হিরো আলম বনাম সালমান খান

রাবেয়া জাহান আভা: কুষ্টিয়ার বিখ্যাত নাসির বিড়ি, আকিজ বিড়ির নাম হয়তো অনেকেই শুনে থাকবেন। কাঠির সাথে কাগজ পেঁচিয়ে বিড়ি বানানোটা আমার কাছে এক ধরনের শিল্পই মনে হতো, কুটিরশিল্প বা হস্তশিল্পের মতো। সরু কাগজের এই ঠোঙাটির মধ্যে তামাক পাতার গুঁড়ো পুরেই মূলত বিড়ি বানানো হতো। রুপকথার গল্পের মতো ছোটবেলায় শুনেছিলাম উপরোক্ত দুই ব্যক্তির মধ্যে কোন একজন সামান্য বিড়ি শ্রমিক ছিলেন। বিড়ি বানাতে বানাতেই একদিন তারা নিজেরাই বিশাল ফ্যাক্টরি দিয়ে ফেলেন। কিভাবে মালিক হলেন সে গল্পও নিশ্চই একদিনের নয়। তার মধ্যে নিশ্চই আছে স্বপ্ন, চেষ্টা আর সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদ।

স্বপ্ন দেখতে দেখতে কোন কোন মানুষের জীবন স্বপ্নের মতো হয়ে যাবে। আর এটাকেই আমরা বলি ভাগ্য। মানুষের কর্মচেষ্টা না ভাগ্য বড়-এই ভাবনাটা সবসময়ই গোলমেলে আমার কাছে। কখনো কখনো ভাগ্যকেই অনেক বেশি সত্য বলে মনে হয়। সুকঠিন বাস্তবতায় আমাদের চোখের সামনে কোন একজন সামান্য ব্যক্তি যখন সবার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক উপরে চলে যায়, এক ধরণের ঈর্ষাকাতরতা থেকেই আমাদের তা মানতে কষ্ট হয়। তার প্রতি আমাদের ভাবনাটাও সস্তা হয়ে যায়।

একজন মানুষ সামান্য চা বিক্রেতা থেকে যখন একটা দেশের প্রধান হন তখন আমরা তাতে বাহবা দেই কারণ তিনি বাইরের দেশের। জাতি হিসেবে আমরা বরাবরই একটু বেশি উদার, অন্যদের প্রতি। গুগল সার্চের জনপ্রিয়তায় যখন বলিউড তারকা সালমান খানকে পেছনে ফেলে এসেছেন একজন সাধারণ হিরো আলম তখন তার এই জনপ্রিয়তাকে আমি সাধুবাদ জানাই। কারণ হিরো আলম গ্রামের একজন সহজ, সরল, সাধারণ ছেলে। একজন সাধারণ ডিশ ব্যবসায়ী থেকে আজ যে পর‌যায়ে তিনি এসেছেন তাতে অনেকের সহায়তা থাকলেও প্রথমে তিনি তা করেছেন সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়। তিনি যখন ভিডিওগুলো বানিয়েছেন তখন কিন্তু আমরা তা দেখেছি, উপহাস করে হেসেছি, আবার কুমন্তব্য করতেও ছাড়িনি।

তিনি কিন্তু সেগুলো বানাবার সময় একবারও তার জনপ্রিয়তার কথা ভাবেননি। নিজে আনন্দ পাওয়া আর অন্যকে আনন্দ দেয়াই ছিল তার প্রধান উদ্দেশ্য।  তাতে কেউ তাকে নিয়ে হাসাহাসি না সমালোচনা করলো তাতে কিন্তু তার কোন যায় আসেনি, যেমন আজো আসেনা। হয়তো তিনি মানুষকে এইভাবে ভাবতে শেখেননি। সস্তা ভাঁড়ামি হয়তো তিনি করেন কিন্তু তিনি তো তাতে মানুষকে আনন্দ দেন।

চুরি তো আর করেন না। শহুরে আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা ছেলেদের মতো কথায় কথায় ইংরেজি বুলি কপচাতে পারেন না বলেই তিনি ভাঁড় আর হাসির পাত্র আমাদের কাছে। আমাদের মিডিয়াতে, রাজনীতিতে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা নিজেদেরকে কমেডিয়ান মনে করলেও আসলে তিনি যা করেন তা একধরনের ভাঁড়ামিই। ব্যক্তি হিসেবে তার জনপ্রিয়তার কারণে হয়তো তার এই ভাড়ামিকে আমরা কমেডি মেনে বাহবা দিই। আর আমরা তা করি তোষামোদ করতে, নিজেদের স্বার্থে। আমাদের সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক সফল মানুষই আছেন যাদের শব্দ উচ্চারণে, কথায় আঞ্চলিকতা আর ভুলভালের ছড়াছড়ি। তো তারা যদি শুধু ক্ষমতার কারণে বাহবা পাবার যোগ্য হন তাহলে এত মানুষের ভীড়ে একজন হিরো আলমকে নিয়ে এত হাসাহাসিই বা কেন?

রাবেয়া জাহান আভা

আমার তো মনে হয়, গ্রামের সন্তান হবার কারণেই এক ধরনের ঈর্ষাকাতরতা তার প্রতি আমাদের। আমরা সবসময় গ্রামের মানুষদের ক্ষ্যাত আর চাষা ভাবতেই পছন্দ করি। অথচ এই চাষারা চাষ করে বলেই আমরা তিনবেলা খেতে পাই। হিরো আলমের ভিডিওগুলো আমরা দেখে, সমালোচনা করে হেসেছি আর সস্তা বলে মন্তব্য করেছি। তবে কি তার প্রতি আমাদের এই সস্তা মানসিকতাই তাকে জনপ্রিয় করে তুললো?

এক্ষেত্রে সচরাচর শোনা একটা কথা খুব মনে পড়ছে ‘বন্ধু ফেল করলে কষ্ট হয় তবে তার চেয়ে বেশি কষ্ট হয় যখন শুনি সে ফার্ষ্ট হয়েছে’। কাজেই আমাদের উচিত এই কষ্ট ভুলে যাওয়া। বরং আনন্দ করা উচিত এই ভেবে যে, আমাদের হিরো আলম আর যাই হোক একজন বিশ্ব জনপ্রিয় হিরোকে হারিয়েছেন, জনপ্রিয়তার জায়গা থেকে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাওয়া থেকেই যখন বৃহৎ প্রাপ্তির আনন্দ তখন এটাই বা কম কি একটা দেশের জন্য??   

শেয়ার করুন: