সুরাইয়া আবেদীন: ৩৪ বছর আগের মুভি ‘নিকাহ’! কাহিনী এরকম- নিলোফারকে (সালমা আগা) ভালবাসতো হায়দার (রাজ বাবর), যারা দুজনেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। কিন্তু ততোদিনে নিলোফারের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে নবাব ওয়াসিম (দীপক) এর সাথে।
ওয়াসিম হলেন সফল ইঞ্জিনিয়ার, আর হায়দার উঠতি কবি! ওয়াসিম আর নিলোফার একে অন্যকে ভালবাসতেন, ওয়াসিম দেশে ফিরতেই পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়ে গেল! কালক্রমে দেখা গেল নিলোফারকে বিয়ের পর সময়ই দিতে পারছে না ওয়াসিম।
সে ছিল ওয়ার্কহোলিক! বিয়ের পর থেকে নিলোফার দেখতো তার জন্য স্বামীর প্রাপ্য সময়টুকুও নেই! বিয়ের পর হানিমুনে গেলেও ওয়াসিম কাজ নিয়েই ব্যস্ত! প্রথম বিয়েবার্ষিকীতেও তাই! অভিমান ততদিনে অনেক জমে গেছে! বিয়েবার্ষিকীর রাতেই ঝগড়ার এক পর্যায়ে ওয়াসিম তিন তালাক উচ্চারণ করে ফেলেন!
চলে আসে নিলোফার সে সংসার ছেড়ে! কেননা ‘তালাক’ হয়ে গেছে! এরপরই ওয়াসিম তার ভুল বুঝতে পারে, স্ত্রীকে ফিরে পেতে চায়। একাকি, নিঃসঙ্গ ওয়াসিম শোনে বিখ্যাত গজল ”চুপকে চুপকে রাত দিন , আসূ বাহানা ইয়াদ হ্যায়…”
আর এদিকে হায়দার ততোদিনে প্রতিষ্ঠিত কবি এবং ম্যাগাজিনের সম্পাদক! ইতিমধ্যেই পুনরায় দেখা হয়ে গেল হায়দার আর নিলোফারের! স্বাবলম্বী হবার জন্য নিলোফার এর চাকরি দরকার ছিল, হায়দার নিজ প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়ে দেয় তাকে।
কালক্রমে জানা যায় হায়দার নিলোফারকেই চায় এখনো। হায়দারের হৃদয়ের যেখানে নিলোফার ছিল, সেখানেই আছে সে। বিয়ে করে তারা!
আর ঐদিকে দেখা যায় ওদের এই বিয়েকে ভুলভাবে নেয় ওয়াসিম! ইসলামি নিয়ম অনুযায়ী তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে ফিরে পেতে চাইলে আরেক পুরুষের স্ত্রী হতে হয়, স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকতে হয়, এরপর বর্তমান এই স্বামী স্বেচ্ছায় তালাক দিলেই কেবল পুনরায় সাবেক স্বামী-স্ত্রীর বিয়ে হতে পারে।
কিন্তু ওয়াসিম যখন দেখলো হায়দার-নিলোফার ভালোবেসেই বিয়ে করেছে, এখানে তাকে পাবার কোনো চিন্তাই নিলোফার করে নাই, তখন সে তাদের মাঝখান থেকে সরে যায়!
মূলত ঐ আমলে মুসলিম সমাজে তালাকের ভয়াবহতা, নেতিবাচকতা দেখানোর উদ্দেশ্যই ছিল এই মুভির।
এবার আসি ২০১৬ এর ‘প্রাক্তন’ এ—
সুদীপা (ঋতুপর্ণা) ও উজান (প্রসেনজিৎ) ভালোবেসেই বিয়ে করে। বিয়ের পর থেকে সুদীপার সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয় উজানের!
বাবার বাড়ি যেতে টিকেট উজানই কিনে দিবে। সুদীপার পয়সায় কেনা টিকেটে তার আপত্তি! বাবার বাড়ি যেতে উজানের অনুমতি লাগবে… স্বাধীনচেতা, স্বাবলম্বী সুদীপা এসবে আপত্তি জানায়।
আবার দেখা যায় সুদীপার পাশে উজানকে পাওয়া যায় না মিসক্যারেজের সময়, কেননা সে ‘ব্যস্ত’ ছিল!
কাজের প্রয়োজনে সুদীপা দেরি করে ফিরলে তার সাথে বসের শারীরিক সম্পর্কের সন্দেহ প্রকাশ করে উজান!
সুদীপার জন্মদিনে উজান সময় দিতে পারে না! ঐ একই কারণ ‘কাজ’! হানিমুনের জন্য সুদীপা নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা করলে তাতে উজান অপমানিত বোধ করে, জানায় নিজে টাকা করতে পারলে যাবে, নইলে না!
সুদীপা জামা কিনে দিলে তাতেও উজান তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়! কেননা জামার গায়ে দামের ট্যাগ থাকে। উজান বলে- সুদীপা ট্যাগগুলো রেখে দেয় কারণ সে কত টাকা দিয়ে জামাগুলো কিনে এনেছে, তা উজানকে দেখাতে চায়!
দিনের পর দিন এসব তিক্ততায় যখন সুদীপা আর পারে না তখন শেষবারের মত নিজেদের বিয়ে বাঁচানোর জন্য সেই-ই উদ্যোগ নেয়! একসাথে দুজনের বেড়াতে যাবার সিদ্ধান্ত হয়। উজান একমতও হয়। কিন্তু আসতে পারে না। সুদীপার সংসার বাঁচানোর শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হয় উজানের বোধের অভাবে! যে বোধে বন্ধুর মায়ের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের প্রাধান্য ছিল, কিন্তু নিজের সংসার বাঁচানোর নয়! এরপরই ডিভোর্স দেয় উজানকে সুদীপা!
কাহিনীর এ সবটাই আমরা দেখি ফ্ল্যাশব্যাকে, আর বর্তমানে ছিল সুদীপা, আর উজানের বর্তমান স্ত্রী মালিনী (অপারিজাতা আঢ্য) ও শিশু সন্তান! যারা কিনা একই ট্রেন যাত্রায় একে অন্যর সহযাত্রী হয়েছে!
উজানের স্ত্রী মালিনীর জন্মদিনে ট্রেনে সারপ্রাইজ দিতে আসে উজান, তখনই মূলত দেখা হয় দুই প্রাক্তনের!
বেজে ওঠে বিরহের গান ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া…’
আপাতদৃষ্টিতে সুদীপা দেখে উজানের বর্তমান স্ত্রীকে উজান তাই তাই দিয়েছে, যা যা তাকে দেয়নি বা দিতে পারেনি!
সুদীপা নিজেকেই দোষী ভাবে তার এই না পাওয়ার জন্য!
কিন্তু সে এটা দেখতে ব্যর্থ হয় উজানের বর্তমান স্ত্রী সেগুলোই নিজের ব্যক্তিসত্ত্বা থেকে বাদ দিয়েছে, কিংবা সুগার কোটিং করে বললে ‘কম্প্রোমাইজ’ করেছে, যা যা সুদীপা নিজের ব্যক্তিত্ব আর মাথা উঁচু করে চলার মাধ্যমে অর্জন করতে ও পেতে চেয়েছিল!
এই যে দুই নারীর নিজের জীবন থেকে ‘নিজস্বতা’ এবং ‘ব্যক্তি সত্ত্বার স্বাধীনতা, চাওয়া-পাওয়া’ বাদ দেয়া আর না দেয়াতেই দাম্পত্য সুখের যে সংজ্ঞা চিত্রায়িত হলো- তাতে কিন্তু উজানের কোন ত্যাগ কিংবা স্যাক্রিফাইস নাই!
কম্প্রোমাইজ এসেছে নারী বদলে, পুরুষ কিন্তু যা ছিল তাই আছে! অবশ্য মালিনীর কারণে বাজারের ব্যাগ হাতে তুলতে পেরেছে বলে উজান জানায়! তা কী এমন কৃতিত্বের, বুঝি নাই!
মুভিটা শেষ হয় সুদীপার কষ্ট দিয়ে, যে কষ্টে ছিল উজানকে হারানোর ব্যথা, কেননা সে মালিনী (উজানের বর্তমান স্ত্রী)-কে দেখে এই বোধ নিয়েই ট্রেন থেকে নিয়ে নামে, যে বোধে ছিল মালিনীই ঠিক, সুদীপাই ভুল! ৩৪ বছর আগের মুভিতে ‘নিলোফার’ আর ২০১৬ এর ‘সুদীপা’- দুইজন কিন্তু একই পরিণতির দিকে যায়!
যদিও এই যাওয়ার পথ, কারণ, আবরণ ছিল সময়, সমাজ, দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ভিন্ন। কিন্তু দুজনের অভিমানই ছিল স্বামীকে কেন্দ্র করেই, যে অভিমানে ছিল স্বামীর নিজের ভুল না বুঝতে পারা। বিচ্ছেদের পথে হাঁটা দুইজনই এই পরিণতির দিকে আগায় স্বামীর ‘মেল ইগো’র কারণে, স্বামীর মনোযোগের অভাবে, পাশে স্বামীর অনুপস্থিতিতে!
প্রেক্ষাপট ভিন্ন, অজুহাত ভিন্ন- সাফারার কিন্তু একই আছে!
নারীরা!
নিলোফার কিন্তু সাবেক স্বামীর প্রতি অভিমান বোধ করলেও ফেরত যায় না, বা নিজেকে দোষী ভাবে না! বরং স্বামীর ভুলই সে স্বামীকে উপলব্ধি করায়! যেটা ভয়াবহভাবে সুদীপার মধ্যে অনুপস্থিত ছিল! নিলোফার নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকে এবং তাকে প্রাপ্য সম্মান দেয়া হায়দারকেই বেছে নেয়!

সুদীপাও বিয়ে করেছিল, ভালোবেসে স্বামী তাকে নিতেও আসে, কিন্তু ফেরত যাবার কালে বারবার সে উজানকেই ফিরে ফিরে দেখে!! মুভির বিচারে দুইটাই দুইরকম ভালো লেগেছে। মালিনীর মতো মেয়েই সমাজে বেশি, স্বামীকে পেতে নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দেয়া- মালিনী মালিনীর মতো ঠিকই আছে…
পুরুষ তো এমন ‘পুতুল’ই চায়! দুই মুভির কাহিনী ভিন্ন হলেও নারী চরিত্র দুটি একই পথে হাঁটে, একই পরিণতি হয় তাদের, শুধু ব্যক্তিত্ববোধের জায়গাতে নিলোফার সুদীপাকে হারিয়ে দিয়েছে! নারী দর্শক হিসেবে এই দুই নারী ব্যক্তিত্বের চিত্র যদি বিচার করি, তাহলে নিলোফারকেই বেছে নেব আমি।
সুদীপার জন্য বেদনা অনুভব করেছি, নিলোফারের জন্য শ্রদ্ধা! আর মালিনীর জন্য?
কিছুই না।