পিএমএস: Premenstrual Syndrome

জিনাত হাসিবা স্বর্ণা: ছোটবেলা থেকেই কিছু অদ্ভুত প্রবাদ শুনে এসেছি- নারীর মন বোঝা দায়“, “নারী রহস্যময়ীব্লা ব্লা ব্লা! আমি মোটেই রহস্যের কিছু দেখি না! মানুষগুলিকে (মেয়ে/নারী) এমনভাবে তৈরি করা হয় যেন সে যা চায় তা করতে না পারে, যা বলতে চায় তা চেপে যেতে হয়, যা চায় না তাই মেনে নিতে হয়। এহেন মানুষ চাইবে একরকম বলবে আরেক রকম, বুঝবে এক রকম মানবে আরেক রকম- এটাই তো স্বাভাবিক! এ ছাড়াও কিছু শারীরিক বিষয় আছে। তার মধ্যে একটা হলো PMS (premenstrual syndrome)

এ বিষয়টা কেউ জানে না তা নয়, কিন্তু নেহায়েত কিছু ঠাট্টা মশকরা বাদে এ নিয়ে কোনো কথা হয় না। কথা যে হয় না তাও নারীর বেড়ে উঠার সাথে সম্পর্কিত। শৈশব থেকেই তার শালীনতাআর ভালো মেয়েহওয়া সম্পর্কে যা কিছু সাধারণত মেয়েদের শেখানো হয় তার সরাসরি ফলাফল হচ্ছে তার শরীর সম্পর্কে জড়তা তৈরী হওয়া। তাই নারীর জীবনের এই চ্যালেঞ্জগুলির অনেকটাই তার শরীরকে ঘিরে।

শরীর ঘিরেই নারীর যতো আনন্দ, পথ চলা, স্বপ্ন, আত্মবিশ্বাস, কাজের পরিধি, সহিংসতা, বৈষম্য, বঞ্চনা, বিষাদ- সমস্ত কিছু তৈরী। একেবারে ব্যক্তিগত থেকে পরিবার, সমাজ, বিশ্বময়। নিজের শরীর সম্পর্কে তাই প্রত্যেক মেয়ের এবং নারীর খুব ভালো ধারণা থাকা দরকার। শরীর আর মনের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নিজের কাজগুলোকে অনেক গোছানো, সহজ, আর আনন্দময় করে দিতে পারে। নিয়ন্ত্রণ মানে কিন্তু দমন নয়। (নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ আর নিজেকে দমিয়ে রাখার তফাৎটা মাথায় রাখা দরকার)।

নিয়ন্ত্রণ মানে এখানে নিজের ইচ্ছে, পছন্দ, আর প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেকে গড়ে নেওয়ার, মেলে ধরার, দুর্দান্ত গতিতে ছুটিয়ে নেওয়ার, থামিয়ে দেওয়ার, গুটিয়ে নেওয়ার দক্ষতা। এক কথায় নিজেকে পরিচালনা করার ক্ষমতা। এর জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন একটা স্বাধীনচেতা মন।

এই লেখাটা মূলত পিএমএসকে কেন্দ্র করে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে PMS বা premenstrual syndrome হলো প্রতিমাসে পিরিয়ডের আগে কখনো ভীষণ মন খারাপ করা, কখনো মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যাওয়া, চরম বিরক্তির মতো যেসব অনুভূতি হয় তাই। আমরা বিষয়টাকে তেমন পাত্তা দেই না। কিন্তু আমাদের কাজের ক্ষেত্রে কিন্তু এর বড় একটা ভূমিকা আছে। কাজের ক্ষেত্রে এর ভূমিকাটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি বলেই টুকটাক জানার চেষ্টা করেছি।

এই লেখাটা একেবারেই জ্ঞানহীন লেভেল থেকে লেখা, কিছুটা অভিজ্ঞতা আর কিছুটা ইন্টারনেট সার্চ থেকে। আমি লিংকগুলোও দিয়ে দিয়েছি নিচে। যারা ডাক্তার তারা নিঃসন্দেহে অনেক ভালো বলতে পারবেন (আমার ডাক্তার বন্ধু নওশাদকে দিয়ে একবার দেখিয়েও নিয়েছি, সবুজ বাতি পাওয়া গেছে ওর দিক থেকে। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা।), কিন্তু কথা বলার চর্চাটা আমাদের দিক থেকে হওয়াটা জরুরী।

যা বলছিলাম, মাসিকের রক্তপাত শুরুর এক থেকে দুই সপ্তাহ আগে পর্যন্ত পিএমএস শুরু হতে পারে। এক এক জনের ক্ষেত্রে এটা এক এক রকম সময় নেয়, কারো পিরিয়ডের আগের তিন দিন, কারো এক সপ্তাহ, কারো একদম মাসিকের প্রক্রিয়া শুরু হতেই (দুই সপ্তাহ আগে) হয়। আবার সবার যে হয় তাও না। তবে অনেকেরই হয়। মানসিক চাপের সাথে এর ব্যাপ্তি/ডিউরেশন এবং তীব্রতার সরাসরি সম্পর্ক আছে।

The American College of Obstetricians and Gynecologists  এর হিসেব অনুযায়ী মাসিক হচ্ছে এমন অন্তত ৮৫% নারী ন্যুনতম একটা পিএমএস সিনড্রোমে ভুগেন তাদের প্রতি মাসিক ঋতুচক্রে। তাদের বেশিরভাগই স্বল্পমাত্রার সিনড্রোমে ভুগেন যেটাতে চিকিৎসার দরকার হয় না। কিন্তু ৩-৮% নারীর ক্ষেত্রে এই সিনড্রোম তীব্র হয়ে থাকে যেক্ষেত্রে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। পিএমএস ঠিক কী কারণে হয় জানা না গেলেও এটা জানা গেছে যে মাসিক ঋতুচক্রজনিত হরমোনাল পরিবর্তনের সাথে এটা সম্পর্কিত। কারণ পিরিয়ড হয়নি, মেনোপজে আছেন বা প্রেগনেন্ট নারীদের পিএমএস হয় না। সে হিসেবে বলা যায় সাধারণত ২০-৪০ বছর বয়সী নারীরা পিএমএস এর আওতায় পড়েন।

এই লেখাটি তাদের কাজে লাগতে পারে যারা বা যাদের সঙ্গী অল্প স্বল্প কিন্তু নিয়মিত পিএমএস এ ভুগছেন। পিএমএস এ ভুগছেন কিনা বোঝা সহজ। মেয়েদের অনেকেরই মাঝে মাঝেই মনে হয়, “আমি তো এমন না! কেন এতো অল্পেই ভেঙে পড়ছি? এর চেয়ে অনেক বড় ধকল আমি স্বচ্ছন্দে পার করে এসেছি! এখন কেন একটুতেই খিটখিটে আচরণ করছি? কেন কোনো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি নিজের আচরণের উপর? কেন অকারণ মনে হচ্ছে মনটা ভীষণ খারাপ!

এমনটা হলে তখন তারিখটা খেয়াল করা, মাসিক/পিরিয়ড হবার তারিখটা কি কদিনের মধ্যেই? উত্তর যদি হয় হ্যাঁতাহলে পরের মাসটাও খেয়াল করে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া। অথবা উল্টোটাও করা যায়। মাসিক হবার আগের সময়টাতে নিজের আচরণ আর শারীরিক-মানসিক অবস্থার প্রতি কিছুটা মনোযোগ দিয়ে বুঝে নেওয়া যায়।

পিএমএস এ এক এক জনের এক এক ধরনের শারীরিক আর মানসিক  ভোগান্তি হয়। এর মধ্যে আছে স্তনে একটু ভার ভার বা হালকা ব্যথা ব্যথা ভাব, অবসন্ন ভাব, ঘুমের সমস্যা, পেটের সমস্যা/পাকস্থলীর সমস্যা/কোষ্ঠকাঠিন্য, পিঠে ব্যথা, মাথাব্যথা, ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া, জয়েন্ট/মাসল পেইন এসব শরীরকে ঘিরে যতো অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। সব নয়, এর যেকোনো একটা দুটো বা হয়তো কারো একটু বেশী। কিন্তু এগুলো ছাপিয়ে যেটা ছেয়ে থাকে সেটা হলো মানসিক/ইমোশনাল অবস্থানের অসামঞ্জস্যতা।

যেমন, স্থান-কাল-পাত্র ভুলে রেগে যাওয়া বা কেঁদে ফেলা। কিংবা যেখানে নিজের মতামতটা তুলে ধরা খুব দরকার ছিলো সেখানে নিজেকে গুটিয়ে রাখা। হঠাৎ খুব উৎফুল্ল আবার পর মুহূর্তেই বিমর্ষ হয়ে যাওয়া, যেটাকে মুড সুইং বলি আমরা। অযথাই কান্না পাওয়ার অনুভূতি কিংবা মনোযোগহীনতা, বিরক্তি, টেনশন। কাজের ক্ষেত্রে এই মানসিক বিষয়টাই মূলত বাঁধ সাধবে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হলো, কাজের প্রেশার বা স্ট্রেস পিএমএস এর তীব্রতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। তখন কাজগুলো গুবলেট হয়ে গিয়ে হতাশায় পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সবার ক্ষেত্রে একইরকম নয় বিষয়টা। কারো কারো ক্ষেত্রে এটা প্রতিমাসের অল্প সময় জুড়ে এক টুকরো অস্বস্তি মাত্র। কারো কারো ক্ষেত্রে এটা একটা নিয়মিত ভোগান্তি, একটা দিন পার করাও মুশকিল হয়ে যায় অনেকের জন্য! আবার কারো ক্ষেত্রে অন্যান্য সময় হালকা চালে চলে গেলেও কাজ বা দায়িত্বের চাপ থাকা অবস্থায় বেসামাল হয়ে যায় ব্যাপারটা। মোট কথা এর তীব্রতা আর ব্যাপ্তি প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ভিন্ন। আবার অন্য যেকোনো শারীরিক/মানসিক সমস্যার সাথে একে গুলিয়ে ফেলার কোনো মানে নেই।

জিনাত হাসিবা স্বর্ণা

পিএমএস হচ্ছে কিনা জানা থাকার বেশ কিছু সুবিধা আছে। এক: জানা থাকার ফলে বোঝা যায় যে ব্যাপারটা সাময়িক, সুতরাংআমি কেন এমন করছি/ আমার এখন কী হবেজাতীয় হতাশায় পড়ার সম্ভাবনা কমে যায়।

দুই: হিসেব করে বের করা যায় ঠিক কবে নাগাদ এটা কেটে যাবে (পিরিয়ডের ব্লিডিং শেষ বা বন্ধ হতেই পিএমএস উধাও হয়ে যায়)। এতে কনফিডেন্সটা থাকে আর কাজের প্ল্যান সে অনুযায়ী করা যায়। যেসব কাজে দায়িত্ব আর স্ট্রেস বেশী সেসব কাজ তারিখ বুঝে রাখা যায়।

তিন: পিএমএস কাটানোর বা কমানোর জন্য কী কী করতে হয় জানার চেষ্টা করা যায় অথেন্টিক ওয়েবসাইট ঘেঁটে বা ডাক্তারের পরামর্শে। সাধারণত পানি খাওয়ার পরিমাণ/ ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ানো, ব্যয়াম বা কায়িক শ্রম, নিজেকে  কাউন্সেলিং করা (নিজেকে মনে করিয়ে দেওয়া যে নেগেটিভ/হতাশজনক যা কিছু ভাবছি এর পেছনে হরমোনাল পরিবর্তনের হাত আছে) কাজে দেয়। তবে কারো বিশেষ কোন শারীরিক অসুবিধা থাকলে বাড়তি পানি খাওয়া আর এক্সারসাইজ করার বিষয়টা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া করা উচিত না।

চার: এ সময়টা নিজের যত্ন নিলে আর বিশ্রাম নিলে পিরিয়ড শেষ হবার পরের সময়টা তিনগুণ উদ্যম আর শক্তি নিয়ে করা যায়। (কর্মক্ষেত্রে/ঘরের কাজে পিরিয়ডকালীন ছুটির/বিশ্রামের সুযোগটা এজন্য থাকা উচিত, যেন যার প্রয়োজন আছে তার বিশ্রামের সুযোগ থাকে। তাতে পরবর্তীতে কাজও পূর্ণ মনোযোগ পায়, শরীর-মনও সতেজ থাকে। এক্ষেত্রে সহকর্মী/বন্ধু/পরিবারের সদস্যদের সচেতনতা প্রয়োজন)। কারণ শরীর-মন দুইই পিরিয়ড পরবর্তী সময়ে তিনগুণ শক্তিশালী, উদ্যমী আর সতেজ থাকে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিজের কাজের প্ল্যানিং আর বাস্তবায়নে।

নারীর প্রতি সমাজের ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ লুফে নেওয়ার সময় যাচ্ছে এখন। এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া যেমন ব্যক্তিগত নয়- সামাজিক ক্ষতি, তেমনি চালিয়ে নেওয়াটাও  উৎসাহ দেয় সমাজের আর দশজন নারীকে। আবার যারা এই চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়েছেন তাদের আশপাশের মানুষগুলিরও দায়িত্ব আছে তার পাশে থাকার, সাময়িক হতাশার সময়গুলোতে তাকে উচ্ছল রাখার এবং তার কাজ নিয়ে ক্রমাগত সমালোচনা করে তাকে কাহিল করে না দেওয়ার।

নিজের সমস্যাগুলো কেন হচ্ছে তা না জেনে অনেক সময় আমরা অযথাই সমস্যাটাকে বাড়িয়ে ফেলি।ব্যাপারটা কেন হচ্ছে সেই কারণটাবের করে সমাধান খোঁজার চেয়েকেন আমার সাথেই এমন হচ্ছেভেবে আত্মবিশ্বাস হারাবার পথ ধরি। আবার অন্যের বেলাতেও খুব সহজেই বলে ফেলিতুমি খুব ইমোশনাল, তোমার বদলানো উচিত“,/ “তুমি খুব দুর্বল, তোমার দ্বারা হবে না“/ “এই কাজ তোমাকে অসুস্থ করে তুলছে, না করাই ভালোইত্যাদি।

আমাদের সমাজে প্রত্যেক নারীকে পদে পদে প্রমাণ করতে হয় নিজেকে, কারণে অকারণে। এটা এড়িয়ে যাওয়া বা পাত্তা না দেওয়ার জন্যেও শক্তি লাগে, সঙ্গ লাগে। তাই এক অন্যকে বোঝা খুব প্রয়োজন। পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও, একে অন্যকে উৎসাহটা দেওয়া চাই। পাশে থাকা চাই!

যে মনটা দুঃখী দুঃখী থাকতো সে মনটা খুশী খুশী থাকুক! খুশী খুশী মনটা তার হাসি ছড়িয়ে দিক চারপাশে!

তথ্যসূত্র:

http://www.womenshealth.gov/publications/our-publications/fact-sheet/premenstrual-syndrome.html

http://www.pms.org.uk/about

https://www.womentowomen.com/pms/pms-symptoms-and-causes/

http://www.healthline.com/health/premenstrual-syndrome

শেয়ার করুন: