনে হয়েছে বিবাহিত পুরুষের দুয়েকটা মেয়ে বন্ধু না থাকলে যথেষ্ট স্মার্ট লাগে না, বা পুরুষদের দুই চারটা মেয়ে বন্ধু থাকাটা খুব ন্যাচারাল ব্যাপার। সেদিন এতোটাই আশ্চর্য হয়েছিলাম যে আমি কয়েক ঘন্টা বাকরুদ্ধ ছিলাম।
দিনশেষে বউয়ের আঁচলে মুখ গুঁজে সুখ খুঁজে বেড়ানো স্বামীটির সুনিপূণ এই চালাকি ঘূণাক্ষরেও টের পায় না গভীর ঘুমে নিমজ্জিত অবলা স্ত্রীটি। স্বামী সন্তানের প্রতি অন্ধবিশ্বাস আর ভালোবাসায়, তার জীবনের যা কিছু অর্জন সবকিছু ঢেলে দিয়ে সংসার নামের জাহাজ ঠেলে জীবনের সুন্দর সময়টা চার দেয়ালের মধ্যেই পার করে দেয় এই বোকা মেয়েগুলো।

এইরকম অনেক মেয়ের সাথে কথা বলে যা জানতে পারলাম, সেটা কমবেশি সবাই জানি! এদের মধ্যে কেউ কেউ উচ্চশিক্ষিত এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান! ফলে সমাজ, সংসার, স্বজনদের আত্মসম্মানের কথা চিন্তা করে স্বামীর অনেক অন্যায় অপরাধ তারা মুখ বুঁজে সহ্য করে! আবার কারও কারও দৃঢ় বিশ্বাস স্বামী বাইরে যা খুশি করুক, দিনশেষে ফিরতে হবে বউয়ের আঁচল তলেই! এইরকম চিন্তাভাবনাকারী মেয়েগুলোকে মেরুদণ্ডহীন দুপেয়ে প্রাণী ছাড়া আমার আর কিছুই মনে হয় না। আমি বলছি না, স্বামী-সন্তানের সেবা করা অন্যায়! আমি এও বলছি না যে, মেয়েরা স্বামী-সন্তান সংসার ছেড়ে সব সন্ন্যাসী হয়ে যাও। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি, জীবনটা অনেক সুন্দর, একটা মাত্র জীবন আমাদের, এই এক জীবনে কত্তকিছু দেখার বাকি, জানার বাকি। তোমরা যারা অন্যায়ের সাথে আপোস করে স্বামীদের এইসব ভণ্ডামিকে প্রশ্রয় দিয়ে আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলে বেড়াও, পুরুষমানুষ তো এইরকমই, তাদের জন্য একবস্তা মুড়িমাখা সমবেদনা।
যেই সমাজের কথা চিন্তা করে অতি সামাজিক মেয়েরা নিজেদের হাড়কালা করে কোনমতে টেনেটুনে জীবনটা পার করছেন, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, এই সমাজ আর স্বজনেরা আপনাদের এই কষ্টার্জিত সংসারের ঘানি টানার জন্য কী কোন পুরস্কার দেবেন? নাকি স্বামীর পায়ের নিচে কথিত বেহেশত পাবার আশায় পার্থিব জীবনের সুখ জলাঞ্জলি দিচ্ছেন?
আমি অবাক হই যখন দেখি শিক্ষিত আর সচেতন মেয়েগুলোও এই অন্যায়কে সমর্থন করে! অন্যায় করা আর অন্যায়ের সমর্থন করাও তো একই রকম অন্যায়।
আমাকে দেখে অনেক মেয়েই বলে, আমি নাকি অনেক সাহসী। আমি যেটা পারি বা পেরেছি সবাই তা পারে না। আমার প্রশ্ন, কেন পারে না? জীবনটা আমার! তাই আমার যা ভালো লাগে, আমি যেটায় আনন্দ পাই, সেটাই করি।
পরিশেষে বলবো আমার এই লেখাটায় কেউ ব্যক্তিগত ইস্যু টেনে তর্ক করতে আসবেন না। এবং আমি কাউকে হেয় করে কিছুই বলিনি বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকেই লিখেছি। তবে এর উল্টো চিত্রও যে আমাদের চারপাশে আছে, তা অস্বীকার করছি না। ঘরে স্বামী নামক সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রেখে যা খুশি করা মেয়েরও অভাব নেই এই সমাজে। আর এসব বিষবৃক্ষ চারা থেকে এখন মহীরুহ আকার নিচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে সংক্রামক ব্যাধির মতো। তবে সবাইকে সেখানে মেলানো ঠিক না।