বিজয় র‌্যালি-সৌভাগ্য, নাকি দুর্ভাগ্য আমাদের?

বিথী হক: আমার কাছে বিজয়, স্বাধীনতা শব্দগুলো স্বতন্ত্র। কোনভাবেই শর্তসাপেক্ষ নয়। কেউ বিজয় দিবসে “আজ ফির তুমপে পেয়ার আয়া হে, আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেলরে মরার কোকিলে বা চল বেটা সেলফি লে লে রে” গান শুনলে বিজয় টুটাফাটা হয়ে রাস্তায় যেমন পড়ে না, তেমনি লাল-সবুজ কাপড় না পরে বা স্ট্যাটাস না দিলেও কোনকিছুর অবমাননা হয় না। কোনকিছু অনুভব করা আর লোক দেখানো এক জিনিস নয়, আমি এটাই মানি।

তো আজকে এসাইনমেন্টে একটা বিজয় র‍্যালি কাভার করতে গেলাম। অফিস অবশ্য আমাকে জোর করে পাঠায়নি। একজন ছেলে রিপোর্টার পাঠাতে চেয়েছিল, আমিই বরং আগ্রহী হয়ে গেলাম। তো বিশাল র‍্যালি, পাঁচ লাখের মতো মানুষ ছিল শুনলাম। মিন্টু রোডের মাথায় আসতেই পুলিশ গাড়ি থামিয়ে দিল, আর যেতে দেওয়া হবে না। র‍্যালির গাড়ি যাবে তাই রাস্তা ‘কিলিয়ার করতি হপে’। তো, ব্যাগ আর ট্রাইপড, বুম হাতে নিয়ে নামলাম। র‍্যালির আগে আগে দৌড়ালাম, মধ্যে মধ্যে দৌড়ালাম, পিছে পিছে দৌড়ালাম। প্রায়ই র‍্যালির ছেলেপিলেরা মানে যারা আমার ছোট ভাইয়ের সমবয়সী হবে তারা এক এক জায়গায় সামনে পেছনে যায় আর তাকায়। শীষ দেয়, গান গায়, এটা ওটা বলে।

ভাবলাম, ধূর এসব পাত্তা দেওয়ার কী আছে! বিজয় র‍্যালি তো, নাকি? মানুষ তো একটু আনন্দ করবেই। ভিড়ের মধ্যে একটু-আধটু কনুই এর গুঁতা দিলেই বা এমন কী হয়? মরার কোকিলে বলে দৌড়ে কানের কাছে এসে ‘কুউ’ করে কোকিল-ডাক ডাকলেও দোষের কিছু নাই আসলে।

এতোকিছুর মধ্যেও যখনই দেশের গান বাজছিল, তখন একটু স্বস্তি পাচ্ছিলাম। দেশের গানের সাথে মনে হয় বুক নাচিয়ে কাউকে বিরক্ত করা যায় না, অন্তত আজকের অবজারভেশন সে কথাই বললো। তাই দেশের গান বাজলেই আমি সব ভুলে নিজেও কিছুটা আনন্দ পাচ্ছিলাম।

বিথী হক

যাক সেসব কথা, বিজয়ের দিনে বিজয়ের আনন্দ প্রকাশ করতে পুরো শহর অচল করে যে বিজয়ানন্দ মানুষ পেল, তা অস্বীকার করে রাজাকার তকমা পেতে চাই না। একটা দিনই তো! অচলায়তনে আটকে পড়ে এ্যাম্বুলেন্সে কয়েকটা মানুষের জন্য পাঁচ লাখ মানুষের আনন্দ মাটি হয়ে যাক, সেটা নিশ্চয়ই আপনিও চান না!

আনন্দ করার চেয়ে মানুষের জীবনের দাম কি বেশি নাকি? আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা তো এমনিতেই বেশি। বেশি যে সেটা আজকের র‍্যালিতে আরো বেশি করে বোঝা গেল, যখন একসঙ্গে এতো মানুষের হাতে হাতে লাল-সবুজ পতাকাগুলো নড়ে নড়ে উঠছিল। যেন এক একটা পতাকা একটা পুরো দেশ হয়ে জীবন্ত হয়ে উঠছিল।

আহ্ এতো প্রেম! এতো ভালবাসে মানুষ দেশকে, দেশের পতাকাকে! তাহলে কী এই দেশ, দেশের মানুষকে ভাল না বেসে পারা যায়?

তারপর বিকেল একটু একটু করে হাত-পা ছেড়ে শুয়ে পড়ছে সন্ধ্যে হবে বলে। ফুটপাত ধুয়ে মুছে জলের ধারা রাস্তায় এসে নেমেছে, মিশে যাচ্ছে সবার পায়ে পায়ে। টের পেলাম, এটা যে সে পানি নয়; এ পানি বিজয়ানন্দের শরীক লাখো জনতার পেট হয়ে তারপর রাস্তায় মিশেছে। তার একটু পর একটা একটা করে লাল-সবুজ পতাকা সবার হাত থেকে খসে পড়তে শুরু করেছে। বিজয় আনন্দ শেষের পথে।

এই পতাকা দিয়ে আর কী হবে? পায়ের তলায় পড়ে বিবর্ণ হতে হতে লেপ্টে যাচ্ছে কিছুক্ষণ আগে লাল-সবুজের জীবন্ত হয়ে ওঠা পতাকাগুলো। তাহলে কি এই পতাকার কদর শুধু আনন্দ অনুষ্ঠানের জন্য?

৩০ লাখ মানুষ তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আনন্দ করতে প্রাণ দিয়ে একটা পতাকা দিয়ে গিয়েছিল? নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুধু এই বিজয়ানন্দের জন্য? বাস্তব জীবনে এর কোন ঠাঁই নেই?

বাদ দিলাম সব, রাস্তা নোংরা করাটাও তো কোনভাবে বিজয়ের অংশ নয়। দেশপ্রেম থেকে যদি বিজয়ের আনন্দ জিনিসটা না আসে, বিজয় কী তাহলে? বিজয়ের আনন্দ করতে গিয়ে বিজয়ের অর্থ ভোলা মানুষরা কীসের আনন্দ করতে যায়? শহর অচল করে, ঝাকানাকা গানের সাথে নেচে নেচে, মেয়েদের সাথে জানোয়ারপনা আচরণ করা এই আনন্দের পটভূমি কী ছিল?

যে বিজয় একটা মেয়েকে ঠিকমতো রাস্তায় হাঁটতে দেয় না, তাকে চোখ দিয়ে খুবলে খায়, নোংরা ইঙ্গিত করে, মানুষের হাঁটার রাস্তা প্রস্রাবে ভিজিয়ে রাখে, ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাস্তা নোংরা করে ফেলে, রাস্তায় আটকে মানুষকে মরে যেতে বাধ্য করে, সে বিজয়ের জন্যই কি তবে এত কাঠ-খড় পোড়ানো? যে বিজয় মানুষকে পতাকার মূল্য দিতে শেখায় না, পায়ের তলে পিষে ফেললেও যার কোনো ভাবান্তর হয় না, তার আবার বিজয় কিসের? আর কিসেরই বা বিজয় র‍্যালি!

সব দিনই তো মানুষ রাস্তায় আটকে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা, সব দিনই মানুষ জিপার খুলে রাস্তায় মুতে, সবদিনই মানুষ মেয়ে দেখলে জিভ বের করে রাখে, সবদিনই মানুষ ডাস্টবিন বাদ দিয়ে রাস্তাকে বাপের ডাস্টবিন মনে করে; তাহলে এই দিনের সাথে অন্যান্য দিনের পার্থক্য কি?  

আর কার, কী মত, আমি জানি না, জানতেও চাই না। শুধু জানি, এই বিজয় আনন্দ আমি চাই না। আমার জন্য একটা নিরাপদ রাস্তার ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক, এ্যাম্বুলেন্সের জন্য রাস্তা ছেড়ে দেওয়া হোক, ঘরে ঘরে পতাকা না টাঙিয়ে দেশের কীসে ভাল হয় সে কথা মানুষের মগজে ঢোকানো হোক। সেদিন আমি পছন্দের হিন্দি, বাংলা, ঊর্দু, ফারসি, মঙ্গোলিয়ান গান ছেড়ে ঘরে বসে বিজয়ের আনন্দ করবো। আমার কাছে বিজয় মানে সেটাই। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আনন্দ করার মাঝে আরো অনেক কিছু থাকতে পারে তবে বিজয়ের মূল ভাবটাই অনুপস্থিত।

শেয়ার করুন: